• Uncategorized
  • 0

কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ১

বাংলার ভুঁইয়াতন্ত্র

বাংলার বারো ভূঁইয়া নিয়ে লিখব ভাবলাম। আগ্রহটা ছিল বহুদিন ধরেই। আজ কলম ধরলাম। আমাদের বাংলা এমন এক জায়গা যেখানে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে আছে রাজত্বের বীরগাথা।
বাংলায় স্বাধীন রাজার অধীনে রাজত্বের বীরগাথার গল্প আমরা শুনতে পাই মহাভারতেও। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল পৌণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন। আর সেখানকার স্বাধীন নরপতি নিজেকে স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণের চেয়েও বেশি শক্তিশালী বলে ঘোষণা করেছিলেন। সেই পৌণ্ড্রক বাসুদেবের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে মহাভারতের পাতায়। তাই বাংলার বাঙালি রাজাদের বীরত্ব সেইযুগ থেকেই লোকের মুখে মুখে চর্চিত।
কিন্তু আমরা সে বিষয়ে কতটা ওয়াকিবহাল? ইতিহাসকে ভুলে যেমন তৈরি হয় না বর্তমান, তেমন বর্তমানের নিচেই চাপা পড়ে যায় ইতিহাস। কিন্তু তাও আমরা জানতে চাই আমাদের পূর্বপুরুষদের কার্যকলাপ। দিল্লির মসনদে যখন মুঘল সম্রাটরা বীর বিক্রমে রাজত্ব করছেন, তখন দেশের অন্যান্য ভূখণ্ডে রয়েছেন বিভিন্ন স্বাধীন নরপতিরাও৷ সেখানে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে রাজত্ব করেছেন তাঁরা। মোঘল সাম্রাজ্যের সাথে সাথে যেমন পশ্চিম প্রান্তে মারাঠার স্বাধীন নরপতিরা রাজত্ব করেছিলেন, ঠিক তেমনভাবেই আরেকটি হিন্দু রাজ্য তৈরি হয়েছিল রাজপুতানায়। অর্থাৎ আজকের রাজস্থান। এঁদের বিভিন্ন ধরনের বীরগাথা আমরা জেনে এসেছি বহু আগে থেকেই। কিন্তু আমাদের মনে কৌতুহল এসেছে বারবার যে আমাদের বাংলায় তখন কেমন ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি। এই বাংলা আমাদের অত্যন্ত প্রিয়। আর তাই এখানকার মাটিতে সংঘটিত স্বাধীন রাজাদের কীর্তি সম্বন্ধে না জানলে যেন বাংলাকেই ঠিকমতো চেনা যায় না।
আমরা ইতিহাস বইয়ের পাতায় বারো ভূঁইয়ার নাম শুনেছি। কিন্তু আসলে কে এই বারো ভূঁইয়া? সত্যিই কি বারো জন রাজার অধীনে একসময় বাংলায় গড়ে উঠেছিল স্বাধীন রাজত্ব? কিন্তু তার কাণ্ডারী আসলে কারা? আপাত নিরীহ এই ভুঁইয়ারা ঠিক কেমন করে সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মোঘলদের সাথে পাল্লা দিতেন? আদৌ কি পারতেন? প্রশ্ন অনেক৷ উত্তর খুঁজতে বেরিয়েছি আমি। আর সেইসব উত্তর সাজিয়েই নিয়ে আসব ঠিক করলাম আপনাদের সামনে।
এখন প্রথমেই জানা দরকার এই বারো ভুঁইয়ারা কি সত্যিই বারো জন ছিলেন? তৎকালীন বাংলায় বারোজন স্বাধীন রাজাই কি তাঁদের নিজস্ব রাজ্য পরিচালনা করতেন এই বাংলার মাটিতে? নাকি ছিল আরও অনেকেই? ঠিক যেমন ভাবে আমরা অনেকে মিলে সংঘটিত পুজোকে বারোয়ারি বা বারো ইয়ারি বলে সম্বোধন করে থাকি, তেমন করেই বারো ভুঁইয়ার অর্থ অনেক শক্তিশালী রাজা বা সামন্ত। হয়ত কেউ স্বাধীন জায়গীর পেয়ে তৈরি করেছিলেন নিজের রাজত্ব, আবার কেউ স্বাধীন ভাবেই ভূমি দখল করে গড়েছিলেন আপন গড়। আর সেই অঞ্চলে তিনিই প্রভূ। ভুঁইয়া কথার অর্থ হল ভৌমিক বা ভূস্বামী। অর্থাৎ কোন একটি বড় জমি বা জায়গার মালিক রাজাদেরকে সেই সময় ভূঁইয়া বলে অভিহিত করা হতো। সাধারণ মানুষ তাঁদের খাজনা দিয়ে চাষবাস করতো। আর তাঁদের রাজত্বে তৈরি হয়েছিল অদ্ভুত এবং অবাক করা সব গল্প। শোনা যায় তাঁদের প্রতিপত্তি এতটাই বেশি ছিল যে মোঘল সম্রাট বাবরও বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন “এই বাঙ্গালীদের আমি দেখে নেব”।
বাঙালিরা ভীরু এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী নয় বলে যারা প্রচার করে এসেছেন, তাদের কাছে এই গল্পগুলি জানা ভীষণ জরুরী। বাংলার রাজাদের স্বতন্ত্র প্রতাপের ফলে সেই আকবর পর্যন্ত কোনো সম্রাটই বাংলার দখল নিতে পারেননি। বাংলার ভুঁইয়া রাজাদের মধ্যে অন্তরদ্বন্ধ ছিল অনেক। তাদের সেই নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহের জন্য বাংলা কোনদিন এক এবং সমষ্টিগত রাজ্যে পরিণত হতে পারিনি। কিন্তু এদের নিজেদের ক্ষমতা বলে এরা নিজেদের জায়গাটুকু রক্ষা করতে সমর্থ্য ছিলেন। বাংলার রাজারা যদি এক হয়ে একটি সমষ্টিগত শক্তিতে পরিণত হতেন, তবে মুঘলদের দ্বারা কোনদিনই বাংলা জয় করা সম্ভব হত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। গবেষকরাও এই বিষয়ে একমত হয়েছেন। কিন্তু এঁদের অন্তঃকলহ ও বিবাদ বাংলার সার্বভৌমত্বকে আঘাত করেছে বারবার। আর তার সুবিধা নিয়ে গেছে ভিনদেশী পাঠান মোঘলরা। এই পারস্পরিক বিবাদের ফলেই মোঘলদের সুবিধা হয়েছিল বাংলার সামন্ততান্ত্রিক প্রথাকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করে এই অঞ্চলকে মোঘলদের একটি সুবায় পরিণত করা। যদিও সেই কাজটি সম্রাট আকবরও সফলভাবে করতে পারেননি। তিনি বারবার সেনাপতি পরিবর্তন করে বাংলায় বাহিনী পাঠিয়ে চেষ্টা করেছিলেন ভুঁইয়াদের কব্জা করতে। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে সফল হয়ে উঠতে পারেননি শুধুমাত্র এখানকার রাজাদের শক্তিশালী নৌবহর এবং পদাতিক বাহিনীর জন্য। আর তার সঙ্গে বাংলায় মোঘলদের জন্য প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ তো ছিলই। আর সেই সঙ্গে ছিল এই অঞ্চলে পাঠানদের আধিপত্য। দিল্লির সিংহাসন থেকে পাঠানদের উৎখাত করে মোগলরা রাজত্ব পেয়েছিল বলে এই দুই বাহিনীর মধ্যে গড়ে উঠেছিল চিরশত্রুতা। আর সেই শত্রুতার রেশ ধরে বাংলার রাজাদের সরাসরি পক্ষ না দিলেও পাঠানরাও চিরকাল মোঘল আক্রমণকে প্রতিহত করে গেছে সাধ্যমত। কিন্তু জাহাঙ্গীরের সময়ে ইসলাম খান চিস্তি বাংলার সুবাদার হয়ে এলে, তিনি রাজধানী স্থাপন করেন ঢাকায়। আর সেখান থেকেই পরিচালনা করেন সমগ্র বাংলা সুবাকে। সেই সময় সম্পূর্ণভাবে ভূঁইয়াদের আধিপত্য কেড়ে নিয়ে তিনি সফল হন বাংলাকে মোঘল সুবায় পরিণত করতে।
মোঘলদের হাতে বাংলার একক নবাব দাউদ খান করনানি পরাস্ত হলে আর একক রাজত্ব কারও হাতে ছিল না। তখন আঞ্চলিক বিভিন্ন রাজাদের হাতেই শাসিত হতে থাকে আমাদের এই বঙ্গভূমি। আঞ্চলিক হলেও তাঁরা ছিলেন যথেষ্ট শক্তিশালী। এমন ছোট ছোট রাজন্যবর্গ ছিল প্রায় শ’খানেক। কিন্তু তারমধ্যে বারোজনের নাম পাওয়া যায় আকবরনামাতেও৷ আর তাঁরাই ছিলেন প্রবলভাবে শক্তিশালী। যাঁদের অসাধারণ সাহস ও প্রতাপের কথাগুলি গল্পগাথা নয়। দাউদ খানের মৃত্যুর পর থেকেই যেসব ছোট ছোট রাজ্য গড়ে ওঠে, তার উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হয় বাংলার রাজতন্ত্র। অর্থাৎ বলা যায় পরবর্তী সময়ে জমিদার প্রথার উৎপত্তি এই সময় থেকেই। ভূস্বামীরা নিজেদের রাজ্যটুকুর সীমা বাড়ানোর জন্য একে ওপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেও তাঁরা সকলেই ছিলেন মোঘলদের শত্রু। তাই এই একটি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতৈক্য ছিল। আর সেই মতৈক্যের উপর ভিত্তি করে বারবার লেগেছিল দুই পক্ষে লড়াই। ঠিক যেভাবে আমরা মোঘলদের বিরুদ্ধে রাজপুতদের লড়াইয়ের কথা জানি৷ ঠিক যেভাবে মারাঠাদের তীব্র আক্রমণে বারবার দিশা হারিয়েছে মোঘল সম্রাটরা। ঠিক সেভাবেই বাংলার দুর্ধর্ষ ভুঁইয়াদের দাপটেও মোঘলরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এমনই ছিল তাদের প্রতাপ৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।