দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৭)
by
·
Published
· Updated
২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।
এইবার লিখব
সাত
বৃন্দাবন তখন এক-একটা পরীক্ষা দিচ্ছে আর মাঝে মধ্যে প্রতাপকে চিঠি লিখছে। কাগজ বেরোচ্ছে না। বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। তাই প্রতাপেরও লেখা বেরোচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে তো সে বসে নেই। একবার যখন সাধ পেয়ে গেছে… রোজই কিছু না কিছু লিখছে। অনেক লেখা জমে গেছে। এগুলো তো ছাপতে দিতে হবে। রূপসী বেরোচ্ছে না তো কী হয়েছে, আর কি কোনও পত্রিকা নেই, যেখানে সে লেখা দিতে পারে!
সেই পত্রিকার খোঁজেই প্রতাপ এই স্টলে চলে যায়। ওই স্টলে যায়। পত্রপত্রিকা দেখে। চিরকুটে টুকে নেয় সম্পাদকের নাম। ঠিকানা। ফোন নম্বর। রোজ এমনি এমনি দেখলে দোকানদার কবে তার মুখের ওপরে কী বলে দেবেন, কোনও ঠিক আছে! তাই মাঝেসাঝে একটা-দুটো কমদামি পত্রিকাও কিনে আনে ও। টুকে আনা ঠিকানা দেখে দেখে সেই সব পত্রিকায় পোস্ট করে দেয় কবিতা। তার পর থেকে সেই পত্রিকার কোনও সংখ্যা বেরোলেই পাগলের মতো উল্টেপাল্টে দেখে তার কবিতা ছাপা হয়েছে কি না। এবং যখনই দেখে, তার লেখা বেরোয়নি, তখনই তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। কিচ্ছু ভাল লাগে না। কখনও সখনও অবশ্য কবিতা বেরোয়। সঙ্গে সঙ্গে সেটা কিনে নেয়।
কোনও কোনও পত্রিকা আবার ডাকযোগে বাড়িতে বসেই পায়। ও এখন বুঝতে পারে, ঠিকঠাক পত্রপত্রিকায় লিখতে গেলে কোনও গ্রাহক হওয়ার দরকার হয় না। বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দেওয়ারও কোনও হ্যাপা নেই। সপ্তাহে অন্তত একদিন করে পত্রিকা দফতরে বা সম্পাদকের বাড়ি গিয়ে সম্পাদককে তেল মাড়ারও প্রয়োজন নেই। লেখা যদি ভাল হয়, এমনিই ছাপা হয়। উল্টে টাকা পাওয়া যায়। খাতির করে। লোকে সমীহর চোখে তাকায়। আর তার চেয়েও বড় কথা, একজন কবি বা লেখক যা চান, সেই পাঠক, ওই সব কাগজের তুলনায় অন্তত একজন হলেও, বেশি পাওয়া যায়। আর কী চাই!
এই ভাবে বিভিন্ন পত্রিকা ঘাটঁতে ঘাঁটতেই আধুনিক লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে তার। জানতে পারে, এই সময়ে কারা কারা লিখছে। লেখা নিয়ে কী কী আন্দোলন হচ্ছে। থার্ড লিটারেচর মুভমেন্ট কাকে বলে? হাংরি জেনারেশন কী? গদ্য কবিতা লিখতে গেলেও ছন্দ জানা কেন জরুরি। এই ভাবেই সে যে কখন সাহিত্যের হাঁড়ির খবরও রাখতে শুরু করে দিয়েছে সে নিজেও টের পাইনি।
সে যত লেখা পাঠাত, তার বেশির ভাগই ছাপা হত না। তা হলে কি পছন্দ হয়নি? কেন হল না? নাকি ওদের কাছে লেখাটাই পৌঁছয়নি? আদৌ পৌঁছেছে কি? জানার জন্য সে সব পত্রিকার দপ্তরে ফোন করত। ডায়েরি দেখে দেখে বলত, অমুক তারিখে এই এই নামের দুটো কবিতা পাঠিয়েছিলাম, আপনারা কি পেয়েছেন? মনোনীত হল কি না বা কী হল, কবে নাগাদ জানা যাবে একটু বলবেন?
কোথাও থেকে উত্তর পেতে— পেয়েছি, এখনও দেখা হয়নি। প্রচুর লেখা আসে তো, একটু সময় লাগবে। কেউ বলত— লেখা পাঠিয়েছেন কত দিন হল? পছন্দ হলে আমরা তিন মাসের মধ্যে ছেপে দিই। যদি তিন মাসের মধ্যে ছাপা না হয়, তা হলে ধরে নেবেন, লেখা মনোনীত হয়নি। তখন এই লেখাটা অন্য কোনও পত্রিকায় দিতে পারেন। অাবার কেউ বলত— এই নামে কোনও লেখা পেয়েছি বলে তো মনে পড়ছে না। আপনার কাছে কপি আছে তো? আপনি বরং লেখাটা কপি করে আর একবার পাঠিয়ে দিন। অথবা শনি-রবি আর সরকারি ছুটির দিন বাদে যে কোনও দিন বেলা দুটো থেকে সন্ধে ছ’টার মধ্যে এসে আমাদের দপ্তরে জমা দিয়ে যেতে পারেন।
তেমনই একটি দপ্তরে সন্ধে নাগাদ লেখা পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখেছিল, বেশ জমজমাট আড্ডা। সে দিনই প্রথম কবিতা বিভাগের সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সম্পাদক কেমন দেখতে, ও আগে থেকে যেমনটা ভেবে রেখেছিল, সামনাসামনি দেখার পর ও একেবারে থ’। এ তো একেবারে ইয়াং ছেলে।
তিনিই ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আড্ডা মারতে থাকা বাকি লোকগুলোর সঙ্গে। এক একটা নাম প্রতাপ শুনছিল আর ওর চোখের সামনে ভেসে-ভেসে উঠছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পড়া ওঁদের লেখাগুলো।
ওঁদের অনুরোধেই টেবিলের ওপরে খবরের কাগজে টাল দিয়ে রাখা মুড়ি-বাদাম মাখা আর তেলেভাজায় ভাগ বসিয়েছিল ও। খেতে খেতেই এ পত্রিকায়, সে পত্রিকায় বেরোনো এঁর-ওঁর কোন লেখাটা ও পড়েছে, সেটা ওর কেমন লেগেছে, কেমন হলে ওর আরও ভাল লাগত, এই রকম দু’-চারটে কথা বলেছিল। ওর কথা শুনে ওঁরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, এখনও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এমন করে কেউ পড়ে? লেখার লোক প্রচুর আছে, কিন্তু পড়ার লোকই তো নেই। চারিদিকে শুধু কবি আর কবি। সে জন্যই বুঝি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, এত কবি কেন?
প্রতাপকে ওঁদের খুব মনে ধরেছিল। ওঁরাই বলেছিলেন, চলে আসুন না… বুধবার-বুধবার সন্ধেবেলায়। আমরা এখানে বসি। আরও অনেকে আসে। এলে ভাল লাগবে।
ও বলেছিল, আমাকে আপনি করে বলবেন না। আমি তো আপনাদের থেকে অনেক ছোট। আমাকে তুই করে বলবেন। আর নাম ধরে ডাকবেন।
ও পাশ থেকে একজন বলেছিলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাই হবে।
আর একজন বলেছিলেন, আরে, তুমি তো আমার ছেলের চেয়েও ছোট। তুমি না বললেও তোমাকে আমি তুমিই বলতাম।
যে বিভাগীয় সম্পাদকের কাছে ও কবিতা জমা দিতে গিয়েছিল, তাঁকে কবিতা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময়, আবারও যেন কে বলল, পারলে সামনের বুধবার এসো।
এত ঘরোয়া পরিবেশ, লোকগুলো এত অমায়িক,এত ভাল যে, না, শুধু কবিতা ছাপার জন্য নয়, শুধুমাত্র এঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানোর জন্যও এখানে প্রতিদিন আসা যায়। পুরো ব্যাপারটা খুব ভাল লেগেছিল প্রতাপের। আরও ভাল লেগেছিল, বাড়ি ফিরে বৃন্দাবনদার চিঠি পেয়ে।