হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী
মা মারা যাবার পর এই বিচিত্র সংসারে থেকে বিট্টুর বয়স যেন বেশ ক’বছর বেড়ে গেছে। অনেক কিছুই বুঝতে পারে সে। কিন্তু তার বাবা কমল যে কিছুই বোঝে না। সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী রত্নাকেও তন্দ্রার মত ভেবে নিয়েছে। তার হাতেই বিট্টুর দায়িত্ব দিয়ে নিজের কাজকর্ম নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে গেল। একদিন রত্না, কমলের সামনে বিট্টুকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
—————
রত্না কি বলে?… পড়ুন দ্বিতীয় পর্বে…
বিট্টুর প্রতি রত্নার ভালোবাসা যে অগাধ, সেটা রত্না কমলের সামনে বোঝাতে চাইত। একদিন রাতে কমল বাড়ি ফিরলে রত্না, কমলের সামনে বিট্টুকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
“আমার বিট্টুসোনা, চোখের কণা। আমার সোনা ছেলে। খুব ভালো পড়াশোনা করে। আমার কত কথা শোনে। শুধু আমাকে মা বলে ডাকে না”
“বিট্টু! এ কি শুনছি। মা তোকে কত ভালোবাসে” – কমল বলল,
“একদম না, মা বলে কখনোই ওকে ডাকব না। ও খুব দুষ্টু। কখনোই আমার মা নয়। আমাকে ভালো করে খেতে দেয় না, সবসময় উল্টোপাল্টা কথা বলে। বাবা, তুমি একে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও”
“কি তোর যত বড় বড় কথা, বেয়াদপ ছেলে”
এরপর কমল হাতের সামনে থাকা একটি লাঠি দিয়ে খুব মেরেছিল বিট্টুকে। নতুন মা, রত্না এসে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“আহা, ওকে এভাবে মারছ কেন? আমারই দোষ। আমি ওর মা হতে পারিনি। আমিই চলে যাচ্ছি বাড়ি থেকে। বিট্টু সোনা যেন ভালো থাকে” – বলেই কাঁদতে লাগল।
ওর বাবা বজ্রকঠিন গলায় বলে, “তুমি কেন যাবে? গেলে ওকেই বোর্ডিং-এ রেখে দিয়ে আসব। খুব অসভ্য, বেয়ারা হয়ে গেছে। তুমি কেঁদোনা, প্লিজ। ওর এই ব্যবহারের জন্য তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি”
রত্না কমলকে ঘরে নিয়ে চলে যায়। ঘরে যাবার সময় রত্না বিট্টুর দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনিতে স্পষ্ট করে দেয়, দেখ তবে কেমন লাগে?
——————
রত্না, কমলের স্ত্রী তন্দ্রার খুড়তুতো বোন। এমনিতেই রত্না ছোট থেকেই তন্দ্রাকে বেশ হিংসা করত। তন্দ্রা খুবই বুঝদার। ওর বাবার আদরের একমাত্র কন্যা। পড়াশোনায় বেশ মেধাবী। পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার পর একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরিও করত। তন্দ্রার মিষ্টি ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করত। যেখানেই যেত সবার মন জয় করে নিত। সবাই ওকে ভালোবাসত। এই সব দেখে রত্না তন্দ্রাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। তবে সে প্রকাশ করত না। মনে মনে বলত, “সুযোগ পেলে আমি তোকে দেখে নেব”
যেদিন বিয়ের ব্যাপারে কমল ওর বাবা-মা’কে নিয়ে তন্দ্রাকে দেখতে ওর বাড়িতে প্রথম এসেছিল, সেদিন থেকে রত্নার কমলকে বেশ ভালো লেগেছিল। কমল মিত্র, মিত্র ওয়াচ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর একমাত্র মালিক। সে কিনা তন্দ্রাকে দেখতে এসেছে। বিশাল ধন সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী কমল মিত্রর স্ত্রী হিসাবে তন্দ্রাকে ওদের পরিবারের খুব পছন্দ হয়েছিল। রত্না আরও হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। কমলকে বিয়ে করার বাসনা ওর মনের মধ্যে দানা বেঁধেছিল। রত্না ওর বাবা-মাকে বলেছিল,
“আমি বিয়ে করতে চাই কমল মিত্রকে। তোমরা যেকোনো উপায়ে তন্দ্রার সাথে বিয়েটা ক্যান্সেল করো। ছোট থেকেই আমি তন্দ্রাকে সহ্য করতে পারি না। আজ ওদের ফ্যামিলি তন্দ্রাকে পছন্দ করে গেল। বাবা-মা হয়ে কি তোমরা আমার ইচ্ছাটা পূর্ণ করবে না?”
মেয়ের কথা শুনে ওর বাবা-মা ভীষণ অবাক হয়ে গেল। ওর বাবা বলেছিল,
“আমারও ইচ্ছা তোকে এমন কেউ বড়লোক ঘরের ছেলে দেখতে আসবে। তুই সেই বাড়ি আলো করে থাকবি। কিন্তু এখানে মিত্ররা তন্দ্রাকে পছন্দ করে গেছে। আমরা কি করে ক্যান্সেল করতে পারি বল? তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর, মা”
“আমার কমলকেই পছন্দ। ওখানেই বিয়ে দিতে হবে”
মেয়ের মিথ্যে জেদের কাছে তারা কিছুই করতে পারেনি। পরে কমল ও তন্দ্রার বিয়ে হয়। রত্না হিংসায় বিয়ের অনুষ্ঠানে আসেনি। তবে বৌভাতের দিন কমলের বাড়িতে এসেছিল। কমলের বিশাল বাড়ি ও প্রতিপত্তি দেখে মনে মনে শপথ নিয়েছিল,
“এই বাড়ির বৌ হয়ে একদিন আমি আসব। দরকার হলে তন্দ্রাকে সরিয়ে দেব”
রত্না, তন্দ্রার ক্ষতি প্রার্থনা করত মনে মনে। বিয়ের ব্যাপারে ওর বাবা-মা পাত্র দেখার কথা বললে রত্না ভীষণ রেগে যেত,
“আমার কথা তোমরা রাখনি। আমি বলেছিলাম কমলকেই বিয়ে করব। সেটা যখন হয়নি, আমি কাউকে বিয়ে করব না। প্লিজ, তোমরা কেউ আমার বিয়ের ব্যাপারে জোর করবে না। কমলের সাথে বিয়ে যখন হয়নি, আমি সারাজীবন একা থাকব”
“কি মুশকিল? তোর দিদি তন্দ্রার সাথে কমলের বিয়ে হয়ে গেছে। তোকে কিভাবে বিয়ে করবে? এখনো তুই কমলকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছিস?”
“হ্যাঁ দেখছি। এখনো বলছি, একদিন আমি ওই বাড়ির বৌ হব। বিশাল সম্পত্তিতে আমি একা রাজত্ব করব”
রত্না সু্যোগের অপেক্ষায় ছিল। তন্দ্রা ও কমলের বিয়ের তিনবছর পর বিট্টু হল। তার পরেও মনের মধ্যে কমলকে বিয়ে করার বাসনা জারি ছিল। তন্দ্রার শ্বশুরবাড়ি সুখী পরিবার, সেই পরিবারে তন্দ্রা, কমল, শ্বশুর-শাশুড়ী ও একমাত্র বাড়ির ছোট্ট সদস্য বিট্টুকে নিয়ে সুখের সংসার। রত্নার মা ওকে বলেছিল,
“কিরে মা এই সুখী সংসারে তুই কিভাবে স্থান পাবি? ওদের ভরা সংসার। তোর এইভাবে কমলের অপেক্ষায় থাকা উচিত হচ্ছে না। তোর বয়স হয়ে গেলে পাত্র আর পাবো না। আমরা বরং তোর জন্য অন্যত্র পাত্র দেখার ব্যাপারে কমলের সাথে কথা বলি”
“খবরদার, একদম নয় মা। বেশী বাড়াবাড়ি করবে না। আমি যখন বলেছি ওই বাড়িতে যাব, তখন আজ নয় কাল বা কোনও একদিন ওই বাড়িতে বৌ হিসাবে ঢুকবই”
মেয়ে পাগলের প্রলাপ বকছে। মাথার ঠিক নেই, এইভেবে রত্নার বাবা-মা মেয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। রত্নার বাবা একটি বড় ব্যবসা সামলাতেন। তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ায় রত্নাই সেই ব্যবসার দেখাশোনা করে। ব্যবসা সামলানোর ব্যাপারে সে যথেষ্ট পটু হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও তন্দ্রাকে হিংসা করার স্থান থেকে একবিন্দুও নড়েনি। জেদ আরও দৃঢ় হয়েছিল। দেখতে দেখতে বিট্টুর পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। বিট্টুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে কমল তন্দ্রাকে নিয়ে রত্নার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে এসেছিল। সেদিন রত্না যেভাবে কমলের দিকে তাকিয়েছিল, তন্দ্রা সেটা লক্ষ্য ভীষণ অবাক হয়েছিল। রত্নাকে তন্দ্রা বলেছিল,
“কিরে বোন? কমলের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? বিট্টুর জন্মদিনে আসতে হবে। সেদিন খুব মজা হবে”
রত্না কোনো উত্তর দেয়নি। সে হেসে বলেছিল, “আমি আসব। আমাকে ওই বাড়িতে আসতে হবেই”
তন্দ্রা ওর কথায় খুব আশ্চর্য হয়েছিল।
তন্দ্রা পরে কমলকে রত্নার ব্যাপারে কথা বলেছিল,
“কি ব্যাপার বলতো? রত্না তোমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল কেন? আমার ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগেনি”
কমল হাসতে হাসতে বলেছিল, “সে আমি কি করে জানব? তাছাড়া শালি আধি ঘরবালী। সে তার জাম্বোর দিকে তাকাতেই পারে”
তন্দ্রা কমলকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “তুমি শুধু আমার। আর কারোর নয়”… বিট্টু সেই কথা শুনে বলেছিল, “বাবা কি আমার নয়?”
কমল ও তন্দ্রা বিট্টুকে আদর করে বলেছিল, “বিট্টুসোনা শুধু আমাদের। তোকে ছাড়া আমরা কি করে থাকব, বল?”
“আর দাদু-আম্মা… !”
“তুই আমাদের সবার সোনা মাণিক”
বিট্টু খুব খুশি। কিছুদিন পর তার ধুমধাম করে জন্মদিন হবে। বাড়িতে অনেকেই আসবে। তার স্কুলে অনেক বন্ধু হয়েছে। তারাও ওর জন্মদিনে আসবে। খুব মজা হবে। এইভেবে সে আনন্দে আত্মহারা।
একদিন দাদু তার নাতিকে কাছে টেনে বলে,
“দাদুভাই, তোমার জন্মদিনে আমারও বেশকিছু বন্ধু আসবে। তাদের মধ্যে একজন হল হরিকৃষ্ণ। সে ছিল জাহাজের নাবিক। অনেকদেশে সে ঘুরেছে। তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। অনেক অভিজ্ঞ্রতার গল্প সে তোমাকে শোনাবে”
বিট্টু তখনই বায়না করে, “হরিদাদুর সাথে আমাকে এখনই পরিচয় করিয়ে দিতে হবে”
“এমন বায়না করলে হয় বিট্টু। সে কাছাকাছি থাকেনা। তাকে নিমন্ত্রণ করি। তোমার জন্মদিনে সে নিশ্চ্যই আসবে। এর আগে তোমার বাবা-মায়ের বিয়ের সময় এসেছিল”
বিট্টু বুঝতে পেরেছে। সে তার দাদুকে ভীষণ মানে। জন্মদিনের এই হরিদাদু হল বিট্টুর স্পেশ্যাল মানুষ। বিট্টুর অপেক্ষা করতে থাকে…
জন্মদিন চলে এল। সারা বাড়িতে বিশাল আয়োজন, চারিদিক সাজানো হয়েছে। বাড়ির সামনে বিশাল জায়গা। সেখানেই বিট্টুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্যান্ডেল করা হয়েছে। ক্যাটারিং এর লোক, ইন্টেরিয়রের লোক এমনকি সঙ্গীত অনুষ্ঠানের জন্য যে সকল শিল্পীর আসার কথা ছিল, তারাও চলে এসেছে তাদের অর্কেস্ট্রার দলের সাথে। বাড়িতে অতিথিরা আসতে শুরু করেছে। বিট্টু অপেক্ষা করে আছে হরিদাদুর জন্য, এরই মধ্যে প্রবেশ করল তন্দ্রার খুড়তুতো বোন রত্নাও…
——————
রত্না এসে গেছে… তার অভিসন্ধী কি? … পড়ুন পরের পর্বে…