হৈচৈ ছোটদের গল্পে সুদীপ্ত পারিয়াল

লোভনীয় লোকনাথ

আমাদের গ্রামে এক নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে। বৈরাগীতলা আমাদের গ্রামে একটি বিখ্যাত ধর্মীয় স্থান। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস এবং ভক্তি সেখানে যেন এক হয়ে যায়। তারা সেখানে গিয়ে পুজো করে, নিজের মনের ভার হাল্কা করে।

কিন্তু ইদানিং বৈরাগীতলার ঠিক পাশের বটগাছের নিচটায় একজন নতুন বৈরাগীর আবির্ভাব হয়েছে। আমরা যেতে আসতে তাকে দেখতে পাই। সবসময় সে বাবা লোকনাথের মতন পোশাক পরে থাকেন। তাই অনেকেই তাকে বাবা লোকনাথের অবতার বলে পুজো করেন। গ্রামের মানুষ সহজেই এই ধরনের মিথগুলোকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। তিনি নাকি বলেন তিনি উপবাসী। রণদা সদরে কলেজে যাতায়াত করে বলে ব্যাপারটাকে সেরকম গুরুত্ব দেয় না। তবে আমি জানি ও সমস্ত খবরা-খবর রাখে। এমনকি এই যে নতুন বৈরাগী বাবার আবির্ভাব ঘটেছে তার সম্পর্কেও রণদা যথেষ্ট কৌতুহল প্রদর্শন করে। যদিও আমাদের কাউকে সেটা দেখায় না।

আমি সুজনদাদার সাথে মাঝেমধ্যেই সেখানে যাই। সুজন মাঝি আমাদের গ্রামের সম্পর্কের দাদা—আমাদের যে কোনও অ্যাডভেঞ্চার যেন ওকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। দেখি বটগাছের নিচে বসে ঠিক লোকনাথ বাবার মতোই দেখতে একজন ভদ্রলোক। যার বয়স হতে পারে ১০০ আবার হতে পারে ৫০। এই অদ্ভুত ধরনের বৈপরীত্য কেন তার উত্তর আমি সঠিকভাবে দিতে পারব না। মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় বোধহয় সত্যি সত্যি ভদ্রলোকের মধ্যে দৈবিক কোন ক্ষমতা আছে। সুজনদাদা বলে , যাই বলো কিছু একটা মহিমা তো আছে। নয়তো এতগুলো লোক কেন পড়ে আছে! তবু তুমি রণভাইয়ের সাথে একবার কথা বল।

আমি আর বললাম না কোন ঘটনা ঘটার আগেই আমি কি করে রণদাকে বলি যে কিছু একটা গন্ডগোল আছে। তবে গন্ডগোলটা যে আছে সেটা আমি এখনও পর্যন্ত টের পাইনি। তবে রণদার সাথে থাকতে থাকতে এটা বুঝতে পারি যে এরকম সাধু সন্ন্যাসী এখন অনেক ছড়িয়ে পড়েছে। সেই যে সেবার আমরা শিবগ্রামে আশ্রমে গিয়েছিলাম, সেখানে আগত অতিথিরা নকল দাড়ি-গোঁফ পরে সাধু সেজে মঞ্চে বসে ছিল। ওভাবেই তারা বক্তৃতা রাখছিল। তাই সন্দেহটা একদম মন থেকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভাবলাম আজ রণদা কলেজ থেকে ফিরলে ওর সাথে কথা বলব।

ওকে বলার পর ও বলল, তোকে বারবার বলেছি অবজারভেশন করতে শেখ। আর সুজনদাদারও বলি হারি!; তোর মতন একটা বোকার হদ্দকে নিয়ে গেছে। চল একবার বেরোই।

এত রাতে কোথায় যাবে?

এমনি একটু হেঁটে আসব অনেকদিন নদীর পাড়ে যাওয়া হয়নি।

এখন বর্ষার সময় তুমি নৌকায় চেপে ঘুরতে যাবে।

দেখা যাক চল তুই এখন। সুজন মাঝির বাড়িতেও যাব।

সুজনদাদা আমাদের বাড়িতেই আসছিল। আমি তাকে আসতে বলেছিলাম। আসার পথেই আমাদের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমরা গিয়ে বসলাম নদীর পাড়ে। মাঝে মাঝে কোন কাজ না থাকলে আমরা তিনজন চুপচাপ নদীর পাড়ে বসে থাকি। গ্রামের অনেক মানুষই এই সময়টা এখানটায় এসে বসে থাকে চুপচাপ। এতে করে আমাদের মানসিক বিশ্রাম হয় অনেকটা। দেখলাম এই বর্ষার উত্তাল নদীতেও একটা শক্তিশালী নৌকা এসে ঘাটে ভিড়ল, তার থেকে নামল আমাদের গ্রামের হারুন কাকা।

সুজনদাদা জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গিয়েছিলে গো এই বর্ষার মধ্যে?

চন্ডীতলায়। সাধুজীর জন্য একটু ভোগ নিয়ে যাচ্ছি। ওনার ওষুধে, আমার নাতিটা ভালো হয়ে গেছে। তাই একটু দক্ষিণা দিয়ে আসছি।

আমি কিছু বললাম না কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, উপবাসী সাধুর জন্য এত কিছু যাচ্ছে। জানি না রণদাও এক কথা ভাবছে কিনা? হারুন কাকা বৈরাগীতলার দিকে মিলিয়ে যাওয়ার পর আমি আর থাকতে পারলাম না। বললাম, ব্যাপারটা একটুখানি অন্যরকম লাগছে না?

ও বলল, কোন ব্যাপার?

উপবাসী সাধুর জন্য এত কিছু ভোগ যাচ্ছে।

সে তো মাটির প্রতিমা উপবাসী। কোনদিন মাটির ঠাকুরকে এত কিছু খেতে দেখেছিস। তিনি নাকি অদৃশ্যভাবে এসে সবকিছু খেয়েই চলে যান। তারপর যে উচ্ছিষ্টকে পড়ে থাকে সেটা মায়া। ওটাই হল আসল ভোগ।

বুঝলাম আমার সাথে রসিকতা করছে। আর কোন কথা বললাম না। তবে কেন জানি না আমার মনে মনে বিশ্বাস হলো, আমার সাথে রসিকতা করলেও বিষয়টা নিয়ে ও ভাবছে। আমরা যখন ফিরছিলাম ও বলল তুই যা আমি একটু পরে আসছি। তখনই আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। সুজনদাদা আগেই চলে গেছে। ওকে যেতে দিলাম, আর এই প্রথম ওর অনুমতি ছাড়া ওর পিছন পিছন ওকে আমি ফলো করতে লাগলাম।

পরে আমরা জানতে পারলাম ভন্ড লোকনাথ বাবার অবতারের আগের নাম ছিল সুবিমল। সুবিমল, যাকে আমাদের গ্রামে সবাই লোকনাথ বাবার অবতার বলে জানত, সে আদতে ছত্রিশগড়ের এক উচ্চশিক্ষিত যুবক। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এই ব্যক্তি বহুদিন ধরে বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়ে, ধর্মীয় আবরণে প্রতারণার জাল বিছিয়ে রেখেছিল। সে জানত, ভারতীয় গ্রাম্যসমাজে এখনও কুসংস্কার আর অলৌকিক বিশ্বাস কতটা গেঁথে আছে। সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে সে কখনও কালীসাধক, কখনও শিবভক্ত, আর কোথাও বা লোকনাথের অবতার সেজে অসহায় ও সরল মানুষদের ঠকিয়ে বেড়াত। বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ বহুবার তাকে খুঁজেছে, কিন্তু প্রতিবারই ছদ্মবেশে পালিয়ে যেতে পেরেছে। এবার বাংলার এক গ্রামে এসে তার প্রতারণার পর্দা ফাঁস হল—দুজন কিশোর আর এক সৎ পুলিশ আধিকারিকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে।

দুদিন পর একটু আকাশ পরিস্কার থাকায় সুজন মাঝি নৌকা চড়ে আমরা তিনজনে বেরোলাম। রণদাকে অনেকদিন ধরে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম সেটা এখন করে ফেললাম। বললাম, তুমি কি আগে থেকে সবকিছু জানতে? সেই কারণে কি তুমি চুপচাপ ছিলে?

ও হেসে বলল, জানতাম তো বটেই। তবে এই কেসটা সমাধান করার জন্য তোর কৃতিত্ব অনেকটাই। তাই মূল ক্রেডিটটা কিন্তু তোকেই দিতে হবে। ছোট বাচ্চারাও যে আজকাল সচেতন হচ্ছে তোর এই সাহসিকতা থেকে তা বোঝা যায়।

আমার সত্যিই গর্ব হল। এর আগে রণদা আমার এত প্রশংসা কোনদিন করেছে বলে মনে পড়ে না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *