সম্পাদকীয়।

আষাঢ় মাস এ বছর একেবারে জাঁকিয়ে এসেছে । দু হাজার একুশের পর এই বছর দু হাজার পঁচিশে আবার এমন বাদলধারা দেখল এ শহর । তা, আষাঢ় মাস হল গল্পের মাস । বৃষ্টি, জল জমা, কাজ ফেরতা জানজটে নাকাল, ভেজা কাপড়ের স্যাঁতস্যাঁতে গলাগলি , এ সব কিছুর পর এমন কেউ নেই যার প্রচুর দাঁত কিড়মিড় করার পরেও কলেজবেলার বা ইসকুলবেলার একটা বাদলদিন মনে পড়ে না । তাই পাঠকদের জন্য রইল এমন একটা দিনের কথা ।
সেদিনটা ছিল ঘনঘোর বর্ষার দিন । সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার । খানিক বেলা বাড়তেই টিপ, টিপ বদলে গেল অঝোর ধারায় । কলেজের উঁচু ক্লাসঘরের বিশাল কাঁচের জানলা দিয়ে দৃষ্টি ভেসে যাচ্ছিল বৃষ্টির সাথে ।
আমাদের তখন বাংলা ক্লাস । বাংলার শিক্ষিকা রাশভারী । সিলেবাসের বাইরে কখনো কথা বলেন না । সেদিন ক্লাসে ঢুকে ওনার দৃষ্টিও কেমন জানলা দিয়ে বাইরে ভেসে গেল । তিনি বই সরিয়ে রাখলেন । বললেন ‘বর্ষার কোন রাগের নাম জান তোমরা ? কে কে গান শেখ? ‘ আমরা তো অবাক । বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা হলেও আমরা বাংলা বিষয়টিকে এড়িয়ে চলি সকলে । বানান নিয়ে গলদ্ঘর্ম দশা হয় , তার উপরে আমাদের বাংলার শিক্ষিকাকে আমরা বেশ ভয় পাই ওনার প্রখর ব্যাক্তিত্বের কারনে । সেই বাংলার ম্যাডাম আজ একি প্রশ্ন করছেন । আমরা কেউ কিছু বলছি না দেখে উনিই বললেন ‘বর্ষার রাগ মেঘমল্লার । এমন দিনে কেন মেঘমল্লার গাওয়া হয় কোনদিন ভেবেছ ? ‘ আমরা যথারীতি নীরব । উনি বলে চলেন “মানুষ যখন প্রথম নিজের ভাষার নিয়ে সচেতন হয় , তখন সে ভাবে পাখীর ভোরের গান একরকম , বৃষ্টি নামলে সে একরকম ভাবে ডাকে । তাহলে আমারাই বা কেন নিজেদের সুর সৃষ্টি করতে পারব না? এইভাবেই মেঘের আওয়াজ আর বৃষ্টির শব্দ মিলিয়ে তৈরি হল মেঘমল্লার ‘। সেদিন গানের ভাষা সম্পর্কে আমাদের এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল । আর সেই শিক্ষিকা যার বিষয়কে আমরা এড়িয়ে চলেছি তিনি গলা খুলে গাইলেন মেঘমল্লারে ‘কাহা সে আয়ে বদরা, ঘুলতা যায়ে কাজরা’ কোনদিন এ গান শুনি নি আমরা । চোখ বুজে উনি গেয়ে চললেন , আর আমাদের মনে হল বৃষ্টির সুর যেন আমাদের মনের ভিতরে অঝোর ধারায় ঝরে পড়ছে । তারপর থেকে আমরা ঋতু মিলিয়ে গান গাইতে, শুনতে শিখলাম । এই বিরল ঘটনা আমাদের বাংলা ম্যাডামের মনের সুচারু দিকটি চিনতে পারলাম আর গানকে পেলাম পরম বন্ধু হিসেবে, যে আমাদের সুখদুঃখের সাথী হল আজীবনের ।
ইন্দ্রানী ঘোষ।