দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ১০)
by
·
Published
· Updated
২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।
এইবার লিখব
দশ
বিয়ের পর বউকে নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে কিছু দিন পর পর এলেও দু’-একদিনের বেশি কখনওই থাকতে পারেনি বৃন্দাবন। তাই এই প্রথম একটানা সাত দিনের ছুটি নিয়ে ও আদ্রা থেকে এসেছে। ভাল মতোই দিন কাটছিল। সব ঠিকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন মাঝরাস্তায় মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল অনন্যার সঙ্গে। আবার কোন ঝঞ্ঝাট এসে হাজির হয়, ও তাই না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। অনন্যা নিজেই এগিয়ে এসে বলল, কেমন আছ?
ও বলেছিল, এই তো চলে যাচ্ছে।
তার পর কথায় কথায় অনন্যা জানিয়েছিল, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল…
— কী? বলো না…
ও বলেছিল, লোকের মুখে শুনেছিলাম, তোমার বাবা মা নাকি ভেবেছিলেন, আমার বাবা-দাদারা নাকি সে দিন ভরসন্ধ্যায় তোমার ওপরে আক্রমণ করেছিল। আসলে সেটা সত্যি নয়। আমাদের পাশের পাড়ায় রতন বলে একটি ছেলে আছে। সে নাকি বহু দিন থেকেই আমাকে মনে মনে ভালবাসত। আমি সেটা জানতাম না। সে কখনও প্রপোস করা তো দূরের কথা, সে রকম কোনও ইঙ্গিতও আমাকে কখনও দেয়নি। কিন্তু আমার সঙ্গে তোমাকে দেখে ও নাকি সেটা মেনে নিতে পারেনি। ওর নাকি মনে হয়েছিল, তোমাকে সরাতে পারলেই ওর রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ও আমাকে পেয়ে যাবে। তাই দলবল জড়ো করে ওই দিন ওই ভাবে ও তোমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
বৃন্দাবন জিজ্ঞেস করল, তোমাকে এটা কে বলল?
— আমার এক বন্ধু। যারা সে দিন তোমাকে মেরেছিল, তাদের সঙ্গেই ছিল ওর দাদা। ওর দাদা নাকি ওর বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে একদিন এই নিয়ে কথা বলছিল, ও তখন শুনে ফেলে। পরে ও-ই আমাকে এ সব বলেছে।
চমকে উঠেছিল বৃন্দাবন, সে কী! এটা আমাকে তখন বলতে পারোনি?
— আমি কি আগে জানতে পেরেছি যে, বলব? এই তো কিছু দিন আগে জানলাম।
— তাই? কিন্তু এখন জেনে আর কী লাভ! যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
অনন্যা বলেছিল, জানি। সব শুনেছি। আমি তোমার সব খবর রাখি। তোমার বিয়ের খবরও আমি পেয়েছিলাম। তা, বৌদি কেমন হয়েছে?
কী উত্তর দেবে ও বুঝে উঠতে পারছিল না। যাকে ভালবেসেছিল, যাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল, সে এই প্রশ্ন করলে কী উত্তর দেবে ও! শুধু বলেছিল, ভাল।
— আমার মতো?
ও কোনও উত্তর দেয়নি। উল্টে প্রশ্ন করেছিল, তোমারটা কবে?
অনন্যা বলেছিল, আমি আর বিয়ে করব না।
— কেন?
— এমনিই। এই তো ভাল আছি।
— তা এত তড়াঘড়ি করে কোথায় যাচ্ছ?
ও বলেছিল, আমি তো এখন রজনীকান্ত কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে পড়াই। সেখানেই যাচ্ছি। খুব দেরি হয়ে গেছে তো…
— আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, যাও। পরে কথা হবে।
যখন কথা হচ্ছিল, ও দেখেছিল অনন্যার হাতে মোবাইল ফোন। ওরও আছে। ফোন রিসিভ করলে এখন আর টাকা কাটে না। কিছু দিন আগে নশো নিরানব্বই টাকা দিয়ে ও বোকার মতো সারা জীবনের জন্য ইনকামিং কল ফ্রি করিয়ে নিয়েছিল। তার পরেই শুনল, ইনকামিং কলে আর কোনও চার্জ লাগবে না। তার পরেই যেন মোবাইল কেনার ধুম পড়ে গেল আর সে জন্যই এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল। ও ইচ্ছে করলে ওর মোবাইল নম্বরটা নিতে পারত। কিন্তু না, ও চায়নি। অনন্যাও চায়নি ওর নম্হর। দু’জনেই চলে গিয়েছিল দু’দিকে।
বৃন্দাবনের মন ভারী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু না, বাড়িতে এসে বাবাকে কিচ্ছু বলেনি। মাকেও না। সাত দিনের ছুটি নিয়ে এলেও পর দিনই, মাত্র চার দিনের মাথায় ও ফিরে এসেছিল আদ্রায়। ওর বাবা বুঝেই হোক, আর না বুঝেই হোক, ওকে ভুল বুঝিয়েছিলেন। ও-ও ওদের ভুল বুঝেছিল। এটা জানার পর ওইখানে কী আর থাকা যায়! ওর সঙ্গে কত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে রাস্তাঘাটে, এখানে ওখানে। ওকে কি সেগুলো স্বস্তিতে থাকতে দেবে? অস্থির করে তুলবে না? তাই ও ওখান থেকে এত দূরে এসে ওই কথাগুলো ভুলতে চেয়েছিল। কিন্তু আদৌ ভুলতে পেরেছে কি!