গারো পাহাড়ের গদ্যে জিয়াউল হক

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আমিরুল ইসলাম
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আমিরুল ইসলাম, এফ.এফ. এফ.এফ.নম্বর-৯৭৬৮, গেজেট নম্বর ঈশ্বরদী-৮৬৪, লাল মুক্তিবার্তা নম্বর-০৩১১০২০২৯৭, সমন্বিত তালিকা নম্বর – ০১৭৬০০০১১৯৬, মোবাইল নম্বর – ০১৭২৪১৬১৩৩৩, পিতা: আয়েজউদ্দিন মৃধা, মাতা: ইজ্জতননেছা, গ্রাম ও ডাকঘর: লক্ষীকুন্ডা, উপজেলা: ঈশ্বরদী, জেলা: পাবনা। বর্তমান ঠিকানা: ঐ।
৫ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে আমিরুল ইসলাম ছিলেন বাবা মায়ের ৪র্থ সন্তান। ১৯৭১ সালে তিনি ঈশ্বরদী থানার পাকুড়িয়া হাই স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকরা শাসনের নামে শোষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে বাঙালিদের মনে এতোটাই বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য স্কুল পড়–য়া একজন কিশোরও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরও পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টুকে সাথে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির মনে যেন ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়েছিল। তাইতো তারা সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করার প্রত্যয় নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচন্ড গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসভায় ভাষণে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুকে মোকাবেলার আহবান জানানোর পর থেকেই বাঙালিরা বুঝতে পারে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। তখন থেকেই সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। আমিরুল ইসলাম ও তার বন্ধুরা তখন রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার কাজ শুরু করেন।
২৫ মার্চ রাতে পকিস্তানি সেনারা সারা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ করে মানুষ হত্যা এবং মানুষের বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে শুরু করে। একই দিন মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর পরই শত্রুসেনাদের হাতে গ্রেফতার হন। তিনি গ্রেফতার হলেও তার নির্দেশনা মোতাবেক সারা বাংলাদেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল অসীম সাহসিকতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। সেই সময় বাঙালিরা বাঁশের লাঠি হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। শুরু তাই না অনেক স্থানে তারা শত্রুদের পরাজিত করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তা ছিল একেবারেই সাময়িক। ইতোমধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দিন দিন দেশের মধ্যে শত্রুসেনাদের অত্যাচার ও নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাই জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আমিরুল ইসলাম দেশ ছেড়ে ভারতের পথে যাত্রা করেন। তারপর বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার বর্ডার পার হয়ে ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গা ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়ে ভর্তি হন। সেখানে বেশ কিছু দিন অবস্থান করার পর তাদের ভারতীয় সেনাবাহিনী পরিচালিত মালদা জেলার গৌঢ়বাগান ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়। সেখানে আরও কিছু দিন অবস্থান করার পর মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করে আমিরুল ইসলামদের শিলিগুড়ির পানিঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়।
পানিঘাটায় প্রথমে ৩০ দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ ও পরে আরও ১০ দিন এ্যাডভান্স প্রশিক্ষণ প্রদানের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তুফানি ব্যাটেলিয়ন নামে একটা ব্যাটেলিয়ন গঠন করা হয়। আমিরুল ইসলাম এই ব্যাটেলিয়নের ব্রাভো কোম্পানীতে অন্তর্ভূক্ত হন। তাদের কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর মতিলাল চক্রবতর্ী। ব্যাটেলিয়ন গঠনের পর ৭ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রদানের পর এই ব্যাটেলিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট সীমান্তের ডিফেন্সে প্রেরণ করা হয়। ডিফেন্সে যাওয়ার পর এই ব্যাটেলিয়নের মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেন্স ও বাঙ্কার কেটে নিয়মিত সৈনিকদের মতো দিন রাত ২৪ ঘন্টা সেন্টি ডিউটি দিতে শুরু করেন।
ফার্সিপাড়া যুদ্ধ ঃ তৎকালীন রাজশাহী জেলার ফার্সিপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল। শত্রুদের সম্বন্ধে নানা তথ্য সংগ্রহ করার পর একদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ফার্সিপাড়া ক্যাম্পের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। শত্রুসেনারা মেসিন গানের গুলি ও মর্টারের গোলাবর্ষণ করে তার জবাব দেন। জীবনের প্রথম যুদ্ধে মর্টারের গোলার সন্মুখে পড়ে তারা একটু ঘাবড়ে গেলেও কোন ভয় পাননি। যুদ্ধ শেষে তারা অক্ষত অবস্থায়ই নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে আসতে সক্ষম হন। ৩ ডিসেম্বর নিয়মিত যুদ্ধ শুরু হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তুফানি ব্যাটেলিয়নের মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি, রংপুর জেলার পলাশবড়ি, গোবিন্দগঞ্জ এবং বগুড়া শহরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আমিরুল ইসলামের মতো একজন কিশোর যোদ্ধা যুদ্ধ করে আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছেন। বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে।