কবিতায় গীতালি ঘোষ

জটিল সে জীবন
বসুন্ধরা গ্রাস করেছে তোমার রথচক্র?
তুমি আর্তস্বরে তৃতীয় পাণ্ডবকে
মিনতি করছ?
সময় চেয়ে নিচ্ছ তুমি, কর্ণ?
অর্জুন-সারথি কৃষ্ণের দিকে চেয়ে রয়েছ?
দৃষ্টিতে তোমার বিপন্নতা!
তুমিও তবে প্রাণভয়ে ভীত হও?…
আজ এই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে
তোমার নানাবিধ কর্মের কথা,
একবারও মনে পড়ছে না, কর্ণ?
কত শত অন্যায় করেছ তুমি,
সে সমস্তকিছুর হিসেব করে দেখ!
তোমার জন্মক্ষণে যে অভিসম্পাতের
ছায়া পড়েছিল,
তাকেই তুমি সদা বহন করেছ।
তোমার কুমারী মাতা
তোমাকে পেটিকায় সুসজ্জিত করে
ভাসিয়ে দিয়েছিলেন অশ্বনদীর জলে।
লোকলজ্জার আশঙ্কায় মাতা কুন্তী
ছিলেন অনন্যোপায়।
কত মনোকষ্ট নিয়ে তাকে
করতে হয়েছিল এই অমানবিকতা,
কখনও ভেবেছ কী?
তারও চেয়ে বড়…
তোমাকে কখনও মাতৃ-অভাব
অনুভব করতে হয় নি যে!
ভেবেছ সে কথা?
পেটিকা ভেসেছে অশ্বনদীতে,
গঙ্গানদীর বুকে ভেসে–
অধিরথ-পত্নী রাধার কাছে এসেছিলে।
তুমি, কর্ণ, মাতৃত্বের অপার স্নেহে
পালিত হলে।
পিতামাতার পরম যত্নে কেটেছে
তোমার শৈশব-কৈশোর-যৌবন।
যা তোমার প্রাপ্তি হয়েছে
তা তো তুচ্ছ নয়,
বরং তা রঙিন আনন্দে পরিপূর্ণ!
শাস্ত্রপাঠ, শস্ত্রশিক্ষায়
তুমি হয়ে উঠেছিলে
এক পরিপূর্ণ যোদ্ধা,
এবং অবশ্যই
শিক্ষায় দীক্ষায় অনবদ্য!
বহু গুণে গুণান্বিত ছিলে তুমি।
কিন্তু আত্ম-অহংকারের দীনতায়
তুমি এক অন্য মানুষ!
জীবনের প্রথম ধাক্কায়
তোমার অনৃতভাষণ,
তোমার সুকৌশলী চতুরতায়
অস্ত্রশিক্ষার প্রাঙ্গণে
তুমি বহির্গত হয়েছ বারংবার।
গুরুকুলের কাছে ব্রাত্য হয়েছ
বারবার!
দুর্যোধনের আনুকূল্যে
অঙ্গরাজের রাজারূপে তুমি
অধিষ্ঠান করেছ।
তাই, আজীবন সেই রাজ্যলোভী
কুরুরাজপুত্রের সহায় হয়েছ তুমি, কর্ণ।
তার প্রতিটি দুষ্কর্মের সাথী ছিলে তুমি।
অর্জুনের প্রতি ঈর্ষায়
তোমার মন ছিল কুটিলতায় আবিল।
তার নম্রতা, তার সতেজ ভয়হীনতা,
তার বহু-মূল্য জীবনবোধ,
তার গুরুভক্তি, তার উদাসীনতা এবং
সর্বোপরি তার মানবিকতা…
এইসব গুণের সমাহার
কোনোদিন আয়ত্ব করার চেষ্টা করেছ?
শুধুমাত্র অর্জুনের বিশালকায়
স্বভাবজ যোদ্ধৃত্বকে ঈর্ষা করেছ।
তার সমকক্ষ ধনুর্ধর হতে চেয়েও
তার গুণে মুগ্ধ হতে পারোনি।
এমন কি, মাতা কুন্তীকে তুমি
অঙ্গীকার করেছিলে
অর্জুন ব্যতীত, সকল পাণ্ডবই
তোমার অবধ্য হবে…
তখন, তোমার প্রাণপ্রিয় সখা দুর্যোধনকে
কী বঞ্চনা করনি তুমি?
সে তো তোমার বিমুগ্ধ ভক্ত ছিল।
তার মনের মাঝে সতত বিশ্বাস ছিল,
পাণ্ডবকুল কর্ণের বিধ্বংসী বাণে
ধ্বংস হবে অনায়াসে।
ভীমের সঙ্গে পরাক্রমী যুদ্ধে
কর্ণ, তুমি তাকে বধ করনি!
এ কি তোমার বন্ধুর প্রতি
বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
এ কেমন কৃতজ্ঞতা?
কোনো যুদ্ধ তুমি জয় করনি,
যা অর্জুন অনায়াসে করেছে।
দ্রুপদ রাজ অথবা গন্ধর্ব চিত্রসেন…
প্রতিটি যুদ্ধে তুমি ছিলে বিফল।
তবুও অর্জুন হতে চেয়েছ তুমি?
পাণ্ডব বধূ দ্রৌপদীর অবমাননায়
তুমি ছিলে অন্যতম পথপ্রদর্শক।
ভরা সভায় তাকে গণিকা বলেছ
তুমি, কর্ণ!
তাকে নগ্ন করার পরামর্শও ছিল তোমার!
তুমি না শিক্ষিত?
এই কি তোমার সাজে কর্ণ?
কুরুক্ষেত্রের মহা যুদ্ধে
সপ্তরথীর মাঝে
একা কিশোর অভিমন্যু-বধেও
তুমি ছিলে অন্যতম।
বিবেকে লাগেনি তোমার?
সপ্তরথীর মাঝে একলা কিশোর…
কেমন করে বাঁচে সে?
এমনই আরও দুষ্কর্ম তোমার দ্বারা
সংঘটিত হয়েছে।
তোমার পিতামাতা
অধিরথ-রাধা, তোমার কাছে
সর্বদাই সম্মানীয়।
কিন্তু সূত-পুত্র রূপটি
তোমাকে বিব্রত করেছে
বারবার।
সেই সূত্রে তুমি
আপনাকে বঞ্চিত ভেবেছ
সর্বক্ষেত্রে।
আজ মৃত্যুর দ্বারদেশে,
তোমার ঔচিত্যবোধ
এত প্রবল কেন?
বহু গুণে গুণান্বিত হয়েও
তুমি, কর্ণ, আজ
মৃত্যুভয়ে ভীত?
মনে করে দেখ আজ,
জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে,
তোমার সমগ্র জীবনচিত্রটি!
বহু ভুলে ভরা,
আত্ম অহংকারের জ্বালায় দীপ্তমান
এক সম্ভাব্য মহাজীবনের অবসান
হবে আজ
অর্জুনের আঞ্জলিক বাণে…
প্রস্তুত হও, কর্ণ!!