অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে)

(দশ)

অনন্যা ফেরার প্রায় ঘন্টা তিনেক পরে অনিমিখ বাড়ি ফিরল। রাত তখন দশটার কাঁটা অতিক্রম করে গেছে। অনন্যা দেখল, অনিমিখ কিছুটা গম্ভীর। বেশ খানিক মদ গিলেছে, এই সময় সে কিছুক্ষণ গম্ভীর থাকে। অনন্যা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও অনিমিখের দিকে খেয়াল রাখছিল। অনেকক্ষণ পরেও অনিমিখ যখন নিজের থেকে কিছুই বলল না, তখন অনন্যা জিজ্ঞাসা করল, অ্যাডভোকেট রায়ের সঙ্গে দ্যাখা করেছিলে?’
অনিমিখ ছোট্ট উত্তর দিল, ‘না। যাইনি।’
অনন্যা বলল, ‘ও, আচ্ছা।’
তারপর অনেকক্ষণ কেটে গেল, অনিমিখ নিশ্চুপ। অনন্যা আবার বলল, ‘তাহলে কি আগামীকাল যাবে?’
-‘না।’ অনিমিখ জানালো।
-‘কেন? তবে, ফোনে বলবে?’
-‘না।’
-‘কী ব্যাপার বলো তো? তখন থেকে শুধু না, না করে যাচ্ছ! আজ দুপুরেই তো বললে, আজকেই নাকি দ্যাখা করতে যাবে, এখন বলছ, আজকে যাও নি, বেশ ভালো কথা। কিন্তু কালকেও যাবে না, ফোনেও কথা বলবে না! তাহলে অন্য কাউকে রিক্রুট করার কথা ভাবছ নাকি?’
-‘না।’
-‘ধ্যাৎ! সব কিছুতে শুধু শুধু না, না করে যাচ্ছ কেন? কী হয়েছে ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
এতক্ষণ পরে অনিমিখ অনন্যার দিকে তাকিয়ে পরিস্কারভাব বলল, ‘শোনো, আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম ছেলেটির বাবার হাত বেশ লম্বা। এদের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না। তাছাড়া তুমি একটা স্কুলে চাকরি করছ, এদের খোঁচাতে গেলে এরা তোমার এমন পেছনে লাগবে যে, তোমাকে চাকরি বাগরি ছেড়েছুড়ে বাড়িতে বসে থাকতে হবে। তাই ওই পথ না মারানোই ভালো। খোঁচালে আরো তোমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে।’
অনন্যা বেশ কিছুটা হতভম্ভের মতো অনিমিখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘মানেটা কী? ছেলেটাকে ছেড়ে দেবো বলছ?’
-‘হুমম। তাছাড়া আর উপায় কী? ছেলেটির বাবার অর্থবল, রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অত্যন্ত বেশি। আমরা এঁটে উঠতে পারব না। কোর্টে কেস উঠলে ওদের উকিল তোমার চরিত্র নিয়ে এমন টানাটানি করবে, তুমি একেবারে নাকানি চোবানি খেয়ে যাবে।’
-‘খেলে খাব। তখন দ্যাখা যাবে। কিন্তু তাই বলে কিছু না করে ছেড়ে দেব? অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে না! এটা আমি ভাবতেই পারছি না।’
-কোর্টে কখনও গেছ? ওখানে কী হয়, তার কোনও ধারনা আছে?’
-‘না। যাবার প্রয়োজন হয়নি। তাই কোনও ধারনাও নেই।’
-‘তাই তো বলছি, অনেক চিন্তাভাবনা করেই বলছি। ওদের পেছনে লাগতে যেও না, আরও বিপদে পড়ে যাবে।’
অনন্যা বলল, ‘যা হয় হবে, তবুও আমি শেষ দেখেই ছাড়ব।’ বলে আর কোনও কথা না বাড়িয়ে, অন্য ঘরে চলে গেল।
অনিমিখ গলাটা একটু চড়িয়ে বলল, ‘কথা না শুনলে যা করবে নিজের দায়িত্বে করবে। আমাকে জড়াবে না।’
অনিমিখের আচরণ অনন্যার কাছে বরাবরই অদ্ভুত ঠেকে, এবারও তার ব্যতিক্রম হ’ল না। অনন্যা চুপচাপ বসে রইল। রাত এগারোটা দশ। একবার জয়িদিকে ফোন করার দরকার। বিকেলে একবার ফোন করে তার ফিরে আসার সংবাদ জানিয়েছে। কিন্তু অনিমিখ যদি এভাবে পিছিয়ে যায়, তাহলে পাশে তো কাউকে দরকার। সেক্ষেত্রে জয়িদি ছাড়া আর কাউকেই তার তেমন নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় না।
একটু কিন্তু কিন্তু করেও রাত এগারোটা বারো মিনিট নাগাদ অনন্যা জয়িতা সেনকে ফোনে সব ঘটনাটা জানাল। জয়িতা সেন বললেন, ‘তুই একদম ভেঙে পড়িস না। তোর জয়িদি সবসময় তোর পাশে আছে। আমি কাল সকালেই তুষারকে দিয়ে অনিমিখকে বোঝানোর চেষ্টা করব। ও যদি রাজি হয় ভালো, না হলে আমরা তো তোর পাশে থাকলামই বোন। আইনি পথে হাঁটার জন্য সমস্ত সহযোগিতা তুই আমদের কাছে পাবি। এখন ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা কর।’
জয়িতাকে ফোন করে অনন্যার নিজেকে কিছুটা হালকা লাগল। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত যে, তুষারদা যদি মিরাকল কিছু না ঘটাতে পারে, তাহলে অনিমিখের সাহায্য সে আর বিশেষ পাবে না, এটা তার বুঝতে বাকি নেই। তাও এর শেষ দেখা উচিত। অন্তত একটা কিছু বিহিত না হওয়া অবধি, তার শান্তি নেই। এইভাবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া তারপক্ষে কখনই সম্ভব নয়।
পরের দিন সকালেই অনিমিখের কাছে তুষার সেনের ফোন এসেছিল। মোবাইল স্ক্রিনে নামটা দেখে, কিছুটা অবাক হয়ে অনিমিখ স্বগতোক্তি করল, ‘ হঠাৎ তুষার সেন কেন?’ বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে অনিনিখ ফোনটা অ্যাটেন্ড করল। আপন মনেই ভাবল, হয়ত অনন্যার ফোন সুইচট অফ আছে, তাই তাকে ফোন করেছেন তুষার সেন।
অনিমিখ বলল, ‘বলুন তুষার দা, এই দুঃসময়ে কেমন আছেন?’
জবাবে তুষার সেন বললেন, ‘চলছে মশাই। তা আপনাদের কী খবর?’
-‘ওই, কেটে যাচ্ছে। অনন্যাকে দিচ্ছি, দাদা। কথা বলুন।’
-‘আরে না, না! ওকে দরকার নেই। আপনার সঙ্গেই দরকারটা ছিল।’
-‘আমার সঙ্গে দরকার!’ অনিমিখ এবার বিস্ময়টা প্রকাশই করে ফেলল।
তুষার সেন হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ। দরকারটা আপনার সঙ্গেই ছিল।’
-‘বেশ। বলুন।’
তুষার সেন কোনও ভূমিকা না করেই অনন্যাকে আইনি সাপোর্ট দেবার জন্য অনিমিখকে অনুরোধ করলেন। অনিমিখ প্রথমে বেশ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তুষার সেনকে তার পয়েন্টগুলো বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু যুক্তিতে না পেরে, খানিক বিরক্তির সঙ্গেই সে তুষার সেনকে বলল, ‘তুষার দা, এটা আমদের একান্তই ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ব্যাপার। আপনি বা জয়িতাদি আমাদের পারিবারিক বন্ধু, সেই সুবাদে আপনাদের জানিয়ে রাখি, আমি কোনও আইনি জটিলতায় যেতে অনিচ্ছুক। সৌমাল্য নামে ওই যে ছেলেটি কালপ্রিট, তার বাবার মস্ত হাত। ওদের সঙ্গে পারা যাবে না। ফলত অকারণ বেইজ্জত হবার ইচ্ছা আমার নেই। এই ব্যাপারে আপনি আমাকে আর কোনও রিকোয়েস্ট করবেন না, প্লিজ।’ তুষার সেন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, অনিমিখ সেই সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘অফিসের একটা আর্জেন্ট কাজ করছি দাদা। এখন রাখি। পরে কথা হবে।’ বলেই মোবাইল ডিসকানেকট করে দিল।
খবরটা অনন্যার কানে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছলেও এতে সে খুব একটা আশ্চর্য হ’ল না। এই ফল যেন তার প্রত্যাশিতই ছিল। জয়িতাকে সে বলল, ‘ভালো কোনও একটা অ্যাডভোকেটের পরামর্শ নিলে কেমন হয় দিদি? সেইমতো আমরা এগোতে পারব। কী বলো?’
-‘ঠিক আছে। আমি খোঁজ নিয়ে তোকে জানাচ্ছি। এখানে তো রায়ের পসার সব থেকে ভালো। ওঁকেই মিট করি?’
-‘না। উনি অনিমিখের খুব ঘনিষ্ট। ওকে বাদ দাও।’
-‘প্রফেশনের সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার কী সম্পর্ক? আচ্ছা তাও দেখছি, রায় হাতে থাক। অন্য কারোর সন্ধান নিয়েও তোকে জানাচ্ছি।’
-‘আচ্ছা।’
এই কটা মাসের অনিদ্রা চাপা টেনশন ইত্যাদিতে অনন্যা ভেতরে ভেতরে শরীরে ও মনে খুব ক্লান্ত হয়ে পিড়েছিল। হয়ত সেইজন্য নিজের প্রিয় শয্যাকে এতদিন পর কাছে পেয়ে আজ সারাদিন অনন্যার ঘুমের ঘোরেই কেটে গেল। কেমন যেন একটা দুর্বলতা, একটা অলসতা তার শরীরকে গ্রাস করে রেখে দিল। অনিমিখও তার কাছে আসেনি। মেঘলা আকাশের খেলা আজ আর সে কিছুই টের পেল না। অন্যদিন হলে এই মেঘলাচ্ছন্ন আকাশ তার মনকে তোলপাড় করে তুলত। মেঘলা দিন তার ভীষণ পছন্দের। আজ সারাদিনই আকাশটা অদ্ভুত রকমের মেঘলা থাকল। মাঝে মাঝে পড়ল ঝিরঝির করে ইলশেগুঁড়ি।
সকাল থেকে ঈশান আর নৈঋতের এই কালো মেঘাচ্ছন্নভাব চর্মচক্ষে দৃষ্টিগাহ্য কিন্তু তার থেকেও বড় মেঘ অনন্যার মনের মধ্যে জমে আছে। আকাশের বুক চিরে মেঘেরা পৃথিবীতে বৃষ্টি হয়ে সহজেই নামাতে পারে, কিন্তু বুকের মাঝে জমে থাকা মেঘ, সহজে বৃষ্টি হতে পারে না। হৃদয় উত্তাল হয়ে সেই মেঘকে বহন করে নিয়ে বেড়ায়। সেই মেঘের আভিধানিক নাম হতে পারে অভিমান। কিন্তু অনন্যার জীবনে সেই অভিমানগুলো জমাট বাঁধতে বাঁধতে এই ছ’বছরে মনের অন্দরে একটা মেঘ পাহাড়ের জন্ম নিয়েছে। সেই পাহাড়ের সন্ধান একমাত্র অনন্যা নিজেই জানে, নিজেই বহন করে। তার আকাশে মেঘের ঘনঘটা অহরহ সূর্য গ্রহণ ঘটায়। এখানে চাঁদের ভূমিকা একেবারেই নিরর্থক, অস্তিত্ব বিহীন।
ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *