ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || সুব্রত সরকার – ২

|| জাপানের ডায়েরি – ২ ||
হোটেল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনালে আজ দ্বিতীয় বার প্রবেশ করলাম। দু’বছর আগে মিশর ভ্রমণে যাওয়ার আগে গেট টুগেদার মিটিংটা এখানেই হয়েছিল। মনে পড়ে গেল সেই সুখস্মৃতি!..
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১৩ দিনের মিশর ভ্রমণ খুব ভালো হয়েছিল। Travel Live এর সঙ্গেই গিয়েছিলাম। এবারও ওদের সঙ্গেই যাচ্ছি জাপান।
আজ ১৫ মার্চ, শনিবার। গতকাল দোল ছিল। আমাদের যাত্রা শুরু ২০ মার্চ রাত শেষ করে ২১ মার্চের কাক ভোরেই । ১.৫৫ মিনিটের উড়ান। সফর শুরুর আগে এই গেট টুগেদার মিটিংটা খুব দরকার। অনেক খুটিনাটি জিনিস আগাম জেনে সতর্ক হয়ে যাওয়া যায় বিদেশ ভ্রমণে।
হোটেল হিন্দুস্থানের রিজেন্সি রুমে ঢুকে দেখলাম আমাদের জন্য পর পর অনেক টেবিল সাজানো রয়েছে। টেবিলে রাইটিং প্যাড, পেন, জলের বোতল ও লজেন্স। একটু অপেক্ষার পর একে একে জাপানযাত্রীরা আসতে শুরু করলেন। ২৫ জনের দল তৈরী হয়েছে শুনলাম। সঙ্গে সংস্থার একজন ম্যানেজার থাকবেন।
আলাপ পরিচয় কম বেশি হলো সকলের সঙ্গেই। যদিও আসতে পারেন নি কয়েকজন। শুনলাম তাঁরা কলকাতার বাইরে থাকেন। সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে যাবেন। দুজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো- শংকর পালিত ও ভূপেন রায়। অনেকেই দেখলাম নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ করছেন। কেউ কেউ তো বছরে দু-তিনবার। সংসারের বাঁধন একদম আলগা হয়ে গেছে এমন কয়েকজনকেও পেলাম! তাই তাঁরা বিবাগী মনে একলা চলো রে বলে বারেবারেই বেড়িয়ে পড়েন নির্ভরযোগ্য ভ্রমণ সংস্থাদের সঙ্গে। বিদেশ ভ্রমণে যাত্রীদলে সাধারণত সিনিয়র সিটিজেনদের পাল্লা ভারী থাকে। দুজন প্রবীণা রয়েছেন এই দলে। তাঁরা একলাই বেরিয়েছেন। তাঁদের একজন প্রাক্তন অধ্যাপিকা, অপরজন গাইনোকোলজিস্ট। দলে আরও একজন প্রবীণ ডাক্তার ছিলেন। তিনিও একাই এসেছেন। দেখলাম স্কুল পড়ুয়া দুই বালিকা রয়েছে। আমার বেশ আনন্দ হলো। ছোটরা দলে থাকলে একটু মজা, একটু খুনসুটি, একটু সহজ সরল কথাবার্তা বলে হাল্কা থাকা যায়।
আলাপ পরিচয় পর্ব মিটতেই হাতে চলে এলো ফাইল- তার মধ্যে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র রয়েছে। পাসপোর্ট জমা দেওয়া ছিল ভিসার জন্য। পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে হাতে নিয়ে দেখলাম আমার ভিসার সময়কাল ৩ মার্চ থেকে ৩ জুন, ২০২৫। অর্থ্যাৎ এই তিন মাসের মধ্যে জাপান ঘুরে বেড়িয়ে চলে আসতে পারি। ওদেশে থাকা বা বেড়ানোর জন্য ধার্য করা হয়েছে মাত্র ১৫ দিন। জাপানের ভিসা পেতে বাড়তি অনেক ডকুমেন্টস জমা দিতে হয়েছিল। এব্যাপারে ওরা একটু সাবধানী। সহজে ভিসা পাওয়া যায় না। ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, ফিক্সড ডিপোজিট, পেনশন হোল্ডার কার্ড চেয়ে নিয়েছিল।
এরপর দেখে বুঝে নিলাম বিমান যাত্রার টিকিট। যাওয়া ও আসা দুটোই থাই এয়ারওয়েজ ইন্টারন্যাশনাল এ করা হয়েছে।
প্রথমে কলকাতা নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে সুবর্ণভূমি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ব্যাঙ্কক। নন স্টপ বিমান। সময় লাগবে প্রায় আড়াইঘন্টা ।আকাশপথে এই দূরত্ব ১৬৩৫ কিমি। সেখানে আড়াই ঘন্টার লে ওভার। তারপর ব্যাঙ্কক থেকে কানসাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ওসাকা। সময় লাগবে প্রায় সাড়ে পাঁচ’ ঘন্টা। আকাশপথের দূরত্ব ৪১৫৭ কিমি।
হিসেব করে দেখলাম দু’বার বিমান সফরে মোট সময় লাগবে আট ঘন্টা। মোট কিলোমিটার ৫৭৯২ কিলোমিটার।
আজ বিদেশ ভ্রমণে খুব সহজেই আকাশপথে পৌঁছে যাওয়া যায় বহু সূদূরে। আজ থেকে একশো আট বছর আগে রবীন্দ্রনাথ জাপানে গিয়েছিলেন তোশামারু জাহাজে করে। প্রায় একমাস সময় লেগেছিল জাপানে পৌঁছাতে। সে জাহাজযাত্রার সরস বিবরণ পড়েছি তাঁর জাপান-যাত্রীতে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “জাহাজ ছেড়ে দিলে। মধুর বহিছে বায়ু, ভেসে চলি রঙ্গে।”
রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণের কথা-কাহিনি ” সবুজ পত্র” তে ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলেন। তাঁর জাপান দেখার মুগ্ধতা ও বিস্ময় জাপানযাত্রীর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিবেকানন্দও তাঁর মুগ্ধতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন,”If there is one country which I commend my countrymen to visit, It is Japan. She has shown that we can take the boons of Western Civilization without the curses it carries. Such improvement in such a short time is unique in world history. We must see it to believe it, and learn from it.”
অন্নদাশঙ্কর রায় জাপানে গিয়েছিলেন ১৯৫৯ সালে। আজ থেকে ৬৬ বছর আগের জাপানকে দেখে এসে তাঁর ভালোলাগার কথা ধারাবাহিকভাবে “দেশ” পত্রিকায় লিখেছিলেন। সেই ভ্রমণকথা এতটাই উচ্চমানের রচনা হয়েছিল যে, “জাপানে” লিখে অন্নদাশঙ্কর রায় সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার পেয়েছিলেন।
“জাপান থেকে ফিরে” নারায়ণ সান্যালের একটি অসাধারণ বই। ১৯৭০ সালে নারায়ণ সান্যাল গিয়েছিলেন জাপানে। তাঁরও অভিজ্ঞতার নির্যাস ও মুগ্ধতা এই বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে।
সেই জাপানে যাওয়ার ইচ্ছে ও আগ্রহ ছিল আমার বহুদিনের। সময় ও সুযোগের মোলাকাত তো সব সময় হয় না। এবার হতে যাচ্ছে। আমি দেখব আরও আধুনিক, আরও উন্নত জাপানকে। মাত্র দশ দিনে কতটুকুই বা দেখতে পাব!.. তবু চোখ মনকে সার্থক করে আসতে চাই।
ফেরার টিকিট থাই এয়ারওয়েজ ইন্টারন্যাশনালেই। ফিরব টোকিও থেকে ব্যাঙ্কক হয়ে কলকাতা। টোকিও থেকে ব্যাঙ্ককের আকাশপথের দূরত্ব ৪৬৪৬ কিমি। সময় লাগবে সাত ঘন্টা। তার পর ব্যাঙ্কক থেকে কলকাতা সেই একই দূরত্ব ১৬৩৫ কিমি, সময় লাগবে আড়াইঘন্টা।
বিমানের টিকিটের পর দেখে নিলাম ইন্সুরেন্সের কাগজ। বিদেশ ভ্রমণে ওভারসিজ মেডিকেল ইন্সুরেন্স করে যেতেই হবে। পলিসি পেপারে নমিনির নাম দেখে নিলাম ঠিকই আছে – সুচেতনা সরকার।
এরপর দেখলাম You must carry ও you should carry র তালিকা। সেখানে যা যা উল্লেখ আছে সব মনে করে গুছিয়ে নিতে হবে। এই ব্যাগ গোছানোর ঝামেলা সবচেয়ে বেশি পোহাতে হয় বিমানযাত্রায়। কোনটা চেক ইন লাগেজে নেব, কোনটা কেবিন লাগেজে রাখব, কোনটা নিজের সঙ্গে রাখব এটা একটা মারাত্মক অঙ্ক কষে করা কাজ। আমি এব্যপারে নিজের ভুলে দু’বার দুটো দামী জিনিস খুইয়েছি এয়ারপোর্টে। তাই এবার বাড়তি সর্তক হয়েই লাগেজ প্যাক করতে হবে।
এরপর জানলাম কারেন্সি ও সিম কার্ডের কথা। ট্রাভেল লাইভের ব্যাবস্থাপনায় দুজন চলে এসেছেন সিম কার্ড ও জাপানের কারেন্সি ইয়েন নিয়ে।
আমি আগে থেকেই মনস্থির করে রেখেছিলাম এবার থেকে বিদেশ ভ্রমণে মোবাইলের সিম আর বদলাব না। কারণ এয়ারপোর্ট ও হোটেলে ওয়াই ফাই সবসময় পাওয়া যায়। তখনই নেট অন করে দরকারী কাজ ও হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে নেওয়া সম্ভব। জাপান আমাদের থেকে সময়ের হিসেবে সাড়ে তিন ঘন্টা এগিয়ে। তাই সেই হিসেব করে বন্ধু, প্রিয়জন ও “সবুজ পাঠ- অন্যভুবন” এর দিদিমণিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে কোনও অসুবিধা হবে না। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই বা থাকি না কেন “সবুজ পাঠ – অন্যভুবন” আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। এ বড় প্রাণের আরাম, আত্মার আনন্দ!..
এবার হেল্প ডেস্কে গিয়ে আজকের দিনের Currency Conversion Rate জানলাম-
1 USD: INR 86.55 approx
1 USD: 148.64 YEN approax
1 INR: 1.72 YEN approax
অর্থ্যাৎ আমাদের টাকার চেয়ে ডলারের মূল্য অনেক বেশি, আবার আমাদের টাকার চেয়ে ইয়েনের মূল্য কম!..
জাপানের ইয়েনের চেয়ে আমাদের টাকার মূল্য বেশি জেনে বেশ অবাক হলাম!..পরে জেনেছিলাম ওদের জনসংখ্যার নিরিখে জাপানের এই ইয়েন যথেষ্ট শক্তিশালী। একে বলে ইকনমিক্সের জটিল ধাঁধা!..
ইয়েন একমাত্র দশ হাজার টাকার ছিল হেল্প ডেস্কে। একশো, পাঁচশো, হাজার, পাঁচহাজার কিছুই নেই। তাই আর ইয়েন সংগ্রহ করা হলো না। আমার কাছে কিছু ডলার আছে। জাপানে পৌঁছে তা দিয়ে ইয়েন নিয়ে নিতে পারব বলে জানলাম। ইয়েন অনেক দরকার হবে তা নয়, হিসেব করে দেখলাম, এই প্যাকেজ টুরে আমাদের তিনটে লাঞ্চ নিজেদের পয়সায় করতে হবে। আর বাকি খরচ সব সংস্থার।
দশ ডলারে মোটামুটি ভদ্রস্থ লাঞ্চ নাকি করা সম্ভব জাপানে। দশ ডলার মানে ভারতীয় টাকায় ৮৭৭/ টাকা কমবেশি। ইয়েনে হবে ১৫০৮/। সুতরাং তিনটে লাঞ্চ মানে তিরিশ ডলার, আর হাতে রাখতে হবে কিছু, তাই আপাতত ৫০ ডলার ভাঙিয়ে সাড়ে সাত হাজার ইয়েন পকেটে রেখে ভ্রমণ শুরু করতে কোনও অসুবিধা নেই!..
গেট টুগেদার মিটিং শুরু হয়েছিল আড়াইটেয়।
ঘড়িতে এখন বাজে প্রায় পাঁচটা। মাঝে দু’বার কফি খাওয়া হয়েছে। কাজের কথা অনেক হলো। জানলামও অনেক কিছু। এবার হাতে এলো উপহার ট্রাভেল লাইভের টুরিস্ট ব্যাগ, হ্যান্ড ব্যাগ, টুপি ও ট্যাগ। উপহার পাওয়ার আনন্দ সব সময়ই মনকে বেশ খুশি করে দেয়। হাতে পেয়ে বেশ পছন্দও হলো জিনিসগুলো। ধন্যবাদ জানালাম আমাদের টুর ডিরেক্টর অশোক মুখার্জিকে।
রিফ্রেশমেন্টের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। বুফে সিস্টেমে নিজের পছন্দ মত খাবারগুলো খেলাম। গল্প করলাম হবু সহযাত্রী বন্ধুদের সঙ্গে। হাতে আর মাত্র পাঁচদিন। তারপরই শুভযাত্রা। উড়ে যাব পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সুন্দর এক দেশ জাপানে। একটা নতুন দেশে ভ্রমণে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় যতটুকু জানকারি দরকার, তার চেষ্টা করে চলেছি। নিজেকে গুছিয়ে রেখেছি সাপ্তাহিক ধারাবাহিক “জাপানের ডায়েরি” লিখব বলে। একটা নতুন দেশকে দেখা ও লেখা বেশ শক্ত কাজ। তবু লিখতে তো চাই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেের স্বীকারোক্তি রয়েছে তাঁর “জাপান -যাত্রী”র পাতায় – ” একটি কথা তোমরা মনে রেখো- আমি যেমন যেমন দেখছি তেমনি তেমনি লিখে চলেছি। এ কেবল একটা নতুন দেশের উপর চোখ বুলিয়ে যাবার ইতিহাস মাত্র।…. জাপান সম্বন্ধে আমি যা কিছু মতামত প্রকাশ করে চলেছি তার মধ্যে জাপান কিছু পরিমাণে আছে, আমিও কিছু পরিমাণে আছি, এইটে তোমরা যদি মনে নিয়ে পড় তা হলেই ঠকবে না। ভুল বলব না, এমন আমার প্রতিজ্ঞা নয়; যা মনে হচ্ছে তাই বলব, এই আমার মৎলব।”
হোটেল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল থেকে রবীন্দ্রসদন মেট্রো সামান্য পথ। কেমন একটু উদাসী খুশি খুশি মনে চলে এলাম। সঙ্গী ছিলেন সদ্য পরিচিত সহযাত্রী শংকর পালিত। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি, হঠাৎ মনে পড়ল, আর কয়েকটা দিন পরেই তো চড়ব জাপানের বিখ্যাত সেই বুলেট ট্রেন! ঘন্টায় যার গতিবেগ ৩২০ কিলোমিটার!..
মনটা কেমন হারে রে রে রে করে উঠল! আমি বিভোর হয়ে গেলাম পরমানন্দে। মন মোর মেঘের সঙ্গী হবে আর কয়েকটা দিন পরেই, ভ্রমণ আমার কাছে সুধাসম। আমি আকন্ঠ পান করেই আছি! তাই সুধাকণ্ঠ হৃদয় গুন গুন করে গায়, “উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে…মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে…”
ক্রমশ..