কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদ কাহন – বুরিট্টো
কথায় আছে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মধ্যে শিল্প, সংস্কৃতির আকাশ পাতাল তফাৎ। সত্যিই তাই৷ সেই তফাৎ প্রত্যক্ষ করার ভাগ্য আমার হয়েছে৷ তাই আরও বেশি করে বিষয়টা বুঝি। বর্তমানে আমাদের চারদিকে লক্ষ্য করলে আমরা যা দেখি তা কেবলমাত্র আংশিক অনুকরণ৷ খাবার, পোশাক কিংবা বাবা মায়ের সাথে না থাকা থেকে শুরু করে গুরুজনদের প্রতি ব্যবহার— আংশিক অনুকরণের পথে এগিয়ে চলেছে আমাদের উন্নত সম্প্রদায়৷ খাবার দাবারে আমরা এখন বাঙালিয়ানা ছেড়ে ঝুঁকে গেছি চাইনিজ, ইটালিয়ান, থাই কিংবা মেক্সিকান। দিন যত যাচ্ছে সব কিছুই বদলাচ্ছে। আমাদের দেশের খাবার যেমন বিদেশে পাওয়া যায় তেমনি বিদেশেরও নানান ধরনের খাবার দাবার আমাদের দেশে পাওয়া যায়। কিন্তু জায়গা ও মানুষের স্বাদ অনুপাতে খাবারের ব্যবহৃত উপকরণে অনেকটাই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় ফলে আমাদের দেশে সেরকম খেতে হয় না। একই রকম ভাবে ব্রিটিশ খাবারও ।
বেশ কিছু বছর আগে আমি যখন ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ছোট্ট শহরে থাকতাম এবং যার আশেপাশে সেইভাবে দোকানপাট বলে কিছুই ছিল না ফলে সেই দিনগুলোতে বেশিরভাগ খাবার আমি বাড়িতেই বানিয়ে খেতাম। মাঝেমধ্যে হাটাহাটি করতে বেরোলে বা একটু দূরের দিকে গেলে এক একটা দোকানের দেখা পাওয়া যেত। বিশেষ করে কেএফসি, ম্যাকডোনাল, সাবওয়ে বা টাকো বেল । আমেরিকাতে এই দোকানগুলো সর্বত্রই দেখা যায়৷ প্রথম সাবওয়ে খেতে ওখানেই শিখি। একবার টাকো বেলে গিয়ে দেখলাম ইয়ায়ায়া বড় সাইজের একটা রুটির ভেতর অনেক কিছু দিচ্ছে (খদ্দেরের চাহিদা অনুযায়ী) এই যেমন ভাত, বিনস, ডিম, মাংস, ছোট ছোট পালং এর পাতা তারপর হরেক রকম মেয়োনিস, ক্রিম – তারপর বেশ সুন্দর করে ওই রুটিরই দুই দিক ভাঁজ করে রোল করে দিল। এমন ভাবে ভাঁজ করল রুটি দিয়েই দুদিকের খোলা মুখ বন্ধ হয়ে গেল। দেখে ভীষণ ভালো লেগেছিল। আসলে নতুন কোন খাবার দেখলে আমার বরাবরই চমৎকার অনুভূতি হয়৷
তারপর একদিন সেই খাবার আমিও খেলাম। একটা বুরিট্টো একা খাওয়া খুবই মুশকিল। অর্ধেকটাও অনেক। কোথায় কলকাতার রোল আর কোথায় মেক্সিকান বুরিট্টো! ওহ, কথায় কথায় এটাই বলতে ভুলে গেছি, ক্যালিফোর্নিয়াতে খেলেও বুরিট্টো আসলে মেক্সিকান খাবার৷ মেক্সিকান খাবার আমেরিকায় এলো কিভাবে? নিশ্চই লোকের আনাগোনায়। যেভাবে ভারতে নানান খাবার চলে এসেছে।
কথায় কথায় জেনেছিলাম, স্প্যানিশ ভাষায় ছোট গাধাকে বুরিটো বলে। আর সেই বুরিটো থেকেই বুরিট্টো খাবারের নামটি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা এখানেই। মেদিনীপুরের ছোট গ্রামের মেয়ে, বুরিট্টো হাতে ভাবছি তবে কি গাধার মাংস আছে রুটির মধ্যে? ইশ!! গা কেমন গুলিয়ে উঠেছিল। এমনিতেই আমি খুব একটা মাংসাশী নই, তার ওপর অতো বড় বড় প্রাণীর কথা ভাবতেই পারি না৷ যাইহোক পরে পরে আমার সমস্ত ধোঁয়াশা কেটে যায়৷ বুরিট্টো খাবারটির পেছনে অনেকগুলি তত্ত্ব আছে। মানে গল্প আছে। কোনটা ঠিক তা আজও সেই ভাবে জানা যায়নি। সব থেকে জনপ্রিয় গল্প হল, জুয়ান মেন্ডেজ নামে এক ব্যক্তি, ১৯১০-১৯২০ সালের মধ্যে মানে যে সময় মেক্সিকান বিপ্লব হচ্ছিল, সেই সময় সিউদাদ জুয়ারেজ শহরে টাকো বিক্রি করতেন। টাকো মানে আজকালের টাকো বেলের টাকো নয়, টরটিলা রুটির মধ্যে মাংস(গরু, মুরগী, শুকোর) বা পোড়া মাছ, কিংবা নানান সবজি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়। টরটিলা রুটি অনেকক্ষেত্রে ময়দার হলেও আসলে এটি কর্ন মানে ভুট্টা আটার রুটি। যাইহোক, সিউদাদ জুয়ারেজ ওই ট্যাকো বিক্রির জন্য মেন্ডেজ একটি গাধার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং খাবারটি গরম রাখার জন্য বড় ময়দার টর্টিলাতে মুড়ে রাখতেন। গাধার পিঠে চড়ে খাবার বিক্রি করার ফলে মানুষের মধ্যে সহজের প্রচারিত হয়ে গেল “গাধার খাবার” কথাটি। আস্তে আস্তে খাবারটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই উদ্ভাবনী আবিষ্কারের নাম হয় বুরিট্টো। টাকো আর বুরিট্টোর মধ্যে অনেক তফাৎ৷ বুরিট্টোর রুটি টাকোর থেকে সাইজে অনেকটা বড় হয়। আর টাকোর মুখ সাধারণত ভাঁজ করা থাকলেও অল্প খোলা থাকে, আর বুরিট্টোর দুপাশের মুখ সহ মাঝের অংশ সম্পূর্ণভাবে মোড়া থাকে। আমার ধারণা চলতে ফিরতি মানুষের যাতে খেতে সুবিধা হয় বিশেষ করে শ্রমিক বা কৃষক জাতীয় লোকেদের তার জন্যই এই উদ্ভাবনী আবিষ্কার। যদিও সব থেকে বেশি মেক্সিকান সেনাদের জন্য ব্যবহৃত হত। কারণ খাবারটি সহজে পরিবহণযোগ্য ও পুষ্টিকর। তাছাড়া বানানোও বেশ সহজ, বহনযোগ্য এবং ফিলিং বা উপাদান বদলানো যেত।
এছাড়া আরো একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব রয়েছে, সিউদাদ জুয়ারেজের নামের এক ব্যক্তি নামহীন রাস্তার খাবারের বিক্রেতা ছিলেন৷ ১৯৪০ সালে, ওই রাস্তার কাছের একটি স্কুলের পাশে যেতেন খাবার বিক্রি করতে। সেই স্কুলের দরিদ্র শিশুদের জন্য বুরিট্টো তৈরি করেছিলেন। শিশুদের প্রতি তার স্নেহপূর্ণ ডাকনাম ছিল “বুরিটোস”, যার অর্থ “ধীর” বা “বুদ্ধিহীন”। এই বুরিটোস নাম থেকে খাবারটির নামকরণ করা হয়েছিল বুরিট্টো। নানান ধরনের গল্প শোনা যায় এই সমস্ত গল্প তারই অংশ।
তবে আমার ধারণা বুরিট্টোর সাথে গাধার সম্পর্কই বেশি মাত্রায় জড়িয়ে৷ কারণ “টাকো: ইউএসএ: হাউ মেক্সিকান ফুড কনকর্ড আমেরিকা” বইয়ের লেখক গুস্তাভো আরেলানোর বক্তব্য অনুযায়ী, উত্তর-পশ্চিম মেক্সিকোর সোনোরা নামক একটি অঞ্চলে বুরিট্টো খাবারটির উদ্ভব ঘটেছিল। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে গম চাষ করা হতো যা থেকে টরটিলা রুটির প্রধান উপাদান ময়দা পাওয়া যায়। সে সময় এই জায়গাগুলোতে মানুষ গাধার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। এবং ভ্রমণের সময় খেতে সুবিধে হবে বলেই বুরিট্টোর মতো খাবারের উদ্ভাবন হয়েছিল। বড় রুটির মধ্যে শাক পাতা মাংস বিন্স ভাত এককথায় বলা যায় All in One. মানে সমস্ত খাদ্যগুণে সম্পূর্ণ এই খাবার যেখানে খুশি সহজেই খেয়ে ফেলা যাবে এবং পেটও ভরে যাবে৷ তাছাড়া খাবারটি বইতেও সুবিধে। গাধার পিঠে চেপে ভ্রমণ করতেও এবং ভ্রমণের সময় খাবার হতো বলেই এই খাবার বুরিট্টো হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল।
১৯৪০ এর দশকে বুরিটো যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে, বিশেষত ক্যালিফোর্নিয়া ও টেক্সাস রাজ্যে বসবাসকারী মেক্সিকান অভিবাসীদের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে টাকো বেল (Taco Bell) নামের রেস্টোরেন্ট চেইন বুরিটোকে ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রথম বাজারজাত করে, যার ফলে এটি সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যেও জনপ্রিয় হতে শুরু করে। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকাই নয়, সারা আমেরিকাতেই ধীরে ধীরে বুরিটোর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এর নানা রকম বিবর্তন ঘটতে থাকে—”মিশন স্টাইল বুরিটো”, “ক্যালিফোর্নিয়া বুরিটো”, এমনকি “সুশি বুরিটো” পর্যন্ত।
তারপর একদিন ভারতেও চলে এলো। বর্তমানে “ভারতীয় বুরিট্টো” ভারত সহ ইউরোপেও বেশ জনপ্রিয় খাবার। যাতে মশলাদার পনির, চিকেন টিক্কা, বা আলু চাট পর্যন্ত ভরে দেওয়া হয়। এভাবেই নানান দেশের মানুষের স্বাদ অনুপাতে কাস্টমাইজ করে ফেলার ফলে বুরিট্টো এখন কেবল মেক্সিকান বা আমেরিকান সীমাবদ্ধ খাবার নয়। এটি এক গ্লোবাল আইকন—যেখানে ফাস্ট ফুড চেইন যেমন Chipotle, Moe’s, Qdoba, এবং Taco Bell এই খাবারটিকে কোটি কোটি গ্রাহকের প্লেট অব্দি পৌঁছে দিয়েছে।