হৈচৈ ছোটদের গল্পে অংশুদেব

নিজস্ব শিকড়

বাবা বলতেন – আমাদের কারো পুনর্জন্ম হয় না, আমরা বেঁচে থাকি তোমাদের মধ্যে , তোমাদের মধ্যে আমাদের জন্ম । তোমাদের মধ্যে দিয়েই আমার জগত উপভোগ করি — সকল পিতা ঘুমিয়ে আছে সব শিশুরই অন্তরে । ছোটবেলার কবিতা । বাবা বোঝাতেন। বাইরে এখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। লোডশেডিং, দোতলার কাঁচ ঘেরা বারান্দায় একা বসে বসে গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার মধুর সঙ্গীত শুনছি– মন মোর মেঘের সঙ্গী , উড়ে চলে দিগ দিগন্তের পানে… আহা ! এই বর্ষা কেন যে আমাকে এমন মাতাল করে!
আমাদের ছোটবেলায় বর্ষার রাতটা বড্ড তাড়াতাড়ি গভীর হয়ে যেতো। এখনকার মতো তখন শৌখিন বৃষ্টি হতো না। সারাদিন বৃষ্টি দিয়ে হতো না,সন্ধে থেকে গদগদিয়ে পড়েই চলেছে। সন্ধে হলে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে সব ভাইবোন উচ্চৈঃস্বরে নামাজ পড়ার প্রতিযোগিতা চলতো । প্রধান কারণ স্কুলের পড়া করা নয় , অন্যের বাড়ির ছেলেমেয়েদের বকুনি খাওয়ানো। এতো পড়ার পরও কথা শুনতে হতো। পাড়ায় অন্য বাড়ির ছেলেমেয়েরা ভোরে উঠে চেঁচিয়ে পাড়া জাগাতো । আমাদের আর রেহাই থাকতো? মা কিম্বা বাবা বিছানায় শুয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিতেন ।
গ্রামের দিকে একটা ঘর আর চারপাশের বারান্দা নিয়ে একটা বাড়ি । মা বাবা ঘরে থাকতেন। ঠাকুরদা ঠাকুমা বা দাদু দিদিমা, কাকা,পিসিরা দাবায় বিছানা পাতে – প্রায় সব বাড়িতে এই রকম । বাড়ির ছোটদের জন্মগত অধিকার মা বাবার কাছে থাকার। বড় ভাই ও বোনেরা প্রধানত ঠাকুমার কাছে শোয়। তাছাড়া কেউ কেউ পিসির কাছে । ঠাকুরদা বা কাকার কাছে শুয়ে সুখ নেই । বাবার মতো ভোরে ডেকে তুলবেই। রাতে শান্তি নেই পড়তে হবে।
বর্ষার দিনগুলোতে সন্ধে থেকে বৃষ্টি নামলে একটা সুবিধা ছিলো ,পরের বাড়ির উপদ্রব এ বাড়িতে এসে পৌঁছাতো না। ফলে সকাল সকাল বিছানায় যাবার সৌভাগ্য জুটে যেতো । বর্ষাকালের শীত শীত আমেজে বিছানায় ঢুকে পড়ে ভূতের গল্প শোনার মজাই আলাদা। আর সেই লোভে ছোটরাও আগে থেকে বিছানায় দখল নিতো।
ছোটবেলায় এই বিছানা দখল নেওয়া, তাড়াতাড়ি শুতে যাওয়া, ভোরে উঠেও ঘুমানোর সুবিধা ভোগের জন্য একটু বুদ্ধি খরচ করতে হতো। বাড়ির কর্তার মন রক্ষা করে চলতে হয়। সাধারণত বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে লেখাপড়ার তদারকি করতেন। অফিসে বের হবার আগে পর্যন্ত কড়া নজর থাকে। তারপর তো স্বাধীন যুদ্ধক্ষেত্র, যেমন ইচ্ছে তেমন। আমাদের বাড়িতে আমার সমস্ত চালাকি ধরে ফেলতো একমাত্র মা । আমার নামেই যতো অভিযোগ । কিন্তু আমি তো জানতাম বাবা কি কি জানতে চাইবেন – অংক করেছো ? ইংরেজি ট্রান্সলেশন করেছো? বাংলা কবিতা মুখস্থ করেছো ? অংক আর ট্রান্সলেশন স্কুলে ক্লাস চলাকালে সেরে ফেলতাম। আর সন্ধে পড়তে বসেই কবিতাটা মুখস্থ করে নিতাম। স্কুলের পড়াগুলো কোনো ভাবে , অংকে বাড়িতেই এগিয়ে থাকতাম। নইলে স্কুলে বদনাম হয়ে যাবে। এরপর বদমায়েশি। হ্যারিকেনের সলতে ফেলে দেওয়া, অন্যের বইয়ের ওপর অন্ধকার করে দেওয়া, পোকা ধরে জামার মধ্যে সাবধানে ঢুকিয়ে দেওয়া, বই খাতা লুকিয়ে রাখা, নয়তো এত জোরে পড়া যাতে অন্যজন অসহ্য হয়ে যায় । এরজন্য বাঁধা ধরা একটা শাস্তি বরাদ্ধ ছিল, মাঝে মাঝে গুরুতর শাস্তিও কপালে জুটে যেতো। গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, কাঠ পেটাও জুটতো । বেশিরভাগ দিন চুলের মুঠি ধরে পিঠে চড়,চাপড়,কিল এটা সান্ধ্যকালীন জলখাবার।
আর অন্য সময় আমার জন্য আঙচিত্রের লতানে ডাল ছিল বাঁধা ধরা। সকলের খেলা ভুণ্ডুল করা , নয়তো খেলার ছলে জোরে মেরে দেওয়া, কিম্বা বনে বাদাড়ে শিয়াল বা বেঁজির গর্ত খোঁজা ,নয়তো পাখির বাসা থেকে পাখির বাচ্ছা পেড়ে আনা । কোনো কোনো দিন খেলতে খেলতে বেপাড়ায় চলে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলতাম । তার পুরষ্কার কি সামান্য হওয়া উচিত? স্কুল না থাকলে দু তিন দিন আমার দুপুরে খাওয়া জুটতো না। খেলতে খেলতে বেলা ভুলে যেতাম। সন্ধ্যায় দিদিমার ধৃষ্টতায় বাড়িতে প্রবেশ ঘটতো দু চার ঘা নারকেল গামড়ার কড়া বরণে । আমরা মামার বাড়িতে মানুষ। দিদিমা ছিল আমাদের অগতির গতি। মায়ের বিপুল আক্রমণ থেকে আমেরিকার ট্রাম্পের মতো রক্ষা করতেন। আবার মাঝে মধ্যে ট্রাম্পের মতো পিটুনিও খাওয়াতেন।
সেদিন সারাদিন দিন বৃষ্টি। সন্ধের পরেই দিদিমার বিছানা যাত্রা। সন্ধ্যার অনেক আগে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মাথার পোকা কি দেরিতে কিলবিলিয়ে উঠবে ? তার জন্য তাড়াতাড়ি মার অপেক্ষা বেশি কান্নাকাটি করে দিদিমার আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলাম। দাদা ও বোন পাশ দাবায় পড়ছিল। বাবা বাড়ি ফিরতে উঠতে হলো । দাবি মিটিয়ে বোনকে ভেঁঙচি কেটে ফিরে আসার সময় আবার অভিযোগ। বোনের ছিঁচকাঁদুনে অভিযোগ পড়াশোনায় সাময়িক বিরতি। খেতে দিতে দিতে মা বললেন, তুমি এটাকে কোথায় দিয়ে আসবে দিয়ে এসো । এ থাকলে কারো পড়াশোনা হবে না।
বাবা বললেন, দেখি — একটা কিছু –
বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। আমি ভাবলাম এই সেই একই ভয় দেখানো। বাবার কথায় আমার বিশেষ মনখারাপ হলো না। বছর খানেক ধরে ভয় দেখাচ্ছেন, বোর্ডিং-এ পাঠিয়ে দেবেন । আগের অনেক ক’বারের মতো এবারটাও । বোর্ডিংয়ে পাঠাবার অনেক কারণ কাজ করতো — আমার বদমায়েশিটা প্রধান ছিল না। প্রধানটা ছিল তিন ভাই বোনের চাপ । দাদা প্রথম সন্তান,বোন একমাত্র মেয়ে। আমি মধ্যম। একজনের চাপ কমাতে পারলে ভালো হতো। অসুবিধা হচ্ছিল বোর্ডিংয়ে দেবার খরচ নিয়ে । বাবার যা ইনকাম,সাহস করতে পারছিলেন না। তাই খুঁজছিলেন ফ্রিতে যদি কোনো আশ্রমে পাঠানো যায় । জুটেও গেল একটা অনাথ আশ্রম। যাইহোক আমার শুয়ে পড়ার অনুমতি মিলে ছিল। কেন মিলে ছিল পরে জানতে পেরেছিলাম।
শুয়ে পড়লেও বদমায়েশিটা তো আগে থেকেই ঠিক করা ছিল । দাদা চার বছরের বড় । ওর বিছানাটা আমাদের মাথার ধারে । ওকে রাত পর্যন্ত পড়তে হতো। তাই একা শুতো। খেয়ে ওঠা থেকে শুতে যাবার মধ্যে দাদাকে ভয় দেখানোর ব্যবস্থা ঠিক সেরে ফেলেছিলাম। একটা কৌটো ফুটো করে তার ভেতর তেলঢালার সরু দিকটা ঢুকিয়ে তার সঙ্গে একটা লম্বা তেলের পাইপ যুক্ত করে নিয়ে ছিলাম। তেলের কাঁপার ভেতর নারকেল পাতা ভাঁজ করে এমনভাবে লাগিয়ে ছিলাম যে কৌটোতে ছোট্ট শব্দ করলে অন্য প্রান্তে বিশ্রী শব্দ বের হবে । পাইপটা বিছানার নিচ দিয়ে এমনভাবে পেতে লুকিয়ে রেখে ছিলাম যাতে তা কারো চোখে না পড়ে। অন্য প্রান্তে আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলাম।
রাতে সবাই শুয়ে পড়লেও দাদা হ্যারিকেন জ্বেলে পড়ছিল। বাইরে তখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে কটকি ব্যাঙ ও চিংড়ি পোকাদের মধ্যে সুখ দুঃখের গানালাপ শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির ছাট থেকে রেহাই পাবার জন্য বারান্দায় চটের পর্দা ঝোলানো ছিলো। ফলে অন্ধকারটা আরও ঘন । আমি দুবার কৌটোর শব্দ করতে দাদা ভয় পেয়ে পেছন দিকে দেখতে থাকলো । সেই সময় উঠোনের পুবদিকে ঘাটের কাছে খটাস ( বুনো বিড়াল) দু বার ডেকে উঠল — মাফ্… মাফ্… । ডাকটা বেশ জোরেই রাতে শোনায়। পাশের পাড়ায় ডাকলে এ পাড়ায় শিশুরা ভয় পেতো ।
দাদা আমাদের মাথার দিকে সরে এসে ভয়ে ভয়ে ডাকলো — ও দিদিমা ?
দিদিমা ঠিক ঘুমাতো না। আধা ঘুমে উত্তর দিলেন — ভয় নেই ,পড়। এখানে আসবে না।
দাদা আবার পড়া শুরু করলো আরও একটু জোরেই। তারপর আর কোনো শব্দ নেই অনেকক্ষণ। আমি দ্বিতীয়বার ভয় দেখাতে নাকি সুরে একটু জোরে শব্দ করা শুরু করেছি আর খটাসটাও দাদার কাছে দাবার নিচে এসে ডাকলো — মাফ্….মাফ্… । প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দাদা ” আঁ … আঁ ” করে আমাদের ওপর লাফিয়ে পড়েছে। আর সেই হঠাৎ আতঙ্কে দাদার সঙ্গে আমিও কৌটো মুখে “আঁ … আঁ …. আঁ ” করে উঠতে এমন বিকট শব্দ হলো যে মা বাবা দিদিমা সকলে জেগে উঠলো । ” কি হয়েছে”,”কি হয়েছে”, “ভয় নেই ” ” কিচ্ছু হবে না” জাতীয় নানাবিধ শব্দের বিষক্রিয়ায় আশপাশের বাড়ি থেকে লোক ছুটে এলো । আমার কৌটো বের হয়ে পড়তে মা বলতে থাকলেন — এই শয়তান ওকে ভয় দেখিয়েছে। আমি কৌটো মুখের শব্দ পেয়েছি।
দাদা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো — মাফ্ !
এইভাবে দাবির পিঠে দাবি, এত রাত পর্যন্ত পড়ে কি হবে , পড়া দেখাচ্ছে, বিদ্বান হবে। নানান বিদ্রুপ । আমাদের চারপাশে লেখাপড়া অপেক্ষা মদ ,তাড়ি, মারামারি, গালাগালি বেশি পছন্দের বিষয়।
নানান কথার মধ্যে দাদার ছুটি হয়ে গেলো। ও এসে আমাদের বিছানায় শুয়ে পড়লো। আমিও ভয় দেখাতে গিয়ে যে ভয় পেয়েছি এটা মিথ্যা ছিলো না । মা ঠিক ধরতে পেরেছিলেন । উনি কোনো ভাবে ছাড়তে রাজি নন । দু চার ঘা চমচম , লাড্ডু দেবার খুব ইচ্ছে ছিলেন — ও তো শুয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ । তাহলে ভয় পেল কেন?
বাবা আমাকে বিশেষ মারতেন না। তাই সেই রাতে আর আদর আপ্যায়ন জুটলো না। সকালে উঠে অন্যদিনের মতো পড়তে বসলাম। বাবা এদিন দাদাকে পড়া দিলেন। আমাকে পড়া তো দিলেনই না, কথাও বললেন না । আমার একটু খারাপ লাগলো। বাবা আগের দিনও পড়া ধরেন নি ! তিনি বেরিয়ে গেলে মায়ের হাতে পড়ার একটা চান্স ছিলো । মা সত্যি মিথ্যা যাচাই ঠিক করবেন। আমি মার কাছে কখনো মিথ্যা বলতাম না । আগের রাতে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।তাই নিয়ে চিন্তা ছিলো। না , বকা বা মার জুটল না !
মা ও দিদিমার মুখে হাসি নেই । দুপুরে আমার প্রিয় পায়েস হলো । মা নিজে হাতে খাইয়ে দিলেন। আমি অবাক হলাম। এখন তো আমার জন্মদিন নয় ! সন্ধ্যায় বাবা নতুন জামা প্যান্ট জুতো আনলেন। আমার খুব আনন্দ। বাবা এদিন মাংসও এনেছিলেন। তখন বছরে একবার কি দুবার মাংস হতো। বাবা পাশে বসিয়ে রাতে খাওয়ালেন । নিজের পাত থেকে নরম নরম মাংস তুলে দিলেন। ওই দিন রাতে মা আমাকে ডেকে নিজের কাছে শোয়ালেন। মা ও বাবার মাঝখানে আমি । বাবা কিম্বা মা বিশেষ কথা বললেন না। বাবা দু বার মাথার চুল ঘেঁটে দিলেন। নিজের সৌভাগ্যে একটু গর্ব হচ্ছিল না ,তা নয় । কিন্তু হঠাৎ কি হলো ! সেটাই ছিল প্রধান জানার বিষয়। রাতে মা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন শুধু — অত বদমায়েশি করো না। শান্ত শিষ্ট না হলে সবাই বাজে ছেলে বলবে। কি মনে রাখবে তো ?
আমি মার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, আর কোনদিন করব না মা, তুমি দেখো ।
সত্যি আর কোনোদিন বদমায়েশি করিনি। আমি আর কোনো দিন খটাসের ডাক শুনিনি। মাটির ঘরের ভিজে দাবায় বিছানা পেতে দিদিমার মুখে গল্প শোনা হয়নি ।মা আর কোনোদিন আমাকে মারেননি । আমার আর আগান , বাগান ঘোরা ; বউ বসানি , লুকোচুরি খেলা হয়নি । বাবা পরের দিন আমার কাছ থেকে আমার গ্রাম, আমার জন্মভিটে কেড়ে নিয়ে প্রায় অনাথদের জন্য একটা আশ্রম উপহার দিলেন।
ভেসে বেড়ানোর কষ্টটা বাবা কাউকে বলতে পারতেন না । তিনি সব সময় বলতেন, নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা আসল দাঁড়ানো। নিজস্ব শিকড় ছড়ানো মাটিই মানুষের প্রকৃত পরিচয়। তার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় । অনাথের মতো ভেসে বেড়ানো মানুষটা নিজস্ব মাটি চেয়েছিলেন। বাবা চেয়েছিলেন বলেই আমি একজন শিক্ষক । আমার নিজের বাড়িতে বসে বর্ষার গান শুনতে শুনতে ছেলেবেলার বনবিড়ালের কথা লিখছি।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *