ক্যাফে ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ৩১)

দশম অধ্যায়

প্রথম পর্ব

কাহিনীকার ও বায়োস্কোপওয়ালা নিজেদের জিনিসপত্র গুটিয়ে নেবার উদ্যোগ নিচ্ছে। ছেলেদের মন ভারাক্রান্ত। দেশের স্বাধীনতায় রয়েছে রক্ত-স্রোত, রয়েছে হাজার শহীদর রক্ত-রেখা। আর, অহিংসা- আন্দোলনের পথ বেয়ে গান্ধীজি এনেছেন স্বাধীনতা বলে দেশের সরকার মিথ্যা প্রচার করে; সুতরাং,তারা ঘোর অন্যায়কারী, মিথ্যাবাদী; ইংরেজদের সংঙ্গে তাদের রয়ে গেছে গোপন মিতালি। তবে তো, ঐ পুজুরিকেও জাতির জনক বলা পাপ, শহীদদের প্রতি অবমাননা; ছেলেদের মনে, ইতিহাস বিকৃতকারীদের প্রতি জন্মেছে ক্রোধ, ঘৃণা; উত্তেজনায় ওদের মন পরিপূর্ণ।

দূরে একজন আসছে, তার দু’কাঁধে দু’জন হেলে রয়েছে, ফলে, লোকটির চলৎশক্তি ব্যাহত হচ্ছে। কাহিনীকার, তার দিকে তাকিয়ে বলছে, “খোকাবাবুরা, ঐ যে লোকটি আসছে, ওনার মুখ থেকে, তোমরা অনেক কিছু জানবে; আমরা যেখানেই যাই, দেখি, উনিও ঐ দু’জনকে একই অবস্থায় নিয়ে পথ চলেন; উনিও, পথে পথে কীসের তল্লাশে ঘোরেন, জানি না; এসো, আমরাও আজ ওনাকে শুধাই।”

লোকটি,ছেলেদের সামনে এসে গেছে।সবাইকে,  তার দিকে চেয়ে উন্মুখ হয়ে থাকতে দেখে, বলে, “আমি, মানব; বাঁ কাঁধে, বহে চলেছি বন্ধু সত্যের লাশ, আর
ডান কাঁধে রয়েছে অর্ধমৃত বিবেক, আমারই অপর সত্তা; খুঁজে চলেছি বিশল্যকরণী। অসত্যের পথে, চোরাপথে, দেশের স্বাধীনতার কালেই সত্যের ঘটলো অপমৃত্যু, আর ধীরে, ধীরে বিবেকও হ’ল মৃত্যু-পথযাত্রী।

সত্য ও বিবেকহীন হয়ে তো মানব – সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না। তাই তো দেখ না, দেশ আজ হয়েছে পশ্বালয়—
মানবতাবিহীন, মানুষকে না জাগালে, শত শহীদের আত্মত্যাগ হবে ব্যর্থ, অকারণ।”

ছেলেরা সমস্বরে বলে উঠলো, “আপনার সাথীদের, এ দশা কী করে হ’ল?”

“তবে শোন বলে, ঐ অবস্থাতেই মানব বলতে শুরু করেছে; গভীর উদ্বেগে ছেলেরা তা শুনছে——
“তোমরা তো দেখেছো, ভারতের লেলিনকে ও তাঁর সহযোগীদের বৃটিশ সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে; মৃত লেলিনের আত্মা সারা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছে ঐ ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ ‘ ধ্বনি;
বৃটিশ সরকার ও তার ভারতীয় বশংবদেরা, সাধারণ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে,নিজেদের আখের ভরেছে,অবশ্য মাঝে,মাঝে দু’এক টুকরো ছুঁড়েও দিয়েছে; মো-সাহেবের দল তো উচ্ছিষ্টেই খুশি; বিপ্লবে, ওরা ভয় পায়; আমূল-সামাজিক পরিবর্তণের বিরোধী,কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখতে আগ্রহী। সমাজের এক বৃহৎ অংশকে কীভাবে ওরা অচ্ছুৎ করে অত্যাচারের ষ্ট্রীম- রোলার চালায়,তা দেখেছো তো! ওদের হাতে মালা পরে,নেতারা আবার সন্ধ্যায় এসে চান করে শুদ্ধ হয়েছে; কী দেশের নেতা সব! সবাই রয়েছে মুখোশে। ভারতের লেলিনের ঘোষিত ফাঁসির দিনের আগে,অর্থাৎ23শে মার্চ,জেলার এসে ভগৎ সিংজিকে জিজ্ঞেস করছে,”তোমার শেষ ইচ্ছা কী?”তোমরা তো জানো,ভগৎ সিংজি ছিলেন নাস্তিক, এ নিয়ে নিজের যুক্তি দিয়ে প্রবন্ধও লেখেন;ঐ অচ্ছুৎপন্থীদের ছিলেন ঘোরতর বিরোধী; তাঁর কাছে মানবতাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম, হরিজন বলে বুকে না জড়িয়ে,নিজের সমান আসনে মর্যাদা দিলে,মানুষ হিসেবে জ্ঞান করলে,মনের মধ্যে সাম্যভাব আসলেই,
নিজেকে মানুষ হিসেবে বোধ করার যোগ্যতা আসবে, অন্যথায় নয়।
জেলারকে বলেন, ‘আমি, আমার বেবির(মা) হাতের রান্না খাবো’। জেলার বলে, ‘বেশ বাড়ি থেকে খাবার আনা হবে’। ভগৎজি বলেন, ‘আমার বেবি তো জেলেই রহেছে’; তিনি, মেথর ভোগাকে, বেবি বলে ডাকতেন। লেলিনের বেবি ভোগা, 23 তারিখে সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি থেকে ভগৎসিংজি’র জন্য খাবার নিয়ে এলে, দেখেন সেল শূন্য; ফাঁসির সময়, কোন এক অজ্ঞাত কারণে এগিয়ে আনা হয়েছে; 24 তারিখ ভোরের পরিবর্তে, 23শে মার্চ সন্ধ্যা 7 টায় ফাঁসি কার্যকর করা হ’ল। বৃটিশ সরকার, শেষ ইচ্ছাটাও পূরণ করতে দিল না, অথচ, নিজেরা সভ্য জাতি বলে বড়াই করে থাকে! সবাইকে মানুষ বলেই গণ্য করে না; মান ও হুঁশ থাকলে, তবে তো মানুষ বলা যায়; কথার মান্যতা যারা রাখে না, মৃত্যুপথ যাত্রীর শেষ ইচ্ছাপূরণে যারা প্রতিবন্ধী, তারা কি মনুষ্য পদবাচ্য?” ওরা বিপ্লবকে ভয় খায়; তাই যাবার আগে, ওদের বশংবদ ব্রাউন সাহেবদের বসিয়ে, দেশটাকে দু’খণ্ড করে, নিজেদের আখের বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বাংলা আর পাঞ্জাবই ছিল ওদের প্রধান শত্রু, তাই ঐ দু’ জাতির মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে দিয়ে গেল। সারা ভারতে উড়লো, তেরঙা পতাকা,আর বাংলা-পাঞ্জাবে হ’ল রক্তের হোলিখেলা। নারীর ইজ্জত হ’ল লাঞ্ছিত, চারদিকে শুধু হাহাকার; মানুষের গণভোটে সেদিন হয়নি ভারত খণ্ডিত, হয়েছিল নেতাদের লালসার শিকার; প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভের শিকারে, সাধারণ মানুষের ঘটলো অপমৃত্যু, আর সেদিনই সত্য হল বিলুপ্ত; সেই থেকে, আমি সত্যের লাশ বহে চলেছি; জীবন সংগ্রামে, বাঁচার প্রেরণা, টিকে থাকার প্রচেষ্টায় উদ্বাস্ত মানুষগুলো বিবেককে টুঁটি চেপে রেখেছে, তাই তো বিবেক আজ অর্ধমৃত, না জাগলে, বৃথা যাবে হাজার শহীদের রক্ত – স্রোত। স্বাধীন দেশ বটে, বৃটিশের আইন অব্যাহত; বা রে স্বাধীনতা; সেই বিনা বিচারে ফাটকে, সেই পুলিশি অত্যাচার, সি- আর- পি-সি, তবে পরিবর্তণ কোথায়!সাদা চামড়ার সাহেবের পরিবর্তে ব্রাউন চামড়ার সাহেব, কেবল রং’র পার্থক্য, অত্যাচারী মানসিকতা হুবহু বহাল; কান পাতলে তেরঙা পতাকার পত পত শব্দের মাঝে ভেসে ওঠে শহীদের দীর্ঘশ্বাস, বড় করুণ, বড় মর্মস্পর্শী, বড় হৃদয় বিদারক সে আর্তনাদ। যে কোন প্রতিবাদে, হবে মিথ্যা মামলা, গাঁজা কেসে জুটবে ফাটক – বাস, অকারণ হয়রানি, প্রাণ হয় জেরবার।”  হায় রে স্বাধীনতা!

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।