অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৫৫)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু
পাগল শ্রাবণ এলো শালজঙ্গলে
উন্মনা মনে আর সবুজের ঘরসংসারে
তোমার দিগন্তে নামি ওগো বসুন্ধরা
টুপটাপ জলে ভেজা তিন ভুবনের পরপারে
আবার এক ভোরবেলা কালো রঙের ছেঁড়া ছাতা রাজছত্রের মতো ধরে , এক আকাশ শ্রাবণ হয়ে , বিন্দাসের বিষণ্ণ অবয়ব এসে দাঁড়ালো অমলেন্দুর দুয়ারে । সেই কাকভোরে যখন তিথি আর বাদল ঘুমের অতলে , জানলায় ঠুকঠুক শব্দ শুনে বাইরে এসে দাঁড়ালো অমলেন্দু।বিন্দাস কোনো ভূমিকা না করেই গেয়ে উঠলো — আমি এই যে ভিক্ষা চাই , বিদায় দে গো শচীরাণী আমি সন্ন্যাসেতে যাই। তুমি মনেরে বুঝাইয়া রেখো গো,
মাগো তোমার নিমাই নাই…
ও গুরু , আমাকে অন্তত হাজার দুয়েক টাকা দাও তো ।একজনের বড় বিপদ। অমলেন্দু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চারটে পাঁচশো টাকার নোট এনে ওর হাতে গুঁজে দিলো । চোখের জল আর বৃষ্টির জলে একাকার বিন্দাস কোনোমতে টাকাগুলো তার মাধুকরীর ঝোলার গভীরে পরম যত্নে রেখে দিলো। কাঁচা পাকা দাড়ি চুলকে, হাত দুটো জড়ো করে বললো — ও গুরু , জানতে চাইলে না , কেন টাকা নিলাম ? অমলেন্দুর স্নিগ্ধ স্বর যেন আপনা থেকেই বলে উঠলো — ভীষণ প্রয়োজন না পড়লে কেউ টাকা নেয় ? নিশ্চয়ই কেউ বিপদে পড়েছে ।
— হ্যাঁ বন্ধু , বিপদ । এই জেলার শেষের দিকে যে হাতির জঙ্গল , সেখানে বনপলাশ গ্রাম । গ্রামের প্রান্তে একটা বিশাল পলাশ গাছের নিচে চায়ের দোকান , বাঁশের ধাপি। সেখানে দুমুঠো খেয়ে পরে থাকে এক অসুস্থ বোষ্টুমী। লোকের মুখে খবর পাঠিয়েছে , তার একটা গানের খাতা আমাকে দিয়ে যেতে চায় । ওর বিশ্বাস ,ওর লেখা গানগুলো আমি বাকি জীবনটা গেয়ে বেড়াবো। কোনোমতে রেলগাড়ি ধরে বৃন্দাবনে চলে যাবে । সেখানে ওর চেনাজানা কে যেন আছে । টাকাগুলো ওকে দিয়ে, ট্রেনে তুলে আমি ফিরবো । তবে তোমাদের কবিতার সংসারে আমাকে চিরস্থায়ী ভেবো না গুরু। থাকবো আবার পালাবো । কখনও দাঁড়ে বসবো আবার উড়ে চলে যাবো । তোমরা কবিতা লিখবে , আমি সেই কবিতাগুলো পাহাড়ে জঙ্গলে গাছে গাছে টাঙিয়ে দেবো । এই আসা যাওয়ার খেয়ার পাড়েই কূলকিনারাহীন আমার বসত গো গুরু । ওই দেখো , আমার হেঁড়ে গলার গান শুনে , তোমার ভাই আর ভাইয়ের বৌ উঠে এসেছে।ওদের নিয়ে জমিয়ে সংসার করো । তুমি অসুস্থ হলে , বনের ময়ূর আর আকাশের শঙ্খচিল আমাকে ঠিক খবর দেবে ।দশদিক তোলপাড় করে আমি ঠিক এসে পড়বো । তোমার কবিতার শিকড় আর আমার হারানো গাঁয়ের শিকড় আমাকে বারবার ঘরছাড়া করবে , আবার ঘরেই ফিরিয়ে আনবে । চলি। আবার গান ধরলো বিষণ্ণ গলায় — শিশুকালে মরে গেল মা ,গর্ভে থুইয়া মরলো পিতা গুরু , চক্ষে দেখলাম না,আমায় কে করিবে লালন পালন , কে দেবে যে সান্ত্বনা । হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিথি গেয়ে উঠলো — ভবে জনমদুখী কপাল পোড়া গুরু আমি একজনা…
প্রথম শ্রাবণ , চেনা অচেনা শ্রাবণ ,অবাক শ্রাবণ যেন পাগলা বিন্দাসের চলে যাওয়াটা এঁকে রাখলো শ্রাবণের অ্যালবামে।
ল্যাপটপে মন বসাতে পারছে না অমলেন্দু। উন্মনার কোনো খবর নেই। ফোন করা বারণ । বোঝা যাচ্ছে,প্রবল দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে সে । এদিকে আস্তে আস্তে ঘর গেরস্থালি গুছিয়ে নিচ্ছে তিথি আর বাদল । আজকাল নিজেরাই দুটো ছাতা নিয়ে বাজারে যাচ্ছে,মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করছে। অমলেন্দুকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে কখনো কখনো । স্থানীয় চায়ের দোকানে জমিয়ে তিনজন মিলে চপমুড়ি আর চা খাচ্ছে । বাদল মেঘ আর তিথি ইচ্ছে করেই তাদের কবিতার পত্রিকা নিয়ে আলোচনা করছে । তাতে চায়ের দোকানে আসা সবরকমের মানুষেরই আগ্রহ বাড়ছে ,সেটাও বুঝতে পারছে অমলেন্দু।মনে মনে তারিফ করছে তিথি আর বাদল মেঘের । দিন পনেরোর মধ্যে প্রবল বর্ষা উপেক্ষা করে, বাড়িতে কোচিং ক্লাসের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে ওরা। আশেপাশের দু তিনটে গ্রামে খবর রটে গেছে , অমলেন্দুর দূর সম্পর্কের ভাই ও ভাইয়ের বৌ উচ্চ শিক্ষিত । তারা এক সঙ্গে অঙ্ক , বিজ্ঞান ও সাহিত্য পড়াবে এবং অবশ্যই অল্প পারিশ্রমিক নিয়ে । মাঝখানে প্রলয় ও শুভ এসে দুদিন থেকে গেল অমলেন্দুর সংসারে। খবর পেয়ে রাগী অর্ধেন্ধু আর শান্ত অরুণিমাও চলে এসেছিলো। এবার শরতের শেষ দিকে দূর্গাপুজো। শান্ত ও নীলচে ঋতু হেমন্তের শুরুতেই ওদের কবিতার পত্রিকা আর কবিতাজন্মের চলাচল শুরু হয়ে যাবে । উন্মনা এখন অন্তরালে।তার খবরাখবর প্রায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না । শুধু অমলেন্দু নয় , গত দুতিন সপ্তাহ সে কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছে না । অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে কেউ তাকে বিরক্তও করছে না । তবু , বাকি সকলের যোগাযোগ ফোনাফুনির মাধ্যমে চলছে । এমনকি সুদূর ইউরোপ থেকেও মেঘলা সব খবরাখবর রাখছে । সব ঠিক থাকলে , ও বছর দুয়েকের মধ্যে দেশে ফিরবে । তারপর কলকাতার বৈভব ছেড়ে , অমলেন্দুর গ্রামেই একটা ছোট্ট উইক এন্ডের আশ্রয় বানাবে। সে মাঝে মধ্যেই ফোন করে অমলেন্দুর বিষাদ কাটানোর চেষ্টা করে। প্রকৃতির কী আশ্চর্য লীলা ! উন্মনা নিজেকে সরিয়ে নিয়ে চুপ করে গেলেও , শ্রাবণ ছাপানো বৃষ্টির মধ্যেও একটা নিশ্চিত কবিতাজন্ম যেন বাগানের প্রথম দোপাটি কুঁড়ির মতো ক্রমশ জেগে উঠছে । ছাতিম ফুলের তীব্র গন্ধের মতো জানান দিচ্ছে। ভরা কদমের ডালে ডালে মেঘভাঙা রোদ্দুর হয়ে উঁকি দিচ্ছে কবিতাজন্ম। বুকের হাহাকার জমিয়ে রেখেই , কবিতার অনুভব ও বাচিকশিল্পীদের দায়িত্ব নিয়ে একটা বড় প্রবন্ধ লিখে চলেছে অমলেন্দু। বাদল আর তিথির সঙ্গে ইচ্ছে করেই দূরত্ব বজায় রাখে সে। ওদের প্রতি মুহূর্তের সাংসারিক ঘনিষ্ঠতার মধ্যে কিছুতেই উঁকি দেয় না । সংসারের এক সন্ন্যাসী হতেই ভালো লাগে তার । কিন্তু রাত গভীর হলে , সাইলেন্ট মোডে রাখা তার ফোনে যখন কোনো ভাইব্রেশন হয় না , যখন বাদল ও তিথির স্বাভাবিক দাম্পত্যের উচ্ছ্বাস অন্ধকারকে তীব্রভাবে বিদ্ধ করে , অমলেন্দু তখন সেই সব অস্ফুট শব্দের বাইরে গিয়ে , প্রাণপণে তার কবিতার নারীকে খোঁজে । ক্রমশ প্রৌঢ়ত্বে পৌছে যাওয়া অমলেন্দুর একান্ত নিজের একটা সংসার পাততে ইচ্ছে করে । কী জানি , হয়তো সংসার করলে তার কণ্ঠের কবিতার উচ্চারণ একদিন তার নিজস্ব কলমের কবিতা হয়ে নেমে আসতেও তো পারে! সেও তো একদিন কথক থেকে কবি হয়ে উঠতে পারে ! হয়তো, কবিতার নারীর সুগন্ধি অবয়বে মিশে গিয়ে, সেই আশ্চর্য কবিতার জন্ম দেবে সে ! কিন্তু কীভাবে তার ভালোবাসার নারীকে সে জীবনে পাবে,তার কোনো ঠিক ঠিকানাই তার কাছে নেই । একটা সংসারের স্মৃতি পিছনে ফেলে, আর একটা গেরস্থালি পাতা যায় ? উন্মানা নামের কোনো নরম ও সহজ নদীর মতো বয়ে চলা নারীর পক্ষে তা সম্ভব ? শুভদৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া যায় ? মালা বদলের মালা থেকে রজনীগন্ধার গন্ধ মুছে, অন্য কোনখানে ভেসে যেতে পারে মানুষ ?
তবু, তবু তিথি আর বাদলের সাজানো সংসার দেখে তার ভীষণ মন খারাপ লাগে । আপন মনে হয় না। নিজের বাড়িতেই নিজেকে অতিথি মনে হয়। সেই সংসারে আলগাভাবে জড়িয়ে রাখলেও, নিজেকে সে তাই সরিয়েই রাখে । কিন্তু ভরা শ্রাবণের এক রাতে তার সব ধৈর্যের বাঁধ ছিঁড়ে ফেলে , অমলেন্দু শেষ পর্যন্ত ফোন করলো উন্মনাকে । একবার ফুল রিং হয়ে থেমে গেল ফোন । দ্বিতীয় বারেও ফোনটা বেজেই গেল । তৃতীয় বারে ফোন ধরলো তার কবিতার নারী উন্মনা । স্পষ্ট বোঝা গেল ঘুমহীন দ্বিধা জড়ানো গলা । ফিসফিস করে বললো — আমি বাড়ি ফিরে এসেছি কবিমন । তোমাদের কারোর সঙ্গেই কথা বলবার মতো অবস্থায় আমি নেই । কবিতা বা কবিতার ভাবনা থেকে অনেকটা দূরে এখন আমার অবস্থান । মা , মেয়ে , এ বাড়ির সংসার শ্বশুর বাড়ির কর্তব্য, আমার স্কুলের চাকরি — সবকিছু গুলিয়ে গেছে কবিমন । আমি ভালো নেই । কলম দিয়ে একটা শব্দও বেরোচ্ছিল না । আমি বারণ করেছি বলেই তুমিও ফোন করলে না ? তাহলে আমার এই শবরীর প্রতীক্ষা কার জন্যে ? শ্রাবণের অন্তরে কার মুখ ? যাকে ভালোবাসো তার সঙ্গেও ফর্মালিটি করছো ? তুমিও কি সেই সাজানো গোছানো , শো কেস আলো করা পুরুষ মূর্তি ? আমি যে মেঠো ইঁদুরের মতো মরে যাচ্ছি কবিমন ! একটা খবর নিলে না ? যাক , এখন আর কথা বলছি না । পাশের ঘরে ওদের ঘুম ভেঙে যাবে । আজ সন্ধ্যায় কিছু লিখেছি । তোমাকে পাঠাচ্ছি । তারপর শুধু ফুঁপিয়ে কান্না । আর কোনো শব্দ নেই । কয়েক মুহূর্ত পরে অমলেন্দুর ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো তার কবিতার নারী উন্মনার কবিতা —
অন্য চালচিত্র
প্রতিটি সকালের টাটকা সংবাদপত্রে
তোমার বিষাদরেখায় আঁকা থাকে একটি মুখ ,
হোক ম্লান,তবু সেই বিষণ্ণ আননেই লেখা হয় — আবার দেখা হবে ।
এইভাবেই পাঁচ,দশ ,বারো , তেরো , চোদ্দ বছরের ঘর – সংসার ,পথের মহাকাব্য রচিত হয় তোমার আমার উন্মুখ হৃদয়ে হৃদয়ে ।
আবার দেখা হলে যাবতীয় ভুল ভ্রান্তি শুধরে দুজনেই শোনাবো মহা – জাগরণ – পালা…
তুমি বুনবে নকসীকাঁথা,
আমি লিখে যাব মৈমনসিংগীতিকার মতো চিরকালীন কোনো কাব্যগাথা…
এভাবেই প্রৌঢ় আমরা ,বয়স্ক আমরা,শীলিত আমরা ,দুর্বিনীত আমরা বাংলার চালচিত্র হবো।
দেখা হবে।
আবার দেখা হবে।
একবার, দুবার, তিনবার কবিতাপাঠ শেষে, গভীর ও ব্যাপক বৃষ্টিধারার শব্দের মধ্যে স্তব্ধ ও বয়স্ক, টলটলে ও প্রবহমান , পথ ও পথিক অমলেন্দু, কবিতার অমলেন্দু, কবিতা লিখতে না পারার যন্ত্রণাবিদ্ধ একক অমলেন্দু, স্থির ও অপলক তাকিয়ে থাকলো ফোনের পর্দায়। ফিসফিস করে বলে চললো– নারী, তুমি সম্পূর্ণ আকাশ…
বুকের মধ্যে দলা পাকানো কান্না যেন রাতের বৃন্ত ছিঁড়ে শ্রাবণ জড়ানো শাল জঙ্গলে মিশে যাচ্ছে, সরোদের গভীর আলাপ হয়ে।
কবিমন অমলেন্দু কাঁদছে তার কবিতার নারী উন্মনার জন্য…
ক্রমশ