কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ৯

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র

আজ আর এক পরগনার গল্প আপনাদেরকে বলব। বাংলার মধ্যে সেও এক বিশাল রাজ্য। আজ যার নাম বরিশাল। পূর্ববঙ্গ বা অধুনা বাংলাদেশের এক বিখ্যাত জনপদ। কিন্তু আগে এই জায়গাই ছিল বাকলা বা বাকরগঞ্জ। আর তারমধ্যেই অবস্থিত চন্দ্রদ্বীপ। সেখানে ছিল কায়স্থ বংশীয় বসু বংশীয় রাজাদের আধিপত্য। মুঘল যুগের আগে থেকেই এখানে এই বংশের রাজারা রাজত্ব করে এসেছেন। আর সে ক্ষেত্রে সব থেকে উল্লেখযোগ্য নাম কন্দর্পনারায়ণ রায় এবং তাঁর পুত্র রামচন্দ্র রায়ের। এই রাজবংশের পরিচয় এবং রাজা কন্দর্পনারায়ণের প্রতিপত্তির বিষয়ে পড়ে যাব। প্রথমে বাকলা ও বাকরগঞ্জ নিয়ে এবং চন্দ্রদ্বীপের উৎপত্তি ও নামকরণের বিষয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। প্রথমেই একটি প্রচলিত প্রবাদের দিকে আমরা নজর দেব। আর সর্বপ্রথম এই প্রবাদটি নিয়ে লিখেছিলেন বেব্রিজ সাহেব। তাঁর মতামতকে লিপিবদ্ধ করলে আমরা বিক্রমপুর নিবাসী চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী নামক এক ব্রাহ্মণের সন্ধান পাই। ইতিহাস না লোককথা এই নিয়ে বিস্তার মতপার্থক্য আছে। থাকবেও। কিন্তু সেই সব তর্কে না গিয়ে কয়েকটি কথা খুব সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক। শোনা যায় চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী এক জনৈক নারীর পানিগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর জানতে পারেন সেই কন্যার নাম তাঁর ইষ্টদেবীর নামে। ‘ভগবতী’ নাম শোনার পর থেকেই চন্দ্রশেখর অদ্ভুতভাবে তার সঙ্গে থাকতে চাইলেন না। এবং ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে তিনি সংসার পরিত্যাগ করে নিজের প্রাণ বিসর্জনের জন্য নৌকা নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিলেন। আর সমুদ্রের মধ্যে দেখলেন এক সুন্দরী নারী নৌকা সহযোগে এগিয়ে চলেছেন তাঁর সামনে। সেই জনবিবর্জিত এলাকায় এমন একজন নারীকে দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু তারপর সেই জেলেকন্যা তাঁর দিকে এগিয়ে এলে থমকে যান চন্দ্রশেখর। তখন নিজের মনের কথা সেই কন্যাকে ব্যক্ত করলে তিনি এই ঘটনার জন্য ব্রাহ্মণকে ভৎসনা করেন এবং তার চোখ খুলে দেন। তখন ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে সেই ধীবর কন্যার পরিচয় জানতে চান। এবং সাধারণ সেই কন্যা নিজেই যে ব্রাহ্মণের ইষ্টদেবী, সেই পরিচয় দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। তখন দেবীর আশীর্বাদে সেই অঞ্চলে একটি দ্বীপ প্রকট হয়, এবং সেই দ্বীপের নাম ব্রাহ্মণের নাম অনুসারে চন্দ্রদ্বীপ হয়। যদিও এই ঘটনার মধ্যে কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। কিন্তু লোককথা হিসাবে আমরা একে ধরতেই পারি।
বাকলা হল সমুদ্র তীরবর্তী একটি জনপদ। তাই সাগরের উপর ভিত্তি করে এখানে তৈরি হয়েছিল কায়স্থ রাজাদের বিশাল আধিপত্য। এরপর আসি চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশের কথায়। এখানে দুটি রাজবংশের কথা উল্লেখ করতে হয়। প্রথম বংশটির আদি পুরুষ হিসাবে দনুজমর্দন দেবের কথা শোনা যায়। তবে তাঁর রাজত্বকালের সময়কাল সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। তবু যে সব তথ্য আমি সংগ্রহ করেছি তা থেকে বোঝা যায় বক্তিয়ার খিলজী বাংলা আক্রমণের কিছু সময় পরে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। আসলে দনুজমর্দন দেব কায়স্থ বংশীয় ছিলেন এবং চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীর শিষ্যও ছিলেন। সেই হিসাবেই তিনি চন্দ্রদ্বীপের প্রথম নরপতি হিসেবে সিংহাসনে বসেন। দনুজমর্দন দেবের পরে সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র রাজা রমাবল্লভ রায়। বংশানুক্রমিক ভাবে এই রাজবংশের পাঁচপুরুষ চন্দ্রদ্বীপের রাজত্ব করেছিলেন। তাদের নাম একত্রে লিপিবদ্ধ করলাম –

রাজা দনুজমর্দন দেব
রাজা রমাবল্লভ রায়
রাজা কৃষ্ণবল্লভ রায়
রাজা হরিবল্লভ রায়
রাজা জয়দেব রায়

রাজা দনুজ দেবের রাজত্বকালে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল কায়স্থ বংশীয়দের সমাজবন্ধন করা। রাজা বল্লাল সেন যেমন ভাবে কায়স্থদের একত্রিত করে সমাজে বেঁধেছিলেন, ঠিক সেভাবেই দনুজমর্দন দেব তাদের একত্রিত করেছিলেন। বাংলার ইতিহাসে তিনি উপেক্ষিত এক রাজা হলেও তাঁর এই কাজ তাঁকে পরিচয় দিয়েছিল। আজও বাংলার সমাজে সেই নিয়ম অনুসারে কায়স্থ বংশীয়দের বিভাগ দেখা যায়। যেমন ঘোষ, বসু এবং মিত্র কায়স্থ বংশীয় কুলীন ঘর। এবং দেব, দত্ত, কর, পালিত, সেন ইত্যাদি উপাধিধারীরা হলেন মৌলিক বংশীয়।
চন্দ্রদ্বীপ রাজভবনে বিশেষভাবে আহার করবার জন্য একটি ভোজনালয় তৈরি হয়েছিল। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘চিলছত্র’৷ তার মধ্যস্থলে বসতেন রাজা। এবং তার চারপাশে কুলীন বংশীয়রা। এবং তারপরে বাকি সকলে বসে আহার করতেন। কিন্তু রাজা জয়দেব রায় অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে রাজবংশের দায়িত্ব তাঁর দৌহিত্র হঠাৎ মেয়ের ঘরের নাতি পরমানন্দ রায়ের হাতে চলে যায়। আর সেখান থেকে শুরু হয় চন্দ্রদ্বীপের নতুন ইতিহাস। ঠিক তার কিছু সময় পরপরই বাংলার দিকে নজর পড়েছিল সম্রাট আকবরের। আর পরমানন্দ রায়ের পুত্র রাজা জগদানন্দ রায়ের সময় তিনি মুরাদ খাঁকে দক্ষিণ পূর্ব ভারত জয় করার জন্য বাংলায় পাঠিয়েছিলেন। মুরাদ ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাকলা ও ফতেয়াবাদ জয় করেন। রাজা জগদানন্দ রায়ের মৃত্যু সম্পর্কে বেশ কতকগুলি মত প্রচলিত আছে। যেমন বলা হয় রাজা ছিলেন মা গঙ্গার (আজ পদ্মা) উপাসক। আর তাই তিনি চেয়েছিলেন মা গঙ্গার বুকে নিজের অন্তিম শ্বাস বিসর্জন করতে। সেই মতো তিনি গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করেন অন্তিম সময়ে তাঁকে গ্রহণ করবার জন্য। এবং লোককথায় প্রচলিত আছে গঙ্গা রাজার দ্বারে এসে উপস্থিত হয়ে রাজাকে দুহাতে গ্রহণ করেন। যদিও ডাঃ ওয়াইজ সাহেব এটিকে অন্যভাবে বাস্তবিক রূপে ব্যাখ্যা করেন। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্র তীরবর্তী বাকলা অঞ্চলে এক ভয়ঙ্কর ঝড় এবং বন্যা উপস্থিত হয়। আর সেই ভয়ংকর বন্যায় বঙ্গোপসাগরের জল প্রায় দুই লক্ষ মানুষের প্রাণ নেয়৷ আর শোনা যায় সেই বন্যাতেই রাজা জগনানন্দ প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় তাঁর পুত্র কন্দর্পনারায়ণ আট বছরের এক বালক। তিনি একটি মন্দিরের চূড়ায় উঠে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। আর এভাবেই শুরু হয় চন্দ্রদ্বীপে নাবালক রাজা কন্দর্পনারায়ণের রাজ্য লাভ। রাজা কন্দর্পনারায়ণকে বারো ভূঁইয়ার এক শ্রেষ্ঠ ভূঁইয়া বলে উল্লেখ করা হয়। তাঁর রাজত্বকাল বাকলা পরগনার স্বর্ণযুগ। শোনা যায় তাঁর সাথে যশোর অধিপতি প্রতাপাদিত্যের বিশেষ সখ্য ছিল৷ এবং তাঁরা পরস্পরের সন্তানদের বিবাহসূত্রে পরিবারকে বন্ধনও করেছিলেন। এই দুই বীর একসময় বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রে এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। তাঁদের দ্বৈত বীরত্ব গাথা দিল্লীর সম্রাটের কাছে বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছিল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *