• Uncategorized
  • 0

অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে প্রদীপ গুপ্ত – ধারাবাহিক – ২

পশমিনা
দ্বিতীয় পর্ব।

কাশ্মীর উপত্যকার দৈনন্দিন সমস্যা, রাজনৈতিক ঘাতপ্রতিঘাত ও প্রেমের এক অনুভূতিশীল জীবনালেখ্য।

গাড়িটা এসে দাঁড়াতেই দলে দলে ঘোড়াওয়ালারা ঘিরে ধরলো। চলিয়ে স্যারজি, ছে পয়েন্ট ঘুমায়েঙ্গে, দুধপাতরি মে যিতনা খুশবুদার জাগাহ্ হ্যায়, সবহিকো ঘুমাকে দিখায়েঙ্গে।
আমার শরীরটা খুব একটা জুতের না থাকায়, আমি গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম। বাকী সঙ্গীসাথীরা যে যার মতো কেউ পায়ে হেঁটে কেউবা ঘোড়াওয়ালাদের সাথে দরদাম করে ঘুরতে চলে গেলেন। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। সামনে রজতশুভ্র মৌনী শৃঙ্গ। তাঁর ওপরে সূর্য এসে তাঁর যাবতীয় সম্পদ অকৃপণ ভাবে উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে। সামনের চরাই ভেঙে একটা ছোট্ট ঝর্ণার দিকে এগুতে যাবো এমনি সময় —
— স্যারজি, চায়ে, কফি, কাওয়া, ম্যাগি কুছ কি জরুরত হ্যায় তো বাতায়েঙ্গে।
একজন বছর আটেকের সুন্দর ঝকঝকে বালক, মাথায় ফেজ, গায়ে কাশ্মীরি শালের কাজকরা হাঁটু ছাড়ানো কোট আর সাদা পাজামা। এসে সামনে দাঁড়ালো।
এতো সুন্দর ওর মুখশ্রী আর এতো সুন্দর কণ্ঠস্বর যেন মনে হলো একটা বুলবুল যেন বেহেস্ত থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো। আগামীকাল ওদের বড়ো পরব। সেজন্যই বুঝি এতো সুন্দর সাজে সেজেছে এই বালক।

আমার সেরকম কিছু খাওয়ার ইচ্ছে নেই। একেই শরীর খারাপ, তারওপরে আগামীকাল ভোর সাতটায় গুলমার্গের জন্য বেরোতেই হবে। ট্যুর ম্যানেজারের কড়া হুকুম। কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম, চায়ে, কফি ওউর কাওয়াকা ভাও কিতনা?
ও কি বুঝলো জানিনা, এসে আমার হাত ধরলো।
— স্যারজি, আপকি বহত মেহেরবানি। এককাপ পিনেসে দিল খুশ হো জায়েগা। চলিয়ে না স্যারজি।

চলিয়ে না মানে? কোথায় যাবো? সঙ্গীসাথীরা কে যে কোথায় ছিটকে গেছেন কে জানে? একা দাঁড়িয়ে থেকেই বা কি করবো?

— কাঁহা যানা হ্যায়? তেরে দুকান কাঁহা?
— ইয়ে তো নজদিক মে হি। চলিয়ে না স্যারজি।
দেবদূতের মতো সুন্দর ছেলেটা আমার হাত ধরে এগিয়ে চলেছে, আর আমিও মোহাবিষ্ট হয়ে এগিয়ে চলেছি। ছোট্ট একটা উৎরাই পেরিয়ে সামনেই একটা শর্ষে ক্ষেত। হলুদ ডানার প্রজাপতির দল যেন হাওয়ায় তাদের ডানা মেলে দিয়েছে।। গোটা পাঁচেক আপেলগাছ শাখাপ্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্পত্র গাছগুলোতে সবেমাত্র বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। ফুলের কুঁড়ির মতো পাতারা তাদের শীতের জড়তা কাটিয়ে উঁকি দিচ্ছে শাখাপ্রশাখায়। গাছগুলোর মাঝমাঝে নাম না জানা কিছু জংলা গাছ অজস্র সাদা থোকা ফুলে ভরে রয়েছে।
— আইয়ে স্যারজি।
দোকান কোথায়! একটা কাঠ আর ইটে তৈরী সুন্দর ডুপ্লেক্স বাড়ি। পাহাড়ের বাড়িগুলোর নক্সা যে কারা করেন কে জানে? একদম ছবির মতো সুন্দর।
— স্যারজি ইহা বৈঠো।
একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিলো ছেলেটা।
— আপকা কেয়া পসন্দ হ্যায়, চায়ে – কফি –
— আচ্ছাসে এক কাওয়া বানাও। লেকিন জলদি।
— স্যারজিকো লিয়ে এককাপ কাওয়া বানাও জলদ সে জলদ।
— ফিকি ইয়া শক্কর ডালুঙ্গি?

একটা সুরতরঙ্গ বেজে গেলো। এতক্ষণে নজরে এলো একজন যুবতী গ্যাসের উনুনে শসপ্যানে দুধ ঢাললেন।

— স্যারজি, আপকা শক্কর চলেগা ইয়া নেহি?
এ কদিন ধরে চা কফি খেতে খেতে ফিকি শব্দটার সাথে পরিচয় ঘটেছে।
— ফিকি চাহিয়ে। লেকিন ও যারা কড়ক বানাইয়ে।

একঝলক মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন — সুগার হ্যায় আপকা?

নীল আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের মতো দুটো চোখ, লাল টিউলিপ ফুলে রাঙা দুটো ঠোঁট, গোলাপী গুলমুস ফুলের রঙে রাঙা কপোল। এতোদিন ধরে কাশ্মিরী মহিলাদের সৌন্দর্যের কথা শুনে এসেছি। আজ যিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁর সৌন্দর্যের তুলনা যে কার সাথে ভাববো সেটা এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছিনা।

— জ্বী হ্যাঁ।
— সামহাল কে রহে। বো বহুত…

সেই যুবতী না কি কিশোরী কী কথা যে বলে যাচ্ছে সেসব শব্দ আমার কানে ঢুকছে না। আমি শুধু তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। হঠাৎ করেই যেন জ্ঞান ফিরলো।
— বাবা কোথায় তোমার?
— ওরা ওকে মেরে ফেলেছে।
— কারা?
— দুশমন লোগোনে।
— কেন?
— সে ঠিক বলতে পারবোনা স্যারজি। তবে আদমি বহত আচ্ছা থা। আচ্ছা বাবুজি কোই দেশ কা দুশমন হোগা তো উসিকি আপনা প্যায়ারাকো কুছ না কুছ তো, সিরফ একবার মুঝে বোলা থা — শাহানারা হাম আউর জাদা দিন…
ওড়নার খুঁটে চোখ মুছলো মেয়েটি। শাহানারা। আমি কি করবো, কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা।
— শাহিন, স্যারজিকো কাওয়া দে দো বেটা…
— তব শাহিন দো বরস কে থা।
— আভি তুম কোন সা ক্লাস মে পড়তে হো শাহিন?
— স্টান্ডার্ড টু।

শাহিনের মাথার চুলে সামান্য একটু আদর করে, কাওয়ার কাপে ঠোঁট ছোঁওয়ালাম। সারাদিনের ক্লান্তি যেন মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। গরমগরম কাপ শেষ করে একটা পাঁচশো টাকার নোট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাঁটা লাগালাম।
— স্যারজি, হামারা পাস খুদরা নেহি হ্যায় স্যারজি, সিরেফ ষাট রুপেয়া হুয়া। স্যারজি খুদরা দিজিয়ে না।

হাতের নাগালে যে ঘোড়াওয়ালাকে পেলাম, কোন কথাবার্তা না বলেই চেপে বসলাম ঘোড়ার পিঠে। চলো ভাইয়া, যারা জলদ হ্যায়।

পেছনে পেছনে ছোট্ট শাহিন হেঁটে আসছে। আমি কিছুতেই বলে উঠতে পারলাম না, আগামীকাল তোদের পরব রে শাহিন, এই অচেনা অজানা জ্যেঠুর সামান্য উপহারটুকু দিয়ে একটা ফেজ কিনিস।

আকাশছোঁয়া পাইন আর দেবদারুর ফাঁক দিয়ে বিকেলের আলো সারাটা উপত্যকা জুড়ে অপূর্ব সুন্দর মায়াজাল বিছিয়ে দিয়েছে। আমার কানে তখনও বেজে চলেছে — সামহাল কে রহো স্যারজি, সুগার বহত খতরনাক বেমারি হ্যায়।
ঘোড়া খুরের শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে — পেছনে পড়ে রইলো ছোট্ট শাহিন আর নীল আকাশের বুকে ভেসে চলা মেঘের মতো নিষ্পাপ দুটো চোখ, রাজকীয় সৌন্দর্যের গোলাপ বাগানের প্রজাপতি শাহানারা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।