সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১১)

শহরতলির ইতিকথা

এবারও রমা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি;না,কোনো হা-হুতাশ,ওদের বাড়ি থেকে শোনা যাচ্ছে না;কেবল,সন্ধ্যেবেলায় নিভাননী দেবী,দরজা বন্ধ করে যাবার সময় স্বগতোক্তি করছে,”এঁটো পাতা কি স্বর্গে যায়?”

সজীব-রাজীবের কানে, নিভাননীর এ উক্তি বিস্ময়কর সৃষ্টি করলেও,হাজরা-দম্পতির আশঙ্কা যে সত্যি হয়েছে, তা জেনে, হৈমবতী খুশি হয়েছে কি না,তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আবারও যদি রমা,পরীক্ষায় বসতে চায়,তবে,সজীবের সঙ্গে,স্কুল-ফাইন্যাল
পরীক্ষায় বসতে হবে।সজীব-রাজীবের রবার্ট ব্রুসের কথা মনে পড়ছে; ছ’বার অসফল হলেও, সাতবারের বার সফল হয়েছিলেন,বলে উল্লেখ আছে;দেখা যাক, রমার ভাগ্যে সাফল্যের শিকে কতবারে ছেঁড়ে!

সজীবতো পড়াশোনায় মোটামুটি; ক্লাবে,শরীর-চর্চায় মন দেয় বেশি;অবশ্য,তার চেহারাটাও মোটামুটি
দেখনসই হয়েছে;জেলায় শরীর-চর্চা প্রতিযোগিতায় ‘এ’গ্রুপে স্থান পেয়েছে।
বাড়িতে তো পড়াশোনার পরিবেশও নেই ,আবার, বইপত্রও অপ্রতুল। বাবা-মা’র সঙ্গে, কথাও প্রায় বলে না বললেই চলে।বাজার, দোকান ,সবই রাজীবের দায়িত্বে। অল্পকয়েকদিন আগে,রাস্তা দিয়ে বাবার সঙ্গে বাজার যাবার সময় স্কুলের বন্ধুরা বলেছে,”হ্যারে,ওটা কি তোর দাদা?” ব্যস,তারপর আর হাজরা মশাই ‘র সঙ্গে সে কোনোদিন বাজার যায়নি,আর ,ধর্মদাসবাবুও ওকে বাজার যাবার জন্য চাপাচাপি করেনি।এবার তো, ও একটা পাস দিতে চলেছে,তাই ওর ছাড়; রাজীবকেই সব দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে;বাড়ির এণ্ডি-গেণ্ডির দেখভাল তো এখন রজতের।
নিভাননীদেবী এর কিছুদিনের মধ্যেই আবার কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে,আর ফুল পুঁতেছে রজত।জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর কামনার ফলশ্রুতিতে,সংসারের কাজ-কর্ম করতে করতেই সে হয়ে গেল স্কুল-ছুট।

সংসারে কামনা-বাসনার অন্ত নেই;নিঃস্ব হয়ে থাকা তো সন্নাস নেওয়া;মৈথুন তো জীবনের অঙ্গ,তবে চলুক উল্লাসধ্বনিতে মৈথুনক্রিয়া;উৎপাদিত বস্তুর প্রতি নজর না রাখলেও চলবে;জন্ম দিয়েছেন যিনি,আহারও যোগাবেন তিনি,সবই ঐ ভগবানের ইচ্ছেয় ঘটছে;মানুষ, কেবল পেট নিয়ে জন্মায় না,ভগবান দু’টো হাত দিয়েও পাঠান;শুনিয়ে যাও পিতা স্বর্গ,মাতা স্বর্গাদপি।পুত্র-কন্যারা প্রশ্ন করলেই, উত্তর হবে ছিঃ!বাবা-মা’র সম্বন্ধে এমন কথা! পশুও তো জন্ম দেয়,মা পশুও অসহায় বাচ্চাকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়; মানুষের সঙ্গে পশুর তো একটা গুণগত পার্থক্য থাকার কথা। এসব চিন্তায় রাজীবের মন ক্ষত-বিক্ষত।দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যা;না সেদিকে স্বাধীনতার প্রথম দিকে কেউ নজরই দিল না।ম্যালথাসের এ বিষয়ে বক্তব্যকে সবাই উড়িয়ে দিয়েছিল।

না আছে বইপত্র,না আছে জামা- জুতো ,আবার না আছে পরিবেশ;রাজীবের মনের মধ্যে অসন্তোষ জমা হতে থাকে,শুধুই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে সহোদর-সহোদরার সংখ্যা। রাস্তায় যেতে যেতে ,বাজার, দোকানের পথে রাজীব,অধীত বিষয়
মনে মনে আওড়িয়ে চলে।বাড়ি থেকে দূরের গমকলে যেতে হয়,রেশনে পাওয়া গম ভাঙ্গাতে,প্রায় ছুটির দিনটা কেটে যায়, ওকাজে।রাতে জানলার শিকে হ্যারিকেন বেঁধে ,চলাফেরা করতে করতে সে চীৎকার করে পড়ে,পাছে ট্যাঁ,ভ্যাঁ আওয়াজ তার কানে না এসে পৌঁছায়।সময়, সুযোগ ও গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলোতে,বই খাতা বগলে সে চলে যায়,গঙ্গার ধারে, বাঁধানো বট- অশ্বত্থের
চাতালে;নির্জনে সে চিন্তা করে,না, একটা পাস দিয়ে সে আর পড়বে না,স্বাবলম্বী হবে,সে চাকরি করবে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *