সম্পাদকীয়

আষাঢ়, শ্রাবন মাস বৃষ্টির মাস । আর বৃষ্টি মানেই যে কোন বাঙালির মনমহলে গপ্পের ঝাঁপি উপুর তো হবেই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে । এই যেমন আমার হল । আর সেই গল্পই রইল পাঠকের দরবারে ।
আমি তখন সবে স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেছি । দুনিয়াকে বুঝে, শুনে নেওয়ার প্রবল আগ্রহ । এই সময়তেই একটি ছোটখাট সংবাদপত্রে মেয়েদের বিভাগটি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলাম ।
তা, একদিন এমন বৃষ্টির দিনে সম্পাদকের নির্দেশ মতো পৌঁছেছি উত্তর কলকাতার ‘নলিনী কারুকৃতি’ সংস্থায় । এইখানে আশ্চর্য সুন্দর লেসের এবং সুতোর কাজ করতেন কিছু মেয়ে, বৌরা । সংসারের জাতাকল সামলে দুপুরে তাঁরা নলিনী ভবনে মিলিত হতেন (স্বর্গীয় বিদুষী নারী নলিনী বসু ছিলেন “নলিনী কারুকৃতি ” র কর্ণধার) । তাঁরা সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে ,গান শুনতে শুনতে অসামন্য লেস বুনতেন, কাপড়ে ফোড় তুলতেন। আর যে বাড়ীর বিশাল ঘরে বসে তাঁরা কাজ করতেন সেই ঘরে ছিল নলিনী বসুর এক রঙিন পোর্ট্রেট। দিঘাঙ্গী, কাঁচা সোনার মত গায়ের রঙ, সরু লেস বসানো শাড়ি আটপৌরে স্টাইলে পরেছেন , আর চওরা লেস বসানো ব্লাউজ তার সাথে ম্যাচ করে পরা। পোর্ট্রেটের ভদ্রমহিলা এই কর্মকাণ্ড শুরু করেন এবং পরে তাঁর মেয়ে বৌমারা এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিয়ে যান । এখন আর সেই সংস্থা আছে কিনা জানি না। সে যাই হোক সেদিন তো পেট পুরে চা আর ‘নলিনী কারুকৃতি’র মেয়ে বৌদের হাতে তৈরি জলখাবার কচুড়ি তরকারি খেয়ে, জম্পেশ একটি প্রতিবেদনের মালমশলা মাথায় এবং ঝোলা ভর্তি বড়ি, আঁচার, আমসত্ত্ব ইত্যাদি উপহার, সম্পাদক এবং নিজের জন্য ব্যাগে পুরে বেরিয়ে পড়লাম। ‘নলিনী’ র মেয়েরা বেজায় খুশি । প্রচারের আলোতে সকলেই থাকতে চায়, তায় আবার ছাপার অক্ষরে নাম বেরোবে। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই নামল বৃষ্টি । অগত্যা বাসস্ট্যান্ডের নীচে মাথা বাঁচাতে ঢোকা। দিনেদুপুরে রাত নটার আঁধার নামল,ক্ষ্যাপা শ্রাবনের তাণ্ডবে ভিজে টিজে একাকার। ঠিক তখনই এক ভদ্রমহিলা এসে একটা শুকনো কাপড় এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘মাথাটা মুছে নাও” । আমি ধন্যবাদ দিয়ে তাঁর সাথে গপ্প জুড়লাম। ভদ্রমহিলার হাতে বিশাল ব্যাগ। ওই ‘নলিনী কারুকৃতি’তেই যাচ্ছেন। কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি এইসব বলতে বলতেই একটা ফাঁকা বাস এসে পড়ল। আমিও লম্ফ দিয়ে চেপে বসলাম। ভদ্রমহিলাকে বিদায় জানানো হয় নি। উত্তর কলকাতার গলিরা এমনিতেই রহস্য এবং ইতিহাসে মাখামাখি আর সেদিন প্রতিবেদনের জন্য নেওয়া নলিনীর মেয়েদের সাক্ষাৎকার দিব্যি মিলেমিশে গিয়েছিল। সেসব ভাবতে ভাবতেই দক্ষিণে বাস যখন দুলকি চালে ঢুকছে আর আমিও দক্ষিণ কলকাতার মানুষ চেনা পাড়ায় ঢোকার আরাম বোধ করছি, ঠিক তখনি মনে হল আরে বাসস্ট্যান্ডে দেখা হওয়া ভদ্রমহিলা তো অবিকল পোর্ট্রেটের নলিনী বসুর মত দেখতে ছিলেন । অমন লম্বা, ফর্সা, লেসের ম্যাচিং শাড়ী, ব্লাউজ পরনে। কে উনি? কেনোই বা আমায় শুকনো কাপড় মাথা মুছতে এগিয়ে দিলেন ওই নির্জন বৃষ্টির দুপুরে? নাঃ , কাউকে কিছু বলি নি তখন। কাগজ দিতে নলিনী ভবনে পরে যখন গিয়েছিলাম পোর্ট্রেটের নলিনী বসুকে পেন্নাম ঠুকে এসেছিলাম। এই আজ শ্রাবনে সেসব কথা মনে পড়ল তাই বলেই ফেললাম ।
শ্রাবনী শুভেচ্ছা সকলকে ।
ইন্দ্রাণী ঘোষ