হৈচৈ ছোটদের গল্পে সৌরভ ঘোষ

ফলোয়ার

পলাশ, না ফুল নয় মানুষ। যদি এ ফুল হত তাহলে বোধহয় রাফ্লেসিয়ার থেকেও বেশি দুর্গন্ধ ছড়াতো আর গোলাপের থেকেও বেশি কাঁটা হত। পলাশ দাস আমার বন্ধু, সত্যি বলছি এমন বন্ধু কারও জীবনে না হওয়াই ভালো। আমাদের দুজনের বাড়ি পাশাপাশি না হলেও কাছাকাছি। দেরিতে কথা বলতে পারার জন্য ও আমার ভর্তির এক বছর পর স্কুলে ভর্তি হয়। তাছাড়া কথা বলবে কীভাবে! আমার জ্ঞান হওয়া থেকে দেখে আসছি ডান হাতের তিনটে আঙুল সবসময় মুখের ভেতর। ডান হাত টেনে বের করলে বাম হাত যেন মেশিনের মত মুখের মধ্যে ঢুকে যেত। আবার দু- হাত ধরে থাকলে চিৎকার আরম্ভ করে দিত। আমি ভাবতাম কী এমন মিষ্টি রসের ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে ঐ আঙুলগুলোর মধ্যে! বহুবার চেষ্টা করেছি মুখের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে চোষবার কিন্তু বেশিক্ষণ রাখতে পারিনি। একবার পলাশের বাবা সারাদিন লাঠি নিয়ে ওর পেছনে তাড়া করেছিল। কাকু একটু অন্যমনস্ক হতেই ও চোখের আড়ালে চলে যেত। আমি যদিও জানতাম ও কোথায় থাকতে পারে, খড়ের গাদার পেছনে বা গাদার তলায়, নোংরা আবর্জনা তার সাথে বড় বড় ইঁদুরের গর্তের পাশে। আমি পলাশের বাবা ভোলা কাকুকে জায়গাটা দেখিয়ে দিতাম।
ভোলা কাকু যখনই পলাশকে মারতে যেত ভোলা কাকুর মা মানে রাঙা ঠাকুমা পলাশকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলত, কেন মারছিস ছেলেটাকে, এর গায়ে হাড় ছাড়া কী আছে? তুইও ছোটোবেলায় অমন ছিলিস, সারাক্ষণ বুড়ো আঙুল চুষতিস, তোর বাবা গোবর লাগিয়ে দিয়েছিল তাও তোর অভ্যেস ছাড়াতে পারেনি। পলাশ রোগাসোগা, মাথার ওপর ব্যাঙের ছাতার মত কোঁকড়ানো চুল। বদমায়েশিতে ওর ধারে কাছে কেউ নেই। প্রায়ই ভোলা কাকুর হাতে মার খেলেও অনেক বয়স অবধি আঙুল চোষা ছাড়তে পারেনি, ক্লাস থ্রি ফোর অবধি অমনই চলতে লাগল।
বড় হবার সাথে সাথে খেলার মাঠে আমরা নিজেদের জায়গা পাকা করা শুরু করলাম। বড়দের পাশে ছোট্ট জায়গায় পাওয়ার বল নিয়ে খেলতে খেলতে একসময় তাদের দলে ঢুকেও পড়লাম। পলাশও ঢুকল। পায়ে বল খেলতে গেলে পায়ে তো একটু আধটু লাগবে সেটাই স্বাভাবিক। ওর পায়ে মাংস ছিল না শুধু হাড়। ওর পায়ের সাথে আমাদের কারও পা টাচ হলে দু তিনদিন আর মাঠে নামতে হত না। পায়ে মারার জন্য ও আমাদের টার্গেট করত মানে ওর বয়সীদের বা ওর থেকে কম বয়সীদের। কিন্তু বাপেরও তো বাপ থাকে। বড় দাদাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ওকে টার্গেট করত। ওর যদি একবার লাগত সেই যে মাঠের মাঝখানে বসে মরাকান্না জুড়ে দিত সন্ধে না হওয়া অবধি উঠতোই না, খেলা পণ্ড। ভোলা কাকু লাঠি নিয়ে এলেও কাজ হত না। এমন ভান করত যেন পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। যখন ক্রিকেট খেলা হত তখন আরও হুড়কে করত। নিজেদের রান বাড়িয়ে দিত, স্ট্যাম্প গার্ড করে খেলত, আউট হলে ব্যাট নিয়ে ছুটত। খেলার মাঠের পাশেই ছিল দিগন্ত বিস্তৃত চাষের জমি এখন অবশ্য অনেক বাড়িঘর হয়ে গেছে। সেই জমির আল ধরে ও বাতাসের বেগে ছুটত। আমরা ওর সাথে কিছুতেই পেরে উঠতাম না। খেলার সময় ওর সব কথা মেনে নিয়ে চলার চেষ্টা করতাম। ওকে রাগালে বল কালীতলার পাশের পুকুরে নয়ত ব্যাট নিয়ে ও জমির মাঝখানে। এইভাবে দুঃসহ অবস্থায় কতদিন কেটেছে!
দেখতে দেখতে একসময় আমরা মায়ের আঁচল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ক্লাবে বড়দের সাথে ফিস্টেও যোগ দেওয়া শুরু করলাম। ক্লাবের দোরে বসে খাওয়া হত। দোরটা খুব একটা বড় নয় তাই একেবারে সবাই বসতে পারতাম না। তাছাড়া দু- তিনজন পরিবেশন করত তাদের সঙ্গ দেবার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। পলাশ বসত সকলের প্রথমে। ওর মতো নোংরা খাওয়া আমি জীবনে আর কারও দেখিনি। ভাত হলে প্রচুর ভাত নিত, খিচুড়ি হলেও তাই। এরপর সেই খাবার খেতে খেতে প্রথম ব্যচ উঠে গিয়ে আমাদেরও খাওয়া হয়ে যেত। শেষের দিকে যখন একেবারে পারত না তখন গোল গোল মণ্ড পাকিয়ে পাতে রেখে দিত। এদিক ওদিক নড়েচড়ে একটা একটা করে মুখের মধ্যে ঠুসত। সব খাবার কখনোই ওকে শেষ করতে দেখিনি। আমরা যদি বলতাম কী দরকার ছিল এতটা নেবার ও যে কোনো একটা অজুহাত দিত, হয় শরীর খারাপ, না হয় পেট খারাপ আর না হয় মামার বাড়িতে একটু আগে মাংসোর ঝোল ভাত খেয়ে এসেছি। তবু ও আমাদের সাথে থাকত। বিয়েবাড়িতে ওর পাশে বসে কেউ খেতে চাইত না।
যখন আমাদের বয়স বাইশ তেইশ কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ক্যাটারিং করেছিলাম, দাতব্য, শুধু খাবার দিলেই হবে। পলাশ নুন, লেবু আর জল দিত। শেষে যখন আমরা একসাথে খেতে বসতাম পলাশের পাত ভরে যেত সাদা রসগোল্লায়। কয়েকটা খেয়ে উসখুস করা শুরু করত, আমরা বুঝে যেতাম ও আর পারছে না, নিশ্চই গা গুলোচ্ছে। চক্ষুলজ্জার ভয়ে শেষে আমাদের সেগুলো খেতে হত।
সব ঠিক ছিল এসব কর্মকাণ্ড, হামবড় ভাব। জীবনে ও সবথকে বড় ভুল করল আমাকে নকল করতে গিয়ে। প্রথমেই বলেছি ও আমার থেকে একক্লাস নিচুতে পড়ত। আমি বরাবরই পড়াশোনায় ভালো ছিলাম, স্কুলে ফাস্ট হতাম। ও ঠিক তার বিপরীত কোনো রকমে ক্লাসে উঠত। আমি বি.এস.সি শেষ করে যখন কাজ খুঁজছি, চাকরির পরীক্ষা দেব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি ও বলল তোর পড়া যখন শেষ আমিও আর পড়ব না। এরকম ফলোয়ার আমি আর জীবনে পাইনি। সংসারের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল বলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটেটিভের চাকরি করতে করতেই সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতাম। আমার দেখাদেখি ও একটা ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি জোটাল। তফাৎ হল আমার’টা মাল্টিন্যাশানল কোম্পানি ওর’টা পি.ডি.। ওতেও উন্নতি করা যেত কিন্তু প্রায়ই দেখতাম ও পাড়ার রকে বসে আড্ডা দিচ্ছে। এই কাজে প্রচুর খাটতে হয় বুঝিয়েও লাভ হল না। ওর চাকরি রইল না, ছাঁটাই হয়ে গেল। আমি একটা কোম্পানি দেখে দিলাম সেখান থেকেও ছাঁটাই হল কয়েক মাসের মধ্যে। কে রাখবে অমন ফাঁকিবাজকে! বছর চারেক পর আমি একটা বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গেলাম। সেদিন বুঝলাম একটা বন্ধু ভালো চাকরি পেলে আর একটা বন্ধুর কত কষ্ট হয়! ও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। উল্টে চারদিকে আমার নিন্দে করতে লাগল। ব্যাপার হল এই চাকরি পেতে গেলে পড়াশোনা করতে হয়, পরীক্ষা দিতে হয় সেটা ওকে কীকরে বোঝাই! শুনেছি আমার মতো মোটাসোটা চেহারা তৈরি করার লোভে ও নাকি এক্সট্রা প্রোটিন ট্যাবলেট খেত। একসময় ওর চোখ মুখ ফোলা দেখে আমিও অনুমান করেছিলাম কিন্তু সে কথা ও কখনোই স্বীকার করেনি। অনেকদিন পলাশ অবসাদে ভুগল, প্রেসার বেড়ে গেল। শুধু মাত্র আমার জন্য মানে আমার মত হওয়া হল না বলে। একসময় নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ল পলাশ। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না…
ওর মায়ের অনুরোধে সব বন্ধুরা মিলে একটা মেয়ে দেখে ওর বিয়ে দেওয়া হল। বর্তমানে ও একটা ওষুধ ডিস্ট্রিবিউটারের ঘরে ক্যাটারারের কাজ করে, দোকানে দোকানে ওষুধ দেয়। বেশি পাগলামো করলে ওর স্ত্রী বাসন্তী ওকে ধরে মারে। আমাদের কাছে এসে সে গল্প বললেও, কিছু করার নেই! পলাশ যদি ওর স্ত্রী’কে ধরে মারত তা’হলে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এক্ষেত্রে আমরা সব বন্ধুরাই নিরুপায়। আইন তো সবই মেয়েদের জন্য! আমার আর এক বন্ধু বুবাই বলে, ছাড়তো, ও আমাদের প্রচুর জ্বালিয়েছে, ওর বৌ ওকে মারে ঠিকই করে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *