সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ২৭)

বাউল রাজা

তৃতীয় খণ্ড

ধীরেধীরে কানাই বাউল দৃশ্যমান হলেন। একজন দীপ্যমান পুরুষ। সারাটা অঙ্গ জুড়ে যেন আনন্দ খেলে বেড়াচ্ছে। শরীরের নানাবর্ণের আলখাল্লায় যেন রামধনু তার সাত রঙ নিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। নাহ্, ভুল বললাম। বসন্তকুমারী যেন তার বুকে ফোটা সমস্ত ফুলের রঙকে গুলে নিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন কানাই বাউলের সর্বাঙ্গে। সারাটা শরীর খমকের তালে তালে দুলছে। দুই উদ্বাহু হাত যেন প্রেমানন্দে বিভোর শ্রী চৈতন্যরূপ ধারণ করেছে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার শোভাযাত্রার সম্মুখভাগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আনন্দে বিভোর হয়ে আত্মজ্ঞানহীন হয়ে নেচে নেচে মহানন্দে মাতিয়ে তুলতেন সবাইকে আজ আমার কানাইদাকে দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে। এখন আর তার শ্রীশরীরে রাধাভাব নেই। প্রেমভাবে বিভোর হয়ে একজন পুরুষ যেন গাইতে গাইতে তার দয়িতার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছেন।

আমি বাঞ্ছা করি দেখবো তারে
আমি কেমনে সে গাঁয়ে যাইরে
বলবো কি সেই পড়শীর কথা
ও তারে দেখিতে পাই যথা তথা
তার স্কন্ধ আছে নাইরে মাথা
ও তার হস্তপদ নাইরে…
সে আর লালন একদেহে রয়
তবু লক্ষ যোজন দূর রে…

তোমরা এখনো বাড়ি যাওনি! এ তোমার ভারী অন্যায় কিষ্ণামা, লোকটারে কোমড়ে বেড়ি পরিয়ে নে এলি, না করতে দিলে এট্টুসখানি বিশ্রাম, না দিলি দুমুঠো খেতে, খালি পেটে কি আর বহ্মজ্ঞান খেয়ে পেট ভরে কারো বল দিনি?
এই দেকো দিকি, আমারে না দোষালে তোমার মন ওটে না গো গোঁসাই। তোমার পিরিতের পদীপদাদাকে তো বলেই দিচিলাম বাড়িতে গে টুকুসকানি গইড়ে নিতে, তা তিনি ঝদি তার পেমের নাগরের সাতে পেম কত্তে বসেন তাতে আমার কী দোষ বলো দিনি?
— সেক্ষেত্তেও তো তারে দোষ দেওয়া যায় না, কতদিন বাদে তার বালোবাসার নদীর সাতে দেকা হলো কতা হলো বল দিকিনি? আর নদী ও তো ভালো রে বুজেই পদীপদাদাকে তার পাড়ের বুকে বইসে দুদন্ড কাল কাইটেচে নাকি বল? বেচারা পদীপদাদা একা একা ঘরে বসেই বা কী করতো? তার চাইতে… আমি তো নদীরে …
— আচ্চা গোঁসাই, তোমার পদীপদাদা আমাকে শুদোচ্চিলো চোকের সমুকে না দেকতে পেলে মনের বসত হয় ক্যামনে, আমি বললুম দেকো ঠাকুর এ উত্তর দেওয়া আমার কম্ম নয় গো, যিনি না দেকেই মনের ঠাঁয়ে বালোবাসার পিঁড়ি পেতে দেন তিনিই এর উত্তর দিতে পারেন।
— এই দ্যাকো দিকিনি, আমি অন্দ বইলে কি আমারেই পাকড়াও করলি রে মা! এর উত্তর তো লালন গোঁসাইয়ের মতো চক্ষুম্মান মানুষই বইলে গেচেন। আমি আর নতুন কইরে কি বলি বল দেকি? বলি চোক আর মন দুইয়েরই তো বাস আমাদের শরীলেই না কি? অতচ কী আচ্চয্য ব্যাপার বোজ কেউ কাউকেই ঠাহরে পায়না। আর আমি তো অন্দই রে, জন্মের থে আলো কি জিনিষ বুজতেই পাল্লুম না।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।