জন্মাষ্টমীর গল্পে রীতা চক্রবর্তী

শ্রী বাসুদেব কথা

আজ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষ, রোহিনী নক্ষত্রযুক্ত অষ্টমী তিথি।
সকাল থেকে আকাশ কালো মেঘের মুকুট মাথায় নিয়ে তাকিয়ে আছে মথুরায় কংসের
কারাগারের নির্দিষ্ট কক্ষের দিকে। কারাগারের প্রহরীরাও ব্যস্তত্রস্ত হয়ে এদিক থেকে ওদিকে পদচারণা করে চলেছে। ভেতরের পরিস্থিতি সঠিক অনুধাবনের জন্য দেবকীর কারাদ্বারে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে চলেছে তারা।
রাজভগিনী দেবকী আজ সারাদিন অন্নজল গ্রহন করেননি। রাজজামাতা বসুদেব অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত হয়ে রয়েছেন। একের পর এক ছয়টি সন্তান জন্ম নিয়েছিল এই কারাগারের কক্ষে । কিন্তু ক্রুর রাজা কংসের হাত থেকে তাদের রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সপ্তমগর্ভ বিনষ্ট হয়েছে। দেবকী এবার অষ্টমবার গর্ভবতী।
কংস যখন তাঁর পিতা ভোজবংশীয় রাজা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যূত করে নিজেই
সিংহাসন দখল করেছিল তখন আকাশবাণী হয়েছিল যে
যদুবংশীয় রাজা বসুদেব ও রাজবঁধূ
দেবকীর সন্তানের হাতেই
লেখা আছে কংসের মৃত্যু। তখনই কংস তার বোন দেবকী এবং জামাতা বসুদেবকে বন্দী করে কারাগারে আটক রাখে। আর দেবকীর নবজাত শিশুদের মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে কারাগারের পাষাণে নিক্ষেপ করে মেরে ফেলে। এই কারণেই রাজা বসুদেব আজও সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। দেবকীও মাতৃসুখ পেলনা সহোদরের নৃশংসতার জন্য।
প্রতিবার সন্তান প্রসবের পর নীরব দেবকীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বন্দী যদুকূলপতি
বসুদেবকে বিচলিত করে তোলে।
আজও তিনি অস্থির হয়ে রয়েছেন। দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তানকে নিয়েই যে হয়েছিল সেই ভবিষ্যৎবাণী। দৈববাণী যদি সত্যি হয় তবে দেবকীর এই সন্তানের বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু কিভাবে সম্ভব হবে সেটা? প্রহরীদের লোভাতুর দৃষ্টি দেখে কেঁপে উঠছেন বসুদেব। মনে মনে ‘নারায়ণ নারায়ণ’ বলে সকাতর কন্ঠে ভাবী সন্তানের কল্যাণ কামনায় আকূল হয়ে প্রার্থনা করছেন।
কারাকক্ষের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে একটা অব্যক্ত বেদনার ক্রন্দনধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তবে কি এসে গেছে সেই পরমক্ষণ? কিছুটা চিন্তিত কিছুটা উল্লসিত কারারক্ষীরা বিচলিত দৃষ্টিতে কক্ষের ভিতরের অবস্থা বুঝে নেবার চেষ্টা করে চলেছে। শিশুর কান্নার খবর রাজার কাছে পৌঁছে দিতে পারলে রাজা যে স্বর্ণমুদ্রা দেবার অঙ্গীকার করেছেন! যে প্রথম খবর দেবে সেই হবে রাজার আশীর্বাদধন্য।
গত রাত্রে রাজা কংসের সাথে
রাজবৈদ্যও এসেছিলেন কারাগারে। দেবকীর প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেছে। রাজভগিনীর প্রতি একনিষ্ঠ
ধাত্রীমাতাকে সতর্ক করে দিয়ে গেছেন রাজা – সন্তান প্রসবের সাথে সাথে যেন রাজাকে বার্তা পাঠানো হয়। কর্তব্যে গাফিলতি হলে শিশুর সাথে সাথে ধাত্রীমাতারো জীবনদীপ নিভিয়ে দেওয়া হবে।
রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর শেষ হয়ে গেছে। বাইরে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি। পৃথিবীতে যেন প্রলয় দেখা দিয়েছে। কারাগারের রক্ষীরা সারাদিন অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে নিদ্রাদেবীর কোলে আশ্রয় নিয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে দেবকীর অষ্টমগর্ভের পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হল। তখনই আকাশে বিদ্যুতের চমকের সাথে এমনভাবে বজ্রপাত হল, মনেহল
যেন কোথাও শঙ্খ বেজে উঠল। “বসুদেব, ওঠো। এই শিশুকে নিয়ে যমুনা পুলিনের ওপারে
গোকূলে যাও। সেখান নন্দ গোয়ালার স্ত্রী যশোদা একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছেন। তুমি তোমার পুত্রকে তাঁর কাছে রেখে সেই কন্যাকে সাথে নিয়ে এসো। পথে কোনো বাধা আসবেনা। তুমি না ফেরা পর্যন্ত এই মায়ারাত্রি ভোর হবেনা। শীঘ্র তৎপর হও।” – এই দৈববাণী শোনামাত্রই দেবকীর সহমতে বসুদেব শিশু পুত্রকে নিয়ে অন্ধকার দুর্যোগের মধ্যেই গোকূলের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
দেবকীর অষ্টমগর্ভের শিশুপুত্রের জন্ম মুহূর্তে কারাগারের রুদ্ধ দ্বার নিজের থেকেই খুলে যায়। সমগ্র চরাচর গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পরে। বসুদেব গোকূলে পৌঁছে বাসুদেবকে যশোদার কাছে রেখে তাঁর কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে নির্বিঘ্নে কারাগারে ফিরে এলে মায়া রজনীর অবসান হয়। দিকে দিকে খবর ছড়িয়ে পরে দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তান জন্ম নিয়েছে। রাজা কংস তৎক্ষণাৎ কারাগারে উপস্থিত হন। দেখেন একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান অনন্ত আনন্দ সাগরে ডুবে আছে। শিশুর বন্ধ চোখ হাসিমুখ দেখে কংস ক্ষণিকের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। কিন্তু আপনার প্রাণ সংশয় রয়েছে যেখানে সেখানে কোনো দুর্বলতা চলে না। তাই কংস ওই কন্যাকে বধ করার জন্য কারাগারের পাষাণে নিক্ষেপ করে। কিন্তু কি আশ্চর্য! এই শিশুকন্যা যে এক অপরূপ নারীমূর্তি ধারণ করলেন। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সেই নারী ঘোষণা করলেন – “আমি যোগমায়া। সমগ্র চরাচর আমার মায়া গ্রন্থিতে আবদ্ধ। এমনকি স্বয়ং মহারাজ কংসও সেই মায়াপাশ ভেদ করতে পারবেন না। দৈববাণী কখনো বিফল হয় না। আপনার মৃত্যুদূত যথাসময়ে ভূমিষ্ট হয়েছন। আপনার কাল পূর্ণ হলে তিনি আপনাকে মুক্তি দেবেন।” – এই বলে যোগমায়া অন্তর্হিত হন। ঊষার আলোয় বাতাসে যোগমায়ার কন্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যায় -” তোমারে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।