অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে)

(পাঁচ)
কচিপাতা ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ছেলেরা নিজেরা টাকা তুলে প্রশাসনিক অনুমতি টনুমতি নিয়ে নিয়মিত স্থানীয় দুঃস্থ মানুষজনকে খাবার দাবার সহ নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী সাহায্য করছে। লকডাউনের এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে এইসব দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। তাঁদের এখন কোনও কাজ নেই, দুটো অন্নসংস্থানের সমস্ত উপায়ও বন্ধ। অতএব তাদের অবস্থাটা ঠিক শাঁখেরকরাতের। কোনও দিকেই কোনও দিশা নেই এইসব মানুষদের। কী খাবে? কে খাওয়াবে?এদের কিছু জানা নেই। সরকারী সাহায্য মাঝে মধ্যে পাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু রেশন থেকে যে পরিমাণ চাল তাদের দেবার কথা, সেই পরিমাণ চাল তারা পাচ্ছে না! কচিপাতার ছেলেরা এইসব মানুষের কাছে নিজ উদ্যোগে খাবার পৌঁছে দেবার মহান কাজটা করে যাচ্ছে। প্রতিদিন চাল, ডাল, আলু, পিঁয়াজ, কিছু সবজি, বিস্কুট, চা, কখনও বা ডিম সম্বলিত প্যাকেট নিয়মিতভাবে পরিবার পিছু তারা পৌঁছে দিচ্ছে আজ প্রায় কুড়ি দিন হ’ল।
নির্ঝর প্রত্যেকদিন সকালে এই প্যাকেটগুলো গুছিয়ে রেডি করে রাখে, ওদের সদস্যদের মধ্যে ভাগ করা থাকে কারা কারা কোন্ কোন্ দিকে খাদ্যবস্তু সরবরাহ করতে যাবে। সেইমতো আজ নির্ঝরের শরব পাড়ায় যাবার কথা। ওর টিমে থাকবে গৌতম, তনয়, সুফল আর শুভ। নির্ঝরকে নিয়ে এই পাঁচজনের দায়িত্ব পড়েছে আজ শবর পাড়ার কিছু আদিবাসী পরিবারের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর। সকাল থেকে সেইমতোই তারা তৈরী হচ্ছে। গতরাতেই শ্রাবণীর মোবাইল ফোনটা দেবেশকে সারাতে দিয়ে এসেছে নির্ঝর। আজ শবর পাড়া থেকে ফেরার পথে ওটা নিয়ে আসার কথা। দেবেশ ফোনের কাজটা ভালোই জানে, গতরাতেই ফোনটা ঠিক করে দেবে বলেছিল, কিন্তু নির্ঝররা তখন আজকের জন্য বাজারে বেরিয়েছিল, হাতে সময় ছিল কম। তাই সকালে এসে নিয়ে যাবে বলেছিল, কিন্তু আজ সকালে তার সময় হয়নি বলে দেবেশের কাছে দুপুরে টাইম নিয়েছে। দেবেশ বলেছে, ‘তোর যখন ইচ্ছা আসিস। আমি সারাদিন বাড়িতেই থাকব।’
গত সন্ধ্যায় শ্রাবণীর সঙ্গে দিন সাতেক পরে বেশ কিছুটা সময় ধরে কথা বলার পর ফিরে এসে রাতের দিকে মনটা খুব ফুরফুরে লাগছিল। অনেকদিন পরে কবিতা লিখতে ইচ্ছা করল। কতদিন আর কবিতা লেখে না সে! কবিতা পাঠ করতে যায় না কোনও কবিতা পাঠের আসরে। আজ কবিতার ডাইরিটা খুলে বসল নির্ঝর। অনেকদিন পর দুটো লাইন লিখল সে। তারপর আস্তে আস্তে আরো দুটো লাইন। এইভাবেই আস্ত একটা কবিতা লিখে ফেলল সে। তারপর নিজে নিজেই পড়তে লাগল। অনেকদিন পরে শুরু হ’ল তার কাব্যিক নিশিযাপন। খান দুয়েক কবিতা লেখার পর নির্ঝর গভীর ঘুম অনুভব করল।
পরেরদিন অবশ্য ঘুমটা একটু সকাল সকালই ভেঙে গেল নির্ঝরের। প্রাতঃক্রিয়া সেরে হাত মুখ ধুয়ে চা খেলো নির্ঝর। তারপর গেল তাদের কচিপাতা ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ঘরে, সেখান থেকে মালপত্র রেডি করে বাড়ি এসে জলখাবার খেয়ে বাড়ির বাজার-হাট সারতে সারতে আটটা বেজে গেল। সাড়ে আটটা নাগাদ বেরোনোর কথা। এর মধ্যেই বার তিনেক ফোন করেছে পল্টু দা, ‘নির্ঝর, তোদের সব রেডি তো? ঠিক সাড়ে আটটাই বেরবো কিন্তু। আমরা আজ মালি পাড়ার দিকটা যাচ্ছি। হয়ত তোদের সঙ্গে আজ আর দ্যাখা হচ্ছে না। সবাই যেন সব কিছু ঠিকঠাক পায়, সেদিকে একটু খেয়াল রাখিস ভাই।’
-‘হ্যাঁ, দাদা। তুমি চাপ নিও না, আমি সব দেখে নেব।’ নির্ঝর বলল।
-‘ওকে। ব্রাদার। রাখি তাহলে।’
-‘হ্যাঁ। রাখো।’
পল্টুদার সব ব্যাপারেই একটু তাড়াহুড়ো বেশি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই একই কথা তাকে তিনবার ফোনে বলল। নির্ঝর এই লোকটাকে বিশেষ পছন্দ করে না। একটু এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। লোকটা রেভিনিউতে আছে। বেশ ভালো টাকা কামায়। উপরিও ভালো। একটু বস বস আচরণ। যদিও ইয়ংদের কাছে তেমন পাত্তা পায় না। অবশ্য সেসব দিকে তার বিশেষ ভ্রুক্ষেপ আছে বলেও মনে হয় না। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। শুধু যেন পল্টু সরকারই কাজকর্ম জানে, বাকি সবাই ভুষিমাল। পল্টুদার পেছনে এসব নিয়ে নির্ঝরদের যে ইয়ং গ্রুপটা আছে, তারা হাসাহাসি নেহাত-ই কম করে না। পল্টু সরকার সেসব টের পেলেও যে-কে-সেই। তার কোনও পরিবর্তন নেই।
নির্ঝর আটটা কুড়ির মধ্যে বাড়ির বাজার বাড়িতে দিয়েই বাইক নিয়ে দে ছুট। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কচিপাতা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। প্রস্তুতি তখন তুঙ্গে। টোটোগাড়িতে জিনিসপত্র তোলা প্রায় কমপ্লিট। নির্ঝর মনে মনে ভাবল, করোনার কিছু কিছু ভালো দিকও তাহলে রয়েছে। যে সময়ানুবর্তীতার জন্য বাঙালি নিজেকেই এতদিন নিজে ব্যঙ্গ করত, সেই সময়জ্ঞান করোনা বাঙালিকে উপহার দিয়ে গ্যালো। না হলে সাড়ে আটটা মানে ঠিক সাড়ে আটটা! এটা বাঙালি কবেই বা মানতে শিখেছে বা মেনেছে। ব্যতিক্রমীরা এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু। কিন্তু এই মুহূর্তে সে উল্টো দৃশ্যই দেখতে পাচ্ছে। এটাও একটা প্রাপ্তি। ইতিবাচক প্রাপ্তি।
শবর পাড়ার আদিবাসী সম্প্রাদায়ভুক্ত পরিবারগুলোকে খাদ্যবস্তু সরবরাহ করে ফেরার পথে দেবেশের বাড়ি থেকে শ্রাবণীর মোবাইল ফোনটা নিয়ে নির্ঝর যখন বাড়ি ফিরল, তখন প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই। স্নানে যাবার আগে, নির্ঝর তার বাইরের মাস্ক ও পোশাকআশাক সাবান দিয়ে গরম জলে ধুয়ে, শ্রাবণীর ফোনটা স্যানিটাইজড করে, তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে আরাম করে স্নান খাওয়া করে ঘন্টাখানেকের জন্য দিবানিদ্রা দিল। সন্ধের একটু আগে শ্রাবণীর বাড়ির সামনে এসে দেখলো, শ্রাবণী আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। তার ফোনটা দিয়ে গতরাতে লেখা কবিতা দুটো শ্রাবণীর হাতে দিয়ে বলল, ‘কাল রাতে লিখলাম। অনেকদিন পর। দ্যাখো তো কেমন হয়েছে?’
-‘খুব ভালো।’ কবিতা দুটো বেশ মন দিয়ে পড়ে শ্রাবণী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল।
-‘তুষারদা অনেকদিন আগে আমার কাছে লেখা চেয়েছিল, তখন হাতে লেখা ছিল না, দিতে পারিনি। এই দুটো দিলে কেমন হয় বলো তো?’
-‘কোন তুষারদা? আমাদের জয়িদির বর?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘ভালোই তো। দাও না। ওনার লেখা কবিতা, গল্প আমারও ভীষণ ভালো লাগে। মাস ছয়েক আগে হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।’
-‘হ্যাঁ। হঠাৎই সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল। গেছিলাম সেই সময়। তুষারদা আমারও খুব প্রিয়।আমাকে স্নেহ করেন। দেখি! এরমধ্যেই একদিন যাব দাদার কাছে। ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা আছে ঘন্টা খানিক লাগবে। একটু গলিঘুঁজি দিয়েই যেতে হবে। বড়রাস্তায় পুলিশ আটকে দেবে। কী বলো?
-‘হ্যাঁ। তবে যা করবে সাবধানে করো। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। এতদিন যখন যাওনি তো আর কয়েকদিন পরেই না হয় যেও। পরিস্থিতিটা একটু না হয় স্বাভাবিক হোক।’
-‘নাঃ! কালই যাব।’
-‘তা তো যাবেই। আমি বারণ করেছি, অতএব কালকেই তোমার যেতে হবে!’
-‘ঠিক তা নয়। আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন বাদ দাও। ফোনটা দেখলে না? ঠিক আছে তো?’
-‘তুমি তো দেখেই এনেছ, না কী! নতুন করে আমি আর কী দেখব?’
– না, তাও একবার দেখে নাও। কোন সমস্যা থাকলে দেবেশের কাছে আবার নিয়ে যাব। কিন্তু তোমার ফোনে আমার রিং হওয়া মাত্রেই ওই মিষ্টি কণ্ঠ যেন আমার কানের ভেতর দিয়া মরমে প্রবেশ করে…’
-‘ ন্যাকা। তোমার ফোন ধরবই না, যাও।’
এমন সময় ভেতর থেকে শ্রাবণীর মা মেয়েকে ডাক দিলেন। শ্রাবণীও কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেতরে যাবার জন্য উদব্যস্ত হয়ে পড়ে বলল, ‘আমাদের বাকি পরীক্ষাগুলো জুনেই হচ্ছে। আজ শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন। বইপত্র তো এই একমাস ছোঁয়া হয়নি। এখনও তিনটে পরীক্ষা বাকি। এখন যাই। কাল এখানেই থাকব। এসো। এখন চলি। বুঝলে।’
-‘ হুমম। যাও। আচ্ছা তোমাদের অনন্যা ম্যামের খবর কি?’
-‘জানি না। পুরো ভ্যানিশ শুনলাম। আচ্ছা চলি…’
নির্ঝর বাঁধা দেয় না। তাছাড়া শ্রাবণীর বাবাকে তার খুব ভয়। লোকটা বিরাট ফাও বকতে পারে।
ক্রমশ…