ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২৭)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম
শুধু স্থাপত্য রীতি বা স্ট্রাকচারের ক্ষেত্রে নয়, বাংলার মন্দিরের গায়ে যে সমস্ত টেরাকোটার ফলক উৎকীর্ণ উৎকীর্ণ হয়েছে, সেগুলিতে ও বিদেশীদের জীবনযাত্রার ছাপ পড়েছে।
বর্ধমান জেলার মৌখিরা গ্রাম( এই গ্রামটি আগে বীরভূম জেলার অন্তর্গত ছিল), কাটোয়া থানার শ্রী বাটিতে এবং মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন মন্দিরে ইউরোপিয়ান মডেলের অনুকরণে সাহেব মেমদের ভাস্কর্য দেখা যায়।
বীরভূম জেলার দুবরাজপুর থানার অন্তর্গত হেতমপুর গ্রামে চন্দ্রনাথ শিব মন্দিরে ব্রিটিশ সিংহ লাঞ্ছিত ঢাল দেখা যায়। ওই মন্দিরে দেশীয় সমাজ চিত্রের পাশাপাশি বাইবেলে উল্লিখিত কাহিনী ও ঠাঁই পেয়েছে।
তেমনি ঠাঁই পেয়েছে লর্ড ক্লাইভ, কুইন এলিজাবেথ, কবি শেক্সপিয়ার, কবি মিলটনের মূর্তিও।
মন্দিরময় মলুটি গ্রামে( যদিও গ্রামটি এখন ঝাড়খন্ডে তবে ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের আগে এই গ্রামটি বীরভূমের অন্তর্ভুক্ত ছিল) একটি সমতল চালার দুর্গা মন্দিরের সম্মুখের অংশে মাথার দিকে অন্যান্য অনেক ধরণের মূর্তির সঙ্গে এই ধরণের সাহেব ও মেমের মাথার আদলে গড়া মূর্তি দেখা যায়।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি:—
মন্দিরের গায়ে লাগানো ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠা লিপি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় ,সেগুলি পোড়ামাটির ফলকে অথবা পঙ্খ পলেস্তরার সাহায্যে নির্মিত হয়েছে। প্রাচীন অনেক মন্দিরে দেখা যায় কালো পাথরের উপরে খোদাই করে উৎসর্গলিপি লেখা হয়েছে। পরবর্তীকালের মন্দিরগুলিতে কালো পাথরের উপরে খোদাই করে উৎসর্গ লিপি লেখা হয়েছে। বীরভূম জেলার মন্দিরগুলির বেশ কয়েকটি তে মন্দিরের গায়ে ফুল পাথরের ফলকের উপর প্রতিষ্ঠা লিপি দেখা যায়।
খ্রিস্টীয় ১৭ শতক বা তার আগে তৈরি প্রতিষ্ঠা লিপিগুলির ভাষা সংস্কৃত হলেও তা বাংলা হরফে খোদিত। সতেরো শতকের পরে অর্থাৎ ১৮ বা ১৯ শতকের অধিকাংশ মন্দির গুলির প্রতিষ্ঠা লিপির ভাষা বাংলা।
বীরভূম জেলার সবচেয়ে প্রাচীন ইটের তৈরি মন্দিরটি ইলামবাজার থানার ঘুড়িষা গ্রামে
অবস্থিত রঘুনাথ মন্দির। মন্দিরটির
পিছন দিকে পোড়ামাটির টাইলের প্রতিষ্ঠাকালকে লেখা আছে——-
রঘুত্তোমাচার্য্য বিচিত্র মন্দিরম্
রঘুত্তোম প্রীতিসমৃদ্ধি বর্দ্ধনম্।
হরাস্য কামাস্ত্র তিথি প্রবর্তিতে
শাকে বিনির্স্মিতং ন নাম শিল্পনা।।
১৫৫৫ শকাব্দে (১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে) রঘুত্তোম আচার্য এই মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দির নির্মাতা শিল্পীদের নাম নেই, লিপিতে এ কথারও উল্লেখ আছে।
রঘুনাথ মন্দির নির্মাণের কয়েক বছর পরে রাজনগর থানা এলাকায় কবিলাসপুরে একটি মন্দির তৈরি হয়। বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ি থেকে রাজনগর যাওয়ার পথে লাউজোর গ্রাম থেকে মোটামুটি তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রাম। এখানে প্রস্তর নির্মিত রেখ দেউলটি স্থানীয় জনসাধারণের নিকট ‘ ধর্মরাজের মন্দির’ রূপে পরিচিত এবং এটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার সংরক্ষণাধীনে আছে। মন্দিরটির গঠন প্রণালী একটু বিচিত্র ধরনের।
এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই। কিন্তু মন্দিরটির প্রবেশপথের উপরে পৃথক পৃথক প্রস্তর ফলকে
লিপিমলা আছে। একটি বড়, অন্যটি ছোট।
প্রথমটিতে ৮ লাইনের লিপি এবং দ্বিতীয়তে ছয় লাইনের লিপি আছে।ডঃ দীনেশ চন্দ্র সরকার মহাশয় এই লিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন।
প্রথম লিপিটিতে লেখা আছে——
“[স্বস্তি চিহ্ন] শ্রী শ্রী কৃষ্ণায় নমঃ।।
গিরীশ মুখ ষন্মুখা-(১)ননশরেন্দু সংখ্যান্বিতে
শকাব্দ নিকরেহ(২)রের খিল কামদং মন্দিরম্।
অপূর্ব দৃশ-(৩) দাচিতং রচিত্বানিদং শ্রদ্ধয়া তদীয়(৪) পদ বাঞ্চয়া করণ রূপদাসঃ কৃতী(৫)
১৫৬৫।।”(৬)
এই লিপি পাঠে জানা যায় যে,রূপদস নামে জনৈক কায়স্থ(করণ) সুন্দর প্রস্তর নির্মিত এই হরি( বিষ্ণু) মন্দির নির্মাণ করেন । ভগবত প্রীতির স্মারক রূপে গণ্য এই মন্দির সমস্ত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবে এবং ভগবত পদলাভের অভীষ্ট সিদ্ধিলাভ হইবে ইহা কামনা করিয়া মন্দির নির্মিত হয়।
চলবে