গল্পেরা জোনাকি তে রীতা চক্রবর্তী

বাবা মন্দির
আজকের দিনেও এটা মানা হয়ে আসছে যে বাবা হরভজন সিং আজও পূর্ব সিকিমের ইন্দো-তিব্বত সীমান্তের দুর্গম অঞ্চলে প্রতিদিন
ডিউটিতে উপস্থিত থাকেন। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে ‘বাবা’ বলে সম্মান করে। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাকে তারা শ্রদ্ধা করে। তাদের জান-মালের রক্ষার জন্য তারা বাবার পূজা করে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারত চীন যুদ্ধে এই অশরীরী সেনার পরাক্রমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান “মহাবীর চক্র” (মরনোপরান্ত) প্রদান করে।
হরভজন সিং ১৯৪৬ সালের ৩০শে আগষ্ট পাঞ্জাবের কাপুরথালা জেলার সর্দানাতে এক শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পাঞ্জাব থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৬৫ তে। এরপর অমৃতসরে এসে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন ওই বছরই ৩০শে জুন। ট্রেনিং শেষে তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একজন সিপাহী হিসেবে সেনাবাহিনীর কাজে যোগ দেন।
১৯৬৮ তে তাঁর পোষ্টিং হয় নাথুলার ভারত- চীন বর্ডারে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই জায়গাটাকে আমরা জানি “সিল্ক রুট” নামে। প্রাচীনকালে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ্ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে ভারতে এসেছিলেন এই “রেশমের রাস্তা” দিয়ে। সমুদ্র সমতল থেকে চৌদ্দ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই দুর্গম জায়গায় কর্তব্যরত ছিলেন সিপাহী হরভজন সিং।
১৯৬৮ র ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীতে কর্তব্যরত ছিলেন।
জানা যায় যে, রেজিমেন্ট থেকে একদল মালবাহী খচ্চর নিয়ে তিনি টুকুলা থেকে দংছুলা’র পথে যাত্রা করেছিলেন। পথে পাহাড় থেকে প্রচন্ড বেগে নেমে আসা একটি খরস্রোতা নালার কাছে এসে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। বরফের চাদরে ঢাকা সুবিস্তীর্ন অঞ্চলে তিনদিন ধরে তাঁর খোঁজে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু কোথাও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অবশেষে পাঁচদিন পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।
তাঁর সহকর্মী প্রীতম সিং তাঁকে স্বপ্নে দেখেন।
প্রীতম সিংকে তিনি তাঁর দুঃখজনক মৃত্যুর বিবরণ দিয়ে মৃতদেহের হদিশ দেন এবং সেখান একটি সমাধি মন্দির তৈরি করে দিতে বলেন।
প্রীতম সিং উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে স্বপ্নের কথা জানায়। তারপর প্রীতম সিংয়ের স্বপ্নেদেখা জায়গায় পৌঁছে বরফের চাঁই সরিয়ে
হরভজন সিংয়ের শবদেহ উদ্ধারকরা সম্ভব হয়। তারপর তার দেহ প্রথাগত ক্রিয়াকর্মের জন্য পাঞ্জাবে তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এরপর সহকর্মীর স্বপ্নাদেশ মতো সেখানে একটি “সমাধি” মন্দির নির্মাণ করা হয়।
জনশ্রুতি আছে যে, এরপর থেকে অশরীরী হরভজন সিং নাথুলা গিরিপথের ওই
সিকিম – তিব্বত সীমান্তে ডিউটি করে চলেছেন। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে
চাকরির সব সুযোগ সুবিধা সেই অশরীরী সিপাহী পেয়েছেন যতদিন না তাঁর রিটায়ারমেন্টের নির্ধারিত সময়(অক্টোবর, 2016) এসেছে। তাঁর জন্য তৈরি করা সমাধি মন্দিরে একজন মানুষের বসবাসের যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই মন্দিরের প্রহরীরা তাঁর উপস্থিতি টের পায়। কখনো কখনো তাঁর বিছানার চাদর কুঁচকে থাকে, ইউনিফর্ম স্বস্থান থেকে সরে যায়। জওয়ানরা তার ব্যবহৃত বুট ভেজা কাদামাখা অবস্থায় পেয়েছে বলে জানা যায়। এমনকি তিনি তাঁর নির্দিষ্ট গাড়িতে যখন বসেন তখন ড্রাইভার বুঝতে পারে এবং গাড়ি চলতে শুরু করে। তাঁর ইচ্ছেমতোই গাড়ি থামে। তিনি সেনা জওয়ানদের
অন্ততপক্ষে তিন দিন আগে
সতর্ক করে দেন বিপক্ষের আক্রমণ সম্পর্কে। সীমান্তে সৌহার্দ সমাবেশ(flag meeting) হলে চীনা লালফৌজ (PLA) হরভজন সিংয়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে একটা চেয়ার খালি রেখে দেয় এবং অভ্যর্থনার
সম্পূর্ণ বিধিবদ্ধ আয়োজন করে। তারাও স্বীকার করে যে, প্রতিকূল আবহাওয়াতেও একজন মানুষ একা প্রতি রাতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে টহল দেয়। এলাকার জনগণ হরভজন সিংয়ের ‘ছায়াকে’ ভগবানের মতো ভক্তি করে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করে। বাবা হরভজন তাদের আপনার জন। তারা বাবার সমাধিতে ফুল চড়ায়, আগরবাতি জ্বালায়, পূজো করে। কিন্তু প্রায় ১৪,০০০ ফুট উঁচুতে খরস্রোতা নালার কাছে তৈরি এই মন্দিরে সাধারণ ভক্তদের পৌঁছাতে খুবই অসুবিধা হয়। তাই ১৯৮২ সালে নাথুলা ও জেলেপলার মধ্যবর্তী স্থানে ১৩,১২৩ ফুট উচ্চতায় একটি মন্দির তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে এখানেই বাবার ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে। মন্দিরের মুখোমুখি বড় ঝরনার পাশে একটি বিশাল শিবমূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ভক্তরা বাবার মন্দিরে আগরবাতি জ্বালিয়ে রেখে
এখানে শিবপূজো করতে আসেন। এখানেই ভারত চীন যুদ্ধের বিজয়স্মারক স্বরূপ একটি
war memorial তৈরি করা হয়েছে।
বাবার আশ্চর্য স্পর্শ ভক্তরা এখানেও পায়। এখান থেকে wish water সংগ্রহ করে ২১ দিন পান করলে মনকামনা পূর্ণ হয়।দুরারোগ্য রোগী রোগমূক্ত হয় বলে শোনা যায়। ওই অঞ্চলে পোস্টিং পাওয়া সেনা জওয়ানরা এই মন্দিরে এসে বাবার বিশাল ফটোতে আগরবাতি দিয়ে
পুজো করে, পতাকাকে স্যালুট করে, বাবার আশীর্বাদ নিয়ে নিজেদের ডিউটিতে যান।
বাবা হরভজনের কৃপা সেনা জওয়ানদের উপর এভাবেই বর্ষিত হোক। সুরক্ষিত থাকুক ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। সুরক্ষিত থাকুক তাদের পরিবার। সুরক্ষিত থাকুক ভারতের আপামর জনসাধারণ। দেশের যে কোনো বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হাজির থাকে সেনা জওয়ানরা।
সকল বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের পাশে থাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। তাদের সুরক্ষিত রাখতে ‘বাবা হরভজন’ always on duty. জয় বাবা হরভজনের জয়। জয় হিন্দ্। জয় হিন্দ্ কী সেনা।
সমাপ্ত