• Uncategorized
  • 0

ছোট গল্পে পাপিয়া মণ্ডল

অভিভাবকত্ব

শ্রাবণের সন্ধ্যাবেলা। বেশ কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছে খানিক আগেই। চারদিকটা বেশ ভেজা ভেজা। মাটির সোঁদা গন্ধ নিয়ে বইছে মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস। আর তার সাথেই ভেসে আসছে রতনদার দোকানের তেলেভাজার গন্ধ। রতনদার দোকান থেকে একটু এগোলেই গ্রামের রাধা গোবিন্দের মন্দির। এই মন্দিরই  গোবিন্দপুর গ্রামের শেষপ্রান্ত বলা যায়। অনিমেষ বৃষ্টি থামার পর থেকেই এসে বসে আছে মন্দিরের চাতালে। এই গ্রামেরই ছেলে ও। এই বছরে মাধ্যমিকে খুব ভালো নাম্বার পেয়ে গ্রামের স্কুলে প্রথম স্থান পেয়েছে। এখন একাদশ শ্রেণিতে  বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। সাধারণ মধ্যবিত্ত চাষীবাসী একান্নবর্তী পরিবারের ছেলে। তাই ছোটবেলা থেকেই খুব একটা স্বাধীনতা পায়নি। জেঠু, জেঠিমা, তাঁদের দুই মেয়ে আর ওর বাবা, মা, ও, ওর বোন, এই আটজনের পরিবার। দাদু-ঠাকুমা মারা গেছেন বেশ কবছর আগেই। জেঠুর বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটটা সবে কলেজে। অনিমেষের থেকে মাত্র দুবছরের বড়।ওকে ছোটদি বলে। পিঠোপিঠি হওয়ায় ওর সাথে অনিমেষের খুব ভাব। আর, ওর বোন এখন ক্লাস এইটে পড়ে। পড়াশোনায় ওরা সবাই ভালো।
তবে অনিমেষ বাড়ির একমাত্র ছেলে, যাকে বলে বংশপ্রদীপ। তাই ওর উপরেই সবার আশা বেশি।
যেহেতু দাদু-ঠাকুমা নেই, তাই ওর জেঠুই বাড়ির অভিভাবক। উনি খুব রাশভারী আর খুব জেদি মানুষ। বাড়ির সবাই তো বটেই, এমনকি গ্রামের সবাইও ওনাকে সমীহ করে চলে।
ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস পড়তে বড় ভালোবাসে অনিমেষ। দেশ-বিদেশের কত  অজানা কাহিনি জানা যায়। ওর খুব ইচ্ছে ছিল, মাধ্যমিকের পর আর্টস নিয়ে পড়ে, পরে ইতিহাস নিয়েই পড়বে। কিন্তু এতো ভালো রেজাল্ট করাটাই কাল হলো ওর জন্য। স্কুলের মাস্টারমশাইরা ও আর্টস নিয়ে পড়তে চায় শুনে, ওকে নানাভাবে বোঝালেন। সায়েন্স নিয়ে পড়তে উৎসাহিত করলেন। ওনারা ওকে স্কুল ছুটির পর পড়িয়ে দেওয়ারও আশ্বাস দিলেন। তাই ও সায়েন্স নিয়েই ভর্তি হয়ে গেলো। বুক লিস্ট নিয়ে জেঠুর সঙ্গে শহরে গেলো। ওই মোটা মোটা বই আর তাদের দাম শুনেই জেঠুর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তারপর প্র্যাকটিক্যাল খাতা, ডিসেকশন বক্স ইত্যাদি আনুষঙ্গিক জিনিসও কিনতে হলো। অনিমেষের নিজেরও খারাপ লাগছিল খুব, এতো খরচ হতে দেখে। বাড়ি ফেরার পথে জেঠু এটাসেটা খাওয়ার কথা বললে, ও ‘খিদে নেই’ বলে এড়িয়ে গেলো। তারপর বাড়ি ফিরে মা-জেঠিমার কাছে এসে শুকনো মুখে বললো—“খেতে দাও। খিদে পেয়েছে।” ওকে খেতে দিয়ে জেঠিমা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বললেন—“কি রে অনি, আজ তোর জেঠু তোকে কিছু খাওয়ায় নি? ”
মা আর জেঠিমা, এই দুজন ওর কাছে পরম মমতার আশ্রয়। জেঠিমার আদর পেয়ে ওর চোখ ছলছল করে উঠলো। বললো–“আমিই খাব না বলেছিলাম। বইপত্র কিনতে অনেক খরচ হয়ে গেলো।”
জেঠিমা বললেন—“তাতে কি? তুই ভালো করে লেখাপড়া করে, অনেক বড় হবি। ওতেই  তো আমাদের সব পাওয়া হবে।”
ওর মা পাশেই বসেছিল। ছলছল চোখে দুহাত জোর করে কপালে ঠেকিয়ে ঠাকুরের কাছে ছেলের মঙ্গল কামনা করলেন।
দিন কাটতে লাগলো একটা একটা করে। পড়াশোনা মন দিয়েই করছে। মাস্টারমশাইরা ওকে সত্যিই যত্ন নিয়ে পড়ান। অন্যান্য সব বিষয় বুঝতে পারলেও অঙ্কের কিছু জিনিস আর অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি কিছুতেই ওর বোধগম্য হয় না। স্যারেরা বারবার বুঝিয়েও ওকে বোঝাতে পারেন না। মাস দুয়েক পর থেকেই ও হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করে। মনে মনে অনুশোচনা করে আর্টস না নেওয়ার জন্য। একদিন সন্ধেবেলা ওকে অমন মনমরা দেখে, ওর ছোটদি জিজ্ঞেস করলো—“কি হয়েছে তোর? বেশ কদিন ধরেই দেখছি তুই কেমন মনমরা থাকিস।”
অনিমেষ ওকে সবটা বললো। শুনে ছোটদি বললো—-“পরীক্ষা আসতে এখনো দেরি আছে। তুই স্ট্রিম চেঞ্জ করে নে। আর্টসে চলে আয়। আর নোটপত্র তো আমার গুলো ও আছে।”
অনিমেষ বললো—-“কিন্তু, এতো খরচ করে জেঠু বইখাতা কিনে দিলো।”
ছোটদি বললো—-“খরচ দেখতে গিয়ে, নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করিস না। ধর যদি তোর দূর্বল বিষয়ে নাম্বার কম পাস, বা ব্যাক আসে? তার চেয়ে তুই যে বিষয়ে ভালো, ভালো বুঝিস, ভালোবাসিস, সেই বিষয় নিয়েই এগো। এতেই তোর ভালো হবে।”
পরদিন স্কুলে এসে স্যারদেরকে বললো ওর সমস্যার কথা। ওনারা বুঝলেন। দুঃখ প্রকাশ করে বললেন—“তখন তোকে তোর সিদ্ধান্তেই ছেড়ে দিলেই ভালো হতো। শুধু শুধু দুটো মাস নষ্ট হলো। যাইহোক মন দিয়ে লেখাপড়া করে মেকআপ করে নিস। ”
বাড়ি এসে ভয়ে ভয়ে বাবাকে জানালো সব। মা, জেঠিমাও ওর কথায় সায় দিলেন। কিন্তু তখন ওর জেঠু বাড়িতে ছিলেন না। ওনার বড় মেয়ের বাড়ি গেছেন। সন্ধেবেলা ফিরবেন। উনি ফিরলে ওর বাবা সব বলবেন। তাই ও বৃষ্টি থামার সাথে সাথেই বেরিয়ে এসে, মন্দিরের চাতালে এসে বসে আছে। সন্ধেতে মন্দিরে হরিনাম সংকীর্তন হয়। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা অনেকেই আসেন। পরস্পরের কুশল বিনিময়ও হয়। ওনারা একে একে আসতে শুরু করলে, ও উঠে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। রতনদার দোকানের কাছে আসতেই, একমুখ হেসে রতনদা বললো—“তোমার জেঠু তেলেভাজা নিয়ে গেলো।”
কথাটা শুনেই ওর গলা শুকিয়ে গেলো। মনে মনে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে চললো। ‘জেঠু সব শুনে নিশ্চয়ই খুব চেঁচামেচি করছে।’
ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকে, সোজা রান্নাঘরে এলো।
কিন্তু, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। রান্নাঘরের মেঝেতে একটা বড় গামলায় মুড়ি মাখানো চলছে। সবাই একসঙ্গে বসে গল্প গুজব করছে। ও এসে চুপচাপ ছোটদির গা ঘেঁষে বসলো। একে একে সবার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে, জেঠুর চোখে চোখ পড়লো। উনি বললেন—-“কি রে তুই? আমি বাঘ না ভালুক? তুই নিজের কথা, সুবিধা, অসুবিধা গুলো আমাকে না বললে, আমি কি করে বুঝবো বাবা বল?”
অনিমেষ অভিভূত হয়ে গেলো। মুখে রা সরলো না ওর। ছোটদি কনুই দিয়ে একটা গুঁতো দিয়ে বললো—“এই সবই আমার কৃতিত্ব বুঝলি? সবাইকে আমি বোঝালাম।”
অনিমেষ বললো—-“তোর মতো বোঝানোর কেউ যদি সব ছেলেমেয়েরা পাশে পেতো, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার হার অনেকাংশেই কমে যেতো।”
ওর কথা শুনে সবাই শিউরে উঠলো। জেঠু বললেন—-“তোর উপর কোনদিনই কোনরকম জোর করবো না। তুই নিজের পথে চলে, নিজের লক্ষ্যে পৌঁছা, এই আশীর্বাদ করি।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।