• Uncategorized
  • 0

নভেলা গল্প হলেও সত্যি-তে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ধারাবাহিক ( রু )

দ্বিতীয় পর্ব

বর্ধমান থেকে বোলপুর আসার পথে ছোটো গঞ্জ মাঠপুকুর। সপ্তাহে দুইদিন হাট, বাস স্ট্যান্ডে চায়ের দোকান, পুরনো ধর্ম ঠাকুরের মন্দির আর হাইরোডের ধারে একটা মসজিদ ছাড়া অন্য বিশেষ কিছু নেই। অবশ্য বাস রাস্তার গায়ে নতুন বিডিও অফিসও আছে, যেখানে ক্লারিকাল পোস্টে চাকরি পেয়ে পলাশের কোলকাতা ছেড়ে আসা। সারা সপ্তাহ ওই বিডিও অফিসের হাজারো ঝামেলার মধ্যে দিয়েই কেটে যায়। আজকাল গ্রামেগঞ্জেও পার্টি-পলিটিক্স যাচ্ছেতাই চেহারা নিয়েছে। সব দুর্নীতির আড়ৎ। বিডিও অমিতাভ পুরকায়স্থ অবশ্য ম্যানেজ মাস্টার। পার্টির নেতাদের তোয়াজ করে চলে। তাই বড় গণ্ডগোল বিশেষ হয় না। কিন্তু এসব বিষয় পলাশকে তেমন কষ্ট দেয় না। বরং এই অহেতুক অপছন্দের কাজে জীবন নষ্ট করা ওর কাছে ভীষণ বেদনার। তাই মাঝেমধ্যে ছুটে যায় এদিক ওদিক।
শনিবার বিকেলে কোলকাতায় বাড়িতে চলে যায় কোনো কোনো দিন। সোমবার ভোরে ফিরে আসে। তাছাড়া সুযোগ পেলেই পিঠে ছোটো ব্যাগ চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কয়েক মাস আগেও একবার শান্তিনিকেতন গিয়েছিল। ফাঁকে ফাঁকে তারাপীঠ, ম্যাসাঞ্জোর, দুবরাজপুর এসবও টুকটাক ঘোরা হয়েছে। আবার কোথাও না গেলে তখন গ্রামেই ঘুরে বেড়ায়। এখানে ধর্ম ঠাকুরের মন্দিরটা বেশ প্রাচীন। শ’তিনেক বছর বয়স তো হবেই। স্থানীয় এক বৃদ্ধ মাস্টারমশায়ের সাথে সেদিন কথা হচ্ছিল। উনি বল্লেন ওই মন্দিরের পিছনে যে উঁচু ঢিবি আছে সেখানে আগে ছিলো আরও পুরাতন মন্দির। হয়তো বৌদ্ধ যুগের কোনো স্থাপত্য। সেই মন্দির বা মঠের পাশেই তখন ছিল সুবিশাল পুস্করিণী। তাই গ্রামের আসল নাম মঠপুকুর। তা থেকেই এখন লোকের মুখে মুখে হয়েছে মাঠ পুকুর। এইসব প্রাচীন তথ্য পলাশের ভারি পছন্দের সাবজেক্ট। এভাবে গভীরে জানার মধ্যে দিয়েই একটা এলাকার সাথে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
এক-একদিন বিকেলে মন্দিরের পিছনে ঢিবির একপাশে প্রাচীন ইটের সারির উপর গিয়ে বসে থাকে পলাশ। শিয়ালকাঁটা গাছে হলুদ ফুল ফুটে রয়। সামনে সেই পুরনো পুকুরের মজে আসা চেহারা। তার একদিকের অংশ ভরাট হতে হতে এখন ছেলেপিলের খেলার মাঠ। ওরা দৌড়দৌড়ি করে। হৈ-হল্লা। মাঠের পিছনে গাছের সারির উপর দিয়ে সূর্যটা লাল বলের মতো ডুবে যায়। আলো-আঁধারি পরিবেশে ধীরে ধীরে বাসার দিকে পা চালায় পলাশ।
ঘরে ফিরে ইনডাকশনে জল গরম বসায়। টুকটাক রান্না ও করতে পারে। তবে তা আহামরি কিছু নয়। দুপুরে বিডিও অফিসের ক্যান্টিনেই একরকম খাওয়া হয়ে যায়। আর রাতে অধিকাংশ দিন নিজেই দুটো ভাতেভাত ফুটিয়ে ফেলে। ইনডাকশনে জলে ফুট ধরেছে। গরম জল বড় মগে ঢেলে একটা টি ব্যাগ ডুবিয়ে নেয়। মুড়ির কৌটোর ঢাকনা খুলে বসে।

সেদিন শান্তিনিকেতন থেকে ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা বেজে গেছিল। ঘরে ফিরে ফ্রেস হয়ে রান্না চাপিয়েই ছবিটা প্যাক খুলে বের করে দেখেছিল ভালো করে। নিচে এককোণে রেমির সিগনেচার। ছবির যুবতী ইস্পাতের সূচালো ছুরির মতো ধারালো। চোখ তুলে তাকালেই দৃষ্টি বুকে এসে বেঁধে। বিছানার ঠিক পায়ের কাছে দেওয়ালে ছবিটা ঝুলিয়ে দেয় পলাশ। সারাক্ষণ পাশে পাশে থাকবে।
এরমধ্যে একদিন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। রাতে বেশ ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে হঠাৎ। উঠে জানলা বন্ধ করে একবার বাথরুমে ঘুরে এসে আবার শুয়েছে পলাশ। হাল্কা নীল আলো জ্বলছে ঘরে। আচমকা দেওয়ালে তাকাতেই চোখে পড়েছে ছবির মেয়েটি। দেখে মনে হচ্ছে যেন আগের থেকে আরও একটু বেশি ঘুরে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে তীব্র আহ্বান। মেয়েটির মুখের সাথে ইন্দ্রাণীর কোথাও একটা মিল আছে। অবশ্য সেটা হতেই পারে। নিজের স্ত্রীকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করাটাই রেমির পক্ষে খুব স্বাভাবিক। অদ্ভুত একটা বিষয় আগে খেয়াল করেনি পলাশ। মেয়েটির উন্মুক্ত বাম স্তনে অনেকটা ছড়ানো অ্যারিওলা। বাদামী জল ছবির মতো ছড়িয়ে গেছে। এ কী সত্যিই ইন্দ্রাণীর প্রতিরূপ? হয়তো কিছু বছর আগের কোনো ছবি দেখে আঁকা। আবার এমনও হতে পারে যে শিল্পী তার কল্পনার দৃষ্টি দিয়ে সাব্জেক্টের বয়স কমিয়ে ফেলেছে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল পলাশ। কিন্তু ছবিটা তার মাথা থেকে কখনোই বেরোয়নি।
ইদানিং বিছানায় শুলে প্রথমেই চোখ চলে যায়। বড় জীবন্ত করে এঁকেছিল রেমি। শিল্পীর সেই মুন্সিয়ানাই ক্রমাগত বিব্রত করে চলে পলাশকে। ঘরে ঘুরতে ফিরতে যখনই চোখ যায় অমন সপাট চোখে মেয়েটি অবিকল তাকিয়ে থাকে। ব্যাচেলর পুরুষের ঘর। অনেক রকম অন্তরঙ্গতার মধ্যে দিয়ে সময় কাটে। সেসময় খুব অস্বস্তি হয়।

বাড়িওলা সমীর চট্টরাজ একেবারে মাটির মানুষ। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাই ছিলেন। পারিবারিক চাষের জমিজমাও আছে। তিনি এমনিতে খুব একটা আসেন না পলাশের ঘরে। দুদিন আগে পোস্ট অফিস থেকে দিয়ে যাওয়া একটা চিঠি দিতে এসেছিলেন। ঘরে ঢুকে ছবিটাতে চোখ যেতেই চক্ষুস্থির। অমন বুক খোলা বেহায়া মেয়ের ছবির জন্য আগেকার দিন হলে হয়তো তখনই ভাড়াটেকে তাড়িয়ে দিতেন। এখন সেদিন নেই। তাই ঠারেঠোরে ছবিটি বিদায় করার কথা বলে গেলেন। ওঁর মেয়ে সুমি যদিও মাঝেমধ্যে পলাশের কীর্তি কারখানা দেখতে হাজির হয়। তবে সে আজকালকার মেয়ে। কলেজে পড়ছে। তাদের কাছে এসব জলভাত। তবু এই ছবির টান সেও এড়াতে পারেনি। সেদিন স্মার্টলি বলল, “আপনার আর এখন একা একা ফিলিংস হবে না। এত সুন্দর পেইন্টিং। সব সময় আপনাকে নজরে নজরে রাখবে”। বলেই একগাল হাসি। এইসব সাংকেতিক কথাবার্তার সামনে পলাশ কোনোদিনই হাত খুলে ব্যাটিং করতে পারেনি। এখনো চুপচাপ থাকে। মৃদু হাসি দিয়ে কর্তব্য সারে।
সুমি ঘুরে ফিরে পলাশের একলার সংসার দ্যাখে। টেবিলের বইপত্র গুছিয়ে দেয়। সকালে ঘরে চা-বিস্কুট ছাড়া যে আর কিছু ওর জোটে না তা ওর মা জানে। তাই মাঝেমাঝে সুমির হাত দিয়ে পরটা-তরকারি পাঠিয়ে দেয়। গ্রামেগঞ্জে পলাশের মতো সরকারি চাকুরে পাত্র বেশ লোভনীয়। এতদিনে সমীরবাবু হয়তো সেই প্রস্তাব দিয়েই ফেলতেন। তবে এখানে একটা মস্ত বাধা আছে। সুমিরা ব্রাহ্মণ আর পলাশ কায়স্থ। গ্রামের দিকে এখনো এইসব বিধিনিষেধ বেশ কড়া। অন্তত সমীরবাবুর মতো বয়স্ক লোকজনের কাছে। তবে সুমিরা আজকালকাল ছেলেমেয়ে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আগের মতো নেই। তাই পলাশ বেশ ভয়ে ভয়েই থাকে। কম বয়সের মেয়ে। কখন কী বাড়তি করে ফেলে।

রেমি একটা কার্ড দিয়েছিল। ওদের স্টুডিওর নাম ঠিকানা লেখা। সেদিন সকাল ন’টা নাগাদ ফোন করল পলাশ। খানিক রিং হতে ওপাশ থেকে ভেসে এলো রেমির কণ্ঠস্বর। ও খোয়াই-এর স্টুডিওতেই আছে। কথায় কথায় বলল– আমি আজ একাই এসেছি পলাশ। ইন্দ্রাণী আসতে পারেনি।
— কেন? শরীর ঠিকঠাক আছে তো?
— আরে না। পরশুদিন থেকে ওর জ্বর। বেশ ভালোই ঠান্ডা লাগিয়েছে। তাই আজ আর আসেনি। পারলে চলে এসো ব্রাদার। দুজনে মিলে দুপুরে ভদকা চালাবো।
— না ব্রাদার। আজ অফিস যেতে হবে। তবে তোমার ওখানে নিশ্চয়ই যাবো এরমধ্যে।
— তুমি এক কাজ কর। এখানে না এসে বরং মহুলিতে আসো একদিন। খুব আনন্দ হবে। একদম অজয়ের পাড়ে বাড়ি আমাদের। রাতে গিটার নিয়ে বসব। আর তুমি তো ইন্দ্রাণীর গান শোননি কখনো। একদম ফিদা হয়ে যাবে হে।
— আর লোভ দেখিও না এখন। ঠিক যাবো। একটু সুযোগ সুবিধা হোক। আমি তো এখানে একরকম একাই। তোমাদের মতো গুণী মানুষজনের সঙ্গ পেলে বর্তে যাই।

বিছানায় ঘুমের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে সারা দিনের হাজার ভাবনা। মায়ের কথা মনে হয়। বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে। তারপর শেষরাতে ঘুমের গভীর ঘন সবুজ স্তিমিত আলোর মধ্যে একটা প্রাচীন বাড়ি দেখতে পায় পলাশ। চারপাশে গাছপালায় ঢাকা। একটা নদীর জলের শব্দ কানে আসে। ঘুমের গভীরে তার ঢালু পাড় বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে ক্রমশ। সারাগায়ে বালি লেগে যায়। চিকচিকে হলুদ বালি!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।