ভ্রমণগদ্যে শুভময় মজুমদার

বালি -৭
বালিতে আগ্নেয়গিরি দেখিতে যাইব এই সংবাদ দেশেই পাইয়াছিলেম। কিন্তু তাহা লইয়া কোনোরূপ গবেষণা করি নাই। তাহার ছবি দেখিবার চেষ্টা করি নাই। আজকাল দেখি মানুষ কোনো স্থানে যাইবার পূর্বেই হরেক রিভিউ ,ছবি , মতামত, আরো কত কিছু জানিয়া সেই স্থানে যায়। ইহার হয়তো প্রয়োজন আছে । কিন্তু আমার নিকট নূতনকে দর্শন করিবার আনন্দ , সেই মুহূর্তে তাহার আস্বাদন লইবার। পূর্ব হইতে যদি ছবিতেই সেই দর্শন হইয়া যায় সেই আনন্দ হইতে যেন বঞ্চিত হইতে হয়।
সাতসকালে গাড়িতে চাপিয়া চালকের সহিত গল্প জুড়িয়া দিলেম । কিন্টামানি আগ্নেয়গিরি সম্পর্কে তাহার কথায় কথায় কল্পলোকে চিত্র পাইলাম।আমি যে স্থানেই যাই,স্থানীয় মানুষের গল্প শুনিতে আমার ভারী ভালো লাগে। আমাদের গাড়ির চালক বৎসর ত্রিশের এক যুবক। ভারী সুন্দর তাহার নাম। ডেক প্যাং। যদিও গিন্নির সেই নাম উচ্চারণ করিতে কালঘাম ছুটিয়া গেল। একসময় শুনি তাহাকে পরম উৎসাহে বেড প্যান বলিয়া সম্বোধন করিতেছে! আমি প্রমাদ গুণিলাম! সে কী বুঝিল বিধতাই জানিয়া থাকিবেন । এত ভদ্র , মিষ্ট স্বভাবের মানুষ আমি কম দেখিয়াছি। তাহার পরিবারের গল্প, বালির পরিবার রীতির কথা, তাহার দেশের কথা আর কিন্টামানি আগ্নেয়গিরির গল্প শুনিতে শুনিতে কত পথ যে পার করিয়া চলিলেম।
পথে পড়িল উবুদ গ্রাম । কী যে অদ্ভুত লাগিল ! প্রতিটা গৃহেই সেথায় শিল্পীদের বাস । সংকীর্ণ সড়ক পথ । তাহার দুই পাড়ে কাঠ চাঁপা বৃক্ষের সারি,সেই পথ কে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য প্রদান করিয়াছে। পথপার্শ্ব যেন আলোকিত হইয়া আছে থোকা থোকা শুভ্র কাঠচাঁপা ফুলে। প্রতিটা গৃহের সম্মুখে শিল্পীর খোদাই করা কাঠ ,পাথরের অপূর্ব শিল্প কার্যের প্রদর্শনী। কাঠ এবং পাথরের বিশাল মূর্তি সমূহ । ভগবান বুদ্ধ, বিষ্ণু দেব, শিব , দন্ত বিকশিত রাক্ষস , খোক্ষস, ঘোড়া, হাতি,ড্রাগন সবই নজর কাড়িযা লইলো। পূর্বেই বালির মন্দিরে মন্দিরে পাথরের কারুকার্য আমায় মুগ্ধ করিয়াছিল । সেই সকল কারুকার্যের সিংহভাগ যে উবুদেই সৃষ্টি তাহা জানিয়া রোমাঞ্চ জাগিল।
কিন্টামানি আগ্নেয়গিরির পথ আঁকিয়া, বাঁকিয়া পাহাড়ে উঠিয়াছে। দূর হইতে যখন তাহা দৃশ্যমান হইলো তাহার সেই অপার্থিব সৌন্দর্যে আমার বাকরুদ্ধ হইয়া গেল। দূরে অনন্ত নীলিমার কোলে কি পরম নিশ্চিন্তে উহা যেন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পূর্বে, ইতালিতে আমি ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি দেখিয়াছি। কিন্তু তাহার রূপে কেমন একটা রুক্ষ ভাব লক্ষ্য করিয়াছিলাম। বালিতে প্রকৃতির রূপ এত মনোরম যে তাহা অন্তর স্পর্শ করে। বাটুর পর্বত শ্রেনী দক্ষিণ পূর্বে নামিয়া আসিয়া মিশিয়াছে একটি শান্ত হ্রদে যাহা ঘিরিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ বনানী । দূর হইতে সেই অপরূপ দৃশ্য আমি স্তব্ধ হইয়া উপভোগ করিতেছিলাম। ভাবিতে ছিলাম এই শান্ত আগ্নেয়গিরি ই সময়ে সময়ে কেমন ভয়ংকর হইয়া ওঠে। শুনিলাম ২০০০ সালে উহার শেষ অগ্নুৎপাত হইয়াছে।
ঘোর কাটিল গিন্নির ডাকে। আসলে যে স্থান হইতে এই স্বর্গীয় দৃশ্য অবলোকন করিতেছিলেম বুঁদ হইয়া ,তাহা একখান ইন্দোনেশীয় রেস্টুরেন্ট। বাফেট এর এলাহী ব্যবস্থা রহিয়াছে। মোমবাতির আলোয় যে সকল খাদ্য চোখে পড়িল তাহাদের জন্মে দেখি নাই,ইহ জন্মে আর দেখিব বলিয়া মনে হইলো না। আর তাহার পর তাহাদের ঘ্রাণে ক্ষুধা উড়িয়া গেল। কোনওক্রমে বাহির হইয়া আসিয়া বাহির হইতে লিচু কিনিয়া খাইয়া আমার প্রাণ জুড়াইলো।
এমন অদ্ভুত লিচু কস্মিনকালেও দেখি নাই। আমাদের লিচুর তুলনায় প্রায় তিন গুণ বড় আর তাহাদের সমগ্র গাত্র ভরিয়া আছে নরম রোয়ায়।বাকিরা দেখিল ,হস্তে লইয়া নাড়াচাড়া করিল, বালির মৃত্তিকার প্রভূত প্রশংসা করিল কিন্তু কেহই উহা আর খাইতে সাহস পাইলো না…!