T3 || ১লা বৈশাখ || বিশেষ সংখ্যায় রীতা চক্রবর্তী

নব আনন্দে নববর্ষ উদযাপন

রুনুদাকে আজও সকালে মাঠে না দেখে একটু অবাক হল বিশু। যতই ঝড় জল হোকনা কেন রুনুদা প্রতিদিন সকালে মাঠে দু’পাক হাঁটে। তারপর জগু’র চায়ের দোকানে আসে। এসেই দু’প্যাকেট খাস্তাবিস্কুট নিয়ে লালু-কালুর দলকে দেয়। ওরাও একে একে এসে লেজ নাড়িয়ে পা ছড়িয়ে বসে পরে যে বেঞ্চে রুনুদা বসে ঠিক তার সামনে। খাবার শেষ করে লেজ নেড়ে মাথা দুলিয়ে ঘুর ঘুর করতে থাকে দলটা। দোকানের অনেক কাস্টমার কুকুর দেখে ভয় পায়। তাই রুনুদা হেসে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, ” এখন যা তোরা। কাল আবার দেখা হবে।” রুনুদার কথা ওরা বোধহয় বুঝতে পারে। তাই একটুও দেরি না করে ওরা চলে যায়। এমন একজন দরদী মানুষ ক’দিন কেন আসছেন না সেটা বুঝতে চেষ্টা করে বিশু।
জগু’কে জিজ্ঞেস করে, “কিরে, রুনুদার কোনও খবর পেলি!”
জগু খুবই মনমরা হয়ে জানায়,” বুঝতে তো পারছিনা কি হল মানুষটার। আজ একটু তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে একবার ওনার বাড়িতে যাবে।”
ওরা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলতে ব্যস্ত তখনই লালু-কালুর দল অদ্ভুত ভাবে কেঁদে উঠল দেখে ওরা পিছনে তাকিয়ে দেখে রুনুদা আসছেন । কুকুরগুলো যেন প্রিয়জনকে দেখতে পেয়ে অভিমানের কান্নায় ভেঙে পরেছে। বিশু ব্যস্ত হয়ে জানতে চায়, “শরীর ঠিক আছে তো আপনার? কটা দিন দেখিনি তো, তাই একটু চিন্তা হচ্ছিল!”
“হ্যাঁ রে ভাই, সে সব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। অসুবিধেটা একটু অন্যরকম। বলছি সব। আগে ওদের খেতে দিই।” জগু বলে,”জানেন রুনুদা,”আমি নিজে হাতে ওদের বিস্কুট দিয়েছি এই কদিন। কিন্তু ওরা গন্ধ শুঁকে রেখে দিয়েছে। একদিনো খায়নি। আপনি না দিলে ওদের মুখে রোচেনা।” রুনুদা হেসে বললেন, “ওরা যে প্রভুভক্ত প্রাণী। ওদের ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই।”
রণজয় মজুমদার মানে রুনুদা এই তল্লাটের একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। দীর্ঘদিন মিলিটারিতে চাকরি করেছেন। সেখানে নিয়ম অনুযায়ী বন্ড পুরো করে “সেবানিবৃত্তি” পেয়েছেন। তারপর ব্যাঙ্কে চাকরি করেছেন। অবশেষে এখন অবসর প্রাপ্ত মানুষ। এখানে কিছু জমিজমা আছে। মানুষটা খুবই শৌখিন। বাড়িতে প্রচুর গাছপালা লাগিয়েছেন। অনেক নাম না জানা ফুলের গাছ আছে ওনার বাড়িতে। বিভিন্ন ফলের গাছও আছে। ছায়াঘেরা বাড়িটা দেখে মনে হয় স্বপ্নের জগৎ। বাড়ির নামটাও খুব সুন্দর, “নহবৎ।”

একমাত্র ছেলে একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে। দেখেশুনে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র নাতি এবার ক্লাস টেনে। স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পরার পর থেকে সংসারের কাজের জন্য আরো একজনকে রাখা হয়েছে। সে অসুস্থ মানুষটার কাছে থাকে সবসময়। আগে তো দুজন ছিলই। বেলাদি’ আগে রান্না করে নিজের খাবার নিয়ে বাড়ি চলে যেত। স্ত্রী অসুস্থ হবার পর থেকে বেলা’দি এখানেই থাকে। ওর সঙ্গে গ্রাম থেকে এসেছে সতীরাণী। সে ঘরদোর ঝারপোছ করে কাপড় কেচে বাসন ধুয়ে মুছে গুছিয়ে দেয়। ছোটখাটো ফাই ফরমাশ খাটে। বাড়ির গার্জেনগিরি করে বেরায়। এখনতো বেলা’দি আর সতী হল এই সংসারের আসল খুঁটি। বাগানের কোন গাছের কোন ফুল, কোন ফল কি অবস্থায় আছে সেসব সতীরাণীর নখদর্পনে।
এখানের ফুলের আড়তে এই বাগানের ফুল পাঠানো হয়। নিতাই এসে প্রতিদিন সকালে ফুল নিয়ে যায়। আর ফলের বাগানের লিজ দেওয়া আছে রসিকলালের কাছে। বেশ কিছু লোকজন এখানে নিয়মিত কাজ করে। মাটির গুণবুঝে গাছপালা লাগানো, বাড়ির খাবারের মত টাটকা সব্জি চাষ করা সব কিছুর জন্য লোক আছে। সংসার নিয়ে কোনো সমস্যা নেই বললেই চলে।
তবে ইদানিং রুনুদার একটু অন্য ধরনের সমস্যা হয়েছে। বললেন,” বিগত কয়েকমাস ধরে কিছু লোক আমার বাড়ির সামনে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করছে। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিদায়ক। আজকাল যেভাবে কিছু লোক সাধারণ মানুষের জমিজমা মিথ্যে কাগজপত্রের জোরে দখল করে নিচ্ছে তাতে খুব টেনশন হচ্ছিল। মানুষকে ভুয়ো মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে যেভাবে কিছু লোক নিজেদের আখের গোছাচ্ছে তাতে আমার বাড়িঘর নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কিভাবে এই আশ্রয়টুকু বাঁচাবো সেটাই ভাবছিলাম। ছেলের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে একটা উপায় স্থির করা হল। ঠিক করলাম, আমার এই বাড়িতে একটা বৃদ্ধাশ্রম করব। ঘরদোর যা আছে তাতে শুরুটা করতে অসুবিধা হবে না। তাই সবার আগে ছুটলাম উকিলের কাছে। আইনের সহায়তা নিয়ে উপযুক্ত কাগজ পত্র তৈরি করতে হল। তারপর বাড়িটার রেনোভেশন করানো হল। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া, জরুরি পরিষেবা চালু করা – এইসব কাজ শেষ করতে কটাদিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। এবার পয়লা বৈশাখে আমার “নহবতে” নতুন করে শানাই বাজবে। বছরের প্রথম দিন থেকেই নতুন সাথীদের হাত ধরে নতুনসাজে চলতে শুরু করবে “নহবত।” আমি আবার নতুনকরে একটা দায়িত্ব নিলাম। এই কাজে তোমাদের সাহায্য যে পাব সেটা আমি জানি। বৃদ্ধাশ্রমে সারাদিন কাজের জন্য কিছু লোকজন তো লাগবেই। তোমাদের জানাশোনা তেমন কেউ থাকলে নিয়ে এসো। আর তোমাদের সবার নিমন্ত্রণ রইলো পহেলা বৈশাখের দিন। সবাই মিলে আনন্দ করব। খাওয়া দাওয়া হবে। নতুন যারা আসবেন তাদেরও ভালো লাগবে। এসো কিন্তু তোমরা সবাই। আজ আসি। এখনও অনেক কাজ বাকি রয়েছে। সেগুলো শেষ করতে হবে। তাই আজ আর দেরি করবনা। তোমরা যেন বাড়ির সকলকে নিয়ে অবশ্যই এসো। আর আপনাদেরো নিমন্ত্রণ রইলো পহেলা বৈশাখে। সপরিবারে আসবেন কিন্তু। আজ আসি কেমন। পরে আবার দেখা হবে।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।