মুক্তগদ্যে সংহিতা সান্যাল

বন্ধুরঙের ইউনিফর্ম
সকাল নটা আর বিকেল চারটে – এই দুই সময়ে আমাদের পথঘাট রঙিন হয়ে ওঠে।
রিকশা, সাইকেল, বাইক, টোটোয় ছোট ছোট মুখ আর নানা রঙের ইউনিফর্ম। সাদা তো থাকবেই। মেরুন, কমলা, ছাইরং, ঘননীল, আকাশি, টুকটুকে লাল – মেয়েদের মাথায় লাল বা সাদা ফিতে। কোথাও দুটি ফুল ফুটেছে, কোথাও বেণীর লতায় মুকুলিত হয়ে আছে, কোথাও বা ছোট্ট চুলে জায়গা না পেয়ে আড়াআড়ি ব্যান্ড হয়ে আছে। কারও গলায় টাই, তাদের একটু অহংকার বেশি। আমাদের ছোটবেলায় ইংলিশ মিডিয়াম ছাড়া কারও টাই থাকত না। অন্যদিকে বাংলা মিডিয়ামের সর্বোচ্চ গর্ব – ‘টেস্টপেপারে, প্রশ্ন বিচিত্রায় আমাদের স্কুলের প্রশ্ন আছে’। কলকাতার মতো মফস্সলে মুড়িমুড়কির মতো ইংরেজি মাধ্যম নেই – প্রতি শহরে দুটো কিংবা তিনটে। সরকারি স্কুল সংখ্যায় বেশি। মেয়েদের আর ছেলেদের মধ্যে প্রবল রেষারেষি – কার স্কুল বেশি ভাল। প্রতিবছর মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের আগে থমথমে ভাব। যদি ওরা বেশি পেয়ে যায়? যদি কাগজে ছবি বেরোয়? রসগোল্লা খেতে খেতে যদি টিভিতে ইন্টারভিউ দেয়?
কিন্তু এসব মানসম্মানের বালাই আর রেষারেষি আসে নবম শ্রেণির পর থেকে। মফস্সলের বেশিরভাগ ইশকুলে ক্লাস নাইন মানে বড় হয়ে ওঠা। তার আগের জীবন মানে কিছুটা পড়াশোনা আর বাকিটা হইহই। আমার ইশকুল ছিল কৃষ্ণনগর রাষ্ট্রীয় উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। সেখানে ম্যাম থাকতেন না, থাকতেন ‘দিদি’। তাঁরা মায়ের মতো হলেও, ওটাই ছিল নির্ধারিত ডাক। আমার সেই ইশকুল আদতে নীলকুঠি ছিল। অনেকখানি পথ পেরিয়ে শহরের শেষপ্রান্তে শুরু হয় সীমানার পাঁচিল। তার বাইরের পুরনো পরিখা জল-জঙ্গলে বোঝাই। মূল দরজা দিয়ে ঢুকে অনেকটা রাস্তা, তার একপাশে বড় গাছ আর ঝোপঝাড় সবুজ এক অজানা দেশ তৈরি করে রেখেছে। তারপর বাঁদিকে নতুন তৈরি হওয়া একসারি ঘর। ডানদিকে শুরু হচ্ছে মূল কুঠিবাড়ি, যা এখন বড়দির ঘর, টিচার্সরুম, লাইব্রেরি, হলঘর, টিফিনঘর আর হস্টেল। এর মাঝখানে একফালি বাগানের পর আরেকটি ছোট দরজা। তার ওপারে প্রার্থনার আঙিনা আর পুরনো ক্লাসঘর। অন্যপাশে মাঠ। তৃতীয় শ্রেণিতে বুকের কাছে স্কার্ট পরা যে বাচ্চা আসবে, তার কাছে সে মাঠের কোনও কূলকিনারা নেই। তার ঘাড় উঁচু করা অবাক দৃষ্টিতে ছায়া ফেলবে প্রাচীন তেঁতুলগাছ, যার পাতায় ঢাকা পড়ে থাকে প্রার্থনার বাঁধানো প্রাঙ্গণ। রোজ সকালে সেখানে এক-একদিনের জন্য নির্দিষ্ট গান হয়। বাংলা গান। স্বাধীনতা দিবস আর স্পোর্টসের দিন সেখান থেকেই শুরু হয় প্যারেড।
আমাদের এই ইশকুলে কিছু অবাক করা জায়গা থাকত। পশ্চিমের বারান্দা ছিল তারই একটা। সারাবছর সেখানে ভাঙা কাঠ, রাবিশ, বাতিল ভিক্ট্রি স্ট্যান্ড জমে থাকত। তার কোনা থেকে লোহার এক ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গিয়েছে ওপরে। যেসব দরজা বা জানালার বাইরে তা শেষ হয়েছে, আজ পর্যন্ত জানি না সেখানে কী আছে। এই বারান্দার সামনে একটুকরো জমিতে গ্রিল দিয়ে মুখ বন্ধ করা একটা কুয়ো রয়েছে। শুনেছিলাম কোনও এক কৌতূহলী শিশু তাতে পড়ে যাওয়ার পর মুখ আটকে দেওয়া হয়েছে। আমরা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখতাম কুয়োর অন্ধকার, আরও অন্ধকার জল। বালিকার কল্পনায় ভিড় করে আসত গল্পে শোনা নীলকরদের অত্যাচার – মনে হত পিচ্ছিল আঁধার গা বেয়ে বেয়ে কাদের যেন হাত উঠে আসতে চাইছে। তখনই কোনও না কোনও দিদির ধমক বা কানমলা খেয়ে ঢুকে পড়তে হত ভূগোল কিংবা ইংরেজির ক্লাসে। পুরনো ক্লাসঘরের সামনেও রাখা ছিল একটা জংধরা অতিকায় গাড়ির খাঁচা। কেউ বলত, ওটা পুরনো স্কুলবাস, যা নাকি আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল। কেউ বলত অন্য কিছু। আমরা ওই খাঁচায় উঠে মহানন্দে খেলতাম। অনেকদিনের পুরনো ইশকুল হলে তাতে জায়গায় জায়গায় এমন ঝোপঝাড়, জঙ্গল আর না-জানা ঘর থাকে। গাছপালা থাকে। আমাদের কালে এসব ‘আনহাইজিনিক’ ঠাওরানো হত না। মনে করা হত, একটু ধুলোবালি আর গাছগাছালির সঙ্গে বড় না হলে আবার শৈশব কীসের? আমরা সাপের ভয় পেতাম না – যে জায়গায় সাপ থাকতে পারে সেখানে গিয়েই খেলতাম। জোড়া-ছাড়াছাড়ি খেলতে গিয়ে পড়ে হাঁটুর নুনছাল তুলে ফেলতাম রোজ। মাঝেমাঝে হনুমান আসত। তেঁতুল, কুল, আম, কাঁঠাল, আমড়া, পেঁপেগাছে। আমরা তখন কেউ ঢিল মারতাম না। ওদের তো আর থাকার জায়গা নেই, গাছের ফল না খেলে খাবে কী? ওরা এসে কিছু খেত, কিছু নীচে ফেলে দিত, আমরা মহোল্লাসে সেসব কুড়িয়ে ভাল করে ধুয়ে খেয়ে নিতাম। শুধু একবার একটি হনুমান এসে আমার প্রিয় বান্ধবী স্মিতার টিফিন খেয়ে নিয়েছিল। টিফিনবেলায় নেহাত অসুস্থ না হলে ঘরে থাকা নিষেধ। আমরা মাঠে বা পছন্দসই গাছতলায় বসে বাড়ির টিফিন খেতাম – কানাতোলা রঙিন থালায় ইশকুলের দেওয়া টিফিন খাওয়ার পর।
এত প্রাচীন আর এত সবুজের মধ্যে আমাদের কল্পনা ডানা মেলত। সবারই মেলত নিশ্চয়ই। মিশনারি ইশকুলগুলোয় নিয়মের বড় কড়াকড়ি, তাদের কথা জানি না। কিন্তু ছেলেদের কলেজিয়েট স্কুলে সরস্বতী পুজোয় ঢুকে দেখেছি, এমন মায়াবী সবুজ কোণ তাদেরও রয়েছে। স্বয়ং রামতনু লাহিড়ির বসতবাটিতে আছে কৃষ্ণনগর অ্যাকাডেমি। মহারানি জ্যোতির্ময়ী বালিকা বিদ্যালয় কৃষ্ণনগর রাজবাড়িরই এক অংশে শুরু হয়েছিল। এমন সব ইশকুলে, রুটিনের ফাঁক গলে বেরতে পারলেই আমরা আর ব্লু হাউজের সংহিতা, ইয়েলো হাউজের ঐশী, গ্রিন হাউজের রূপসা বা রেড হাউজের স্মিতা রইতাম না। যে যার মতো মার্কো পোলো বা ইবন বতুতা। কেউ মাঠের ঢালু হয়ে আসা জায়গায় গজানো ঝোপঝাড়ে ঢুকে কাল্পনিক দস্যু সংহার করছে, কেউ লোহার খাঁচায় উঠে এককালে পুড়ে যাওয়া বাসের কন্ডাক্টর সেজে কে জানে কেন লন্ডনের টিকিট বিক্রি করছে, কেউ পুরনো জিমন্যাশিয়ামের পরিত্যক্ত ঘরের পেছনে সারি সারি ছোট গাছকে সরলের নিয়ম শেখাচ্ছে। কেউ কোনও কারণ ছাড়াই তেঁতুলগাছের বাঁধানো বেদিতে উঠে গোল গোল ঘুরছে। কেউ মাঠে মাথা চাড়া দেওয়া কাশফুলের মধ্যে ফড়িং ধরছে। কেউ স্থির করেই নিয়েছে ক্লাস ফোরের অন্তরা হচ্ছে মোগল গুপ্তচর আর সে নিজে রানা প্রতাপ। হাজার হাজার চোরকাঁটার মধ্যেই ভয়ানক যুদ্ধ চলছে। আমিও এদের মধ্যেই একজন। কিংবা, সবাই।
আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এসব জানতেন। বিপদের ঠিক আগে আগেই যখন চশমায় ঝিলিক তুলে অণিমাদি কিংবা রুদ্রনিঠুর মুখ করে স্বপ্নাদিকে এগিয়ে আসতে দেখতাম – বুঝতাম, তাঁরা সবই লক্ষ করেন। নিতান্ত প্রয়োজন না বুঝলে তাঁরা আমাদের এই নিজস্ব পৃথিবীতে ঢুকতেন না। তাঁদেরও হয়তো আলাদা জগৎ ছিল। তাঁরাও তো অফ পিরিয়ডে সীতাহার ফুল কুড়োতেন। টিফিনবেলায় দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেন কেউ কেউ, চুপচাপ। আকাশ কালো করে বৃষ্টি এলে মুখ বাড়িয়ে জল মেখে নিতেন। শীতকালের কুয়াশা ভেদ করে যখন ম্লান হলুদ বিকেল নামত, বলতেন – ‘আজ তোরা গল্প কর, বেশি চেঁচামেচি করবি না কিন্তু’।
সেইসব ছোট ছেলেমেয়েরা আজ গম্ভীর বড়মানুষ। শুধু, হয়তো অন্য কোনও শহরে বিকেলবেলা পরিচিত রঙের ইউনিফর্ম দেখলে – কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে যায়।