রথ আসতে আর দেরী নেই। অঞ্চলের রথতলার মাঠে, সোজা রথে ও উল্টো রথের দিন মেলা বসে; হরেক রকম সামগ্রীর বেচা-কেনা, সঙ্গে মেলার পাশের জমিতে ম্যাজিকওয়ালার তাঁবুও পড়ে। পুরো রথ-তলা তাঁবুতে থাকে ঢাকা; রথের পরের দিন থেকেই ঐ তাঁবুর তলায় শুরু হয় যাত্রাপালার প্রতিযোগিতার আসর; চলে, উল্টো-রথের আগের দিন পর্যন্ত। তাই এখন, শুরু হয়ে গেছে পথে ঘাটে, নানা অ্যামেচার যাত্রাদলের যোগদানের কথা, তাদের পালার কথা; প্রতিযোগিতা বলে কথা!
অঞ্চলের অধিষ্টাত্রী দেবী আনন্দময়ীর পুজো প্রাঙ্গনেই, টিনের চাদরে সারাবছর ঢাকা থাকে কৃষ্ণের রথ; আনন্দময়ী-মন্দির সংলগ্ন জমিতেই গড়ে উঠেছে সন্তান-সঙ্ঘ, এ অঞ্চলের ছেলেদের শরীর-মন গড়ে তোলার একমাত্র আদর্শ প্রতিষ্ঠান; বঙ্কিমবাবুর ‘আনন্দমঠ’-এ অনুপ্রানিত হয়ে অঞ্চলের বিজ্ঞ মানুষজন এ ক্লাব তৈরি করেন। এই সঙ্ঘই, রথ ও যাত্রা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করে আসছে। মন্দিরের পিছনের জমিতে ছেলেদের শরীর-চর্চা ও জিমন্যাষ্টিক খেলার অনুশীলন হয়ে থাকে; কোনো ঘর নেই, তাই ছেলেদের মধ্যে বড়রা ঘর করার পরিকল্পনা করেছে। প্রত্যেক ছেলে,গঙ্গায় চান করবার সময়, প্রতিদিন জল থেকে বেশ কিছু ইট তুলে পাড়ে জমা করবে। গঙ্গা- পাড়ের-ইট-খোলার মালিকেরা, নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের গঙ্গার ধারের বাড়ির ভাঙ্গন আটকাতে বহু ইটের আধলা জলে ফেলে দেয়, আবার, কিছু গোটা ইট বানের জলে গঙ্গায় এসে যায়। ওগুলো তো কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, তাই ওগুলো নিলে কোনো কথা হবে না। বিকেল বেলায় শরীর চর্চার পর রিলে করে, সঙ্ঘের জায়গায় আনা চলে। অবশ্য, এর আড়ালে,পাশের টালি-খোলা থেকেও ইট চুরি চলে; এই টালি খোলার সংগে বিবাদটা পুরোনো, যতদূর জানা যায়, অনুশীলনের জায়গাটা ওদের পুকুরের পাড়। যাই হোক, অনুশীলনের পাশে থাকা পুকুরের জলে করোগেট টিনের উপর থাক করে ওসব ইঁট সাজিয়ে রাখা হয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এটা, এভাবেই হবে সঙ্ঘের ঘর। এখনও পর্যন্ত, খেলার জিনিসপত্র অদূরে ঐ পৃষ্টপোষক, কুন্ডুদের পুজোর দর- দালানেই রাখা চলে।
রঞ্জন ও ওর দাদা সজীব, এ সঙ্ঘের সংগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ওরা শরীর চর্চার সংগে জিমন্যাষ্টিকের খেলায়ও অংশ নেয়। সঙ্ঘের ছেলেদের এ অঞ্চলে বেশ.সুনাম আছে; বড়দের কয়েকজনের কথায় ধর্মদাস বাবু,ছেলেদের ঐ ক্লাবের সদস্য করিয়েছে; করালে হবে কী!পুজো বা ডিসেম্বরে পরীক্ষা শেষে স্কুল বন্ধের সময়,পরিবার নিয়ে ধর্মদাসবাবু নিজের দেশের বাড়িতে চলে যায়; আর এই সময়ই, সঙ্ঘের বাৎসরিক জিমন্যাষ্টিক প্রদর্শন অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে, এ নিয়ে, ছেলেদের সংগে ধর্মদাসবাবু ও হৈমবতীর মধ্যে মতানৈক্য হয়ে থাকে। সারা বছর প্রাকটিস করলেও, প্রদর্শনের সময়,ওরা থাকে না। তাই, ক্লাবের কর্মকর্তারা আর ওদের নিয়ে অনুশীলন করায় না।
ধর্মদাসবাবুর কাছে, দেশের বাড়ি গেলে, ঐ কয়েকদিনের সংসার খরচ বাঁচে,আবার দেশের সংগে যোগাযোগটাও থাকে, আর হৈমবতীর বাপের বাড়িও ঐ গ্রামে, সুতরাং, তিনি তো স্বামীর কথায় যে পোঁ দেবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!যদিও দেশের বাড়ির লোকজন ওদের পাত্তা দেয় না, একটা অজানা কারনে, হাজরা পরিবারের সবাই ধর্মদাসকে দোষারোপ করে থাকে, তার সত্যতা কিন্ত কেউ জানে না।কোলকাতায়, হাজরা পরিবারের অংশীদারীত্বে দোকান ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে, সে দোকান গেছে উঠে; ধর্মদাসবাবুর ছোটকাকার পরিচালনায় সে দোকান চলতো; গ্রহের ফেরে, তিনিও দু’দিনের জ্বরে পক্সে আক্রান্ত হয়ে, ভাইপোকে কলঙ্কের ভাগী করে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। সুতরাং, বিশ্বাস- অবিশ্বাসের বাতাবরনে একটা কিছু যে চাপা রয়েছে সকলের মনে, তা ছোটবেলা থেকেই রঞ্জণের চোখ এড়ায়নি। সবাই এক পরিবারে, কিন্ত ওরা যেন এ সংসারে অনভিপ্রেত, তা রঞ্জনের, কাকা, কাকিদের কথাবার্তায় বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে, এমন কী, ওদের ঠাকুমার আচরনেও তা প্রকাশ পায়, তাই ধর্মদাসবাবুর সংঙ্গে রঞ্জনের বাদানুবাদ হয়ে থাকে; ছোট সে, প্রতিবাদে, তারই পিঠেই পড়ে ঘা;মফঃস্বলের সংসার খরচা বাঁচানোই, ধর্মদাসবাবুর কাছে মুখ্য, ছেলেদের মানসিক গঠন, তাদের আনন্দ এখানে গৌন; হয়তো,অভাবই ধর্মদাসবাবুকে, এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
এবার রথের উৎসবে, ধর্মদাসবাবুর যাত্রাপালার দল, ‘রাণাপ্রতাপ’ যাত্রা পালার অভিনয় করবে। ধর্মদাসবাবু,রাজা মানসিং’র অভিনয়ে আছেন। রাজপুতদের বড় বড় গোঁফ লাগিয়ে ধর্মদাসবাবু, চিতোরে এসেছেন; রাণার সঙ্গে কথাবার্তার উত্তেজনার মধ্যে, মানসিং’র গোঁফের একদিক গেল খুলে; এক হাতে গোঁফ ধরে, কথা বলতে বলতে, অন্যদিকটাও ঝুলে মুখের উপরে এসেছে; দর্শকেরা,হৈ, হৈ করতেই, মানসিং, গোঁফ খুলে তরবারি বার করে, রাণাকে যুদ্ধে আহ্বান করে, তরবারি ঘোরাতে ঘোরাতে আসর ছেড়েছে। লোকের মুখে প্রবাদ চালু হয়েছে, ‘দেখো বাবা, ধম্মোদার মত যেন কম্মো না হয়’।
অঞ্চলের কয়েকজন অসামাজিক যুবক,স্কুল যাবার পথে, মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণ করে; গার্জেনরা ক্লাবের ছেলেদের কানে এ কথা তুলতেই, ক্লাবের ছেলেরা দল বেঁধে অঞ্চলের সিনেমা হলের সামনে ঐ ছেলেদের পেয়ে চালালো বেদম মার। সজীব ও তার সহপাঠী জেলার মধ্যে শরীর চর্চায় পুরস্কৃত হয়েছে। রঞ্জন, তার বন্ধু রবিন ও সত্যের কাছে, বুলডকের মত সেই অসামাজিকদের গলা চেপে ধরার ছবি পরিণত বয়সেও স্পষ্ট; সবাই চীৎকার করছে, “ওরে মরে যাবে, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।” সেই থেকে সাধারণ মানুষের কাছে সন্তান সঙ্ঘের ছেলেদের একটা অন্য ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে।ছেলেগুলো ছিল প্রখ্যাত রাজনৈতিক দলনেতা রাম চাটুজ্জের লোক। সবাই, রামবাবুর উপস্থিতির অনুমানের খবর পেয়ে,অঞ্চলের নিকটেই সাহাগঞ্জের শক্তিসংঘের লোকের কাছে এ খবর পৌছে যায়; শক্তিসংঘের ছেলেরা, রামবাবুকে পথেই আটকায়, “বলে, গেলে আর রামবাবুকে ফিরে আসতে হবে না”। রামবাবু, রাজনীতি করে, অবস্থা বুঝে, এ অঞ্চলে আসার চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছে।
একবার যাত্রাপালার সময়, ঐ অভদ্র ছেলেরা মেয়েদের দিকে খারাপ মন্তব্য করে; পাছে,যাত্রাপালার বিঘ্ন ঘটে, তাই ওদের নিয়ে অনুশীলনের জায়গায় অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে সংঙ্ঘের কয়েকজন সদস্য শায়েস্তা করার মনস্থ করে। কিন্ত, কে আর জানে, ওরা ছিল দলে ভারি; তাই সঙ্ঘের তীরন্দাজ ছেলেটিকে ওরা খুব মারে। সেই কথা মনে করে,মস্তানদের এমনভাব টুঁটি চেপে ধরেছিল সজীব ও ওর সহপাঠী, যে শেষ পর্যন্ত বাঁশের সাহায্যে নিয়ে ওদের ছাড়ানো হয়। সে সব এখন ইতিহাস বলে বোধ হয়। এ অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাইরের লোকের থাকার প্রবনতা এ অঞ্চলে বেড়েই চলেছে।
চলবে