জন্মস্থান – পুরুলিয়া
পেশা – সরকারি চাকরি
প্রকাশিত কবিতা বই :-
১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে
২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর
৩) ভিতরে বাইরে
৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল
৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি
৬) কৃষ্ণগহ্বর
৭) শরীরে সরীসৃপ
৮) প্রেমের কবিতা
৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর
১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম
উপন্যাস
১) কৃষ্ণগহ্বর
পূর্ব প্রকাশিতের পর
আবার সেই আনন্দপুর আসা। এই নিয়ে অনেকবার হল। ট্রেনে বসে ঝালমুড়ি খেতে অর্ণবের বেশ মজা লাগে। ঠোঙা থেকে সামান্য মুড়ি মুখে ঢেলে দিয়ে কুচ করে কাঁচা লঙ্কায় কামড়। তারপরেই ক্যাচ করে নারকেল কুচিতে অন্য আরেকটা কামড়। এই ভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না মুড়ি শেষ হয়। লাল্টু বলেছিল, ঝালমুড়ির ব্যবসা একটা দারুণ বিজনেস। কম পুঁজিতে বেশি লাভ। পাঁচশো টাকা খাটালে পাঁচশো লাভ। লাল্টু অর্ণবদের ক্লাসমেট। তখন ফাস্ট ইয়ার। উচ্চমাধ্যমিকে একগাদা নাম্বার নিয়ে ফিজিক্স পড়তে এল শহরে। মায়ের সঙ্গে ওরা ভাড়া বাড়িতে থাকত। আর ঠিক সেকেণ্ড ইয়ারে মান্তুর সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে ফেঁসে গেল। ডাকসাইটে একেবারে পাড়া সুন্দরী। ফাটাফাটি দেখতে। উচ্চমাধ্যমিকে তিন তিন বার ব্যাক পাওয়া মান্তু। আট মাস অন্তর অন্তর যে বয়ফ্রেন্ড পাল্টায়। অনেকে ভুল করে বলে আট ঘন্টা অন্তর। তিন তিনটে ছেলেকে নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছে তখন। ছেলেরাও দু’চার পয়সা খরচ করে ফুর্তি মারছে। লাল্টুর কানে এইসব কথা যে আসত না তা নয় কিন্তু লাল্টু এইসবে পাত্তাই দিত না। প্রেমের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ভাবত মান্তু কোনো ভুল করতে পারে না। লোকে ঈর্ষান্বিত হয়ে এইসব বলে। রক্তে তখন বিপ্লব আর প্রেম আর কবিতা। কবিতা আর মান্তু অথবা মান্তু আর কবিতা। বিপ্লব, কবিতা, মান্তু কোনোটাই থাকল না। ফুটো কপাল।
লাল্টু প্রচুর বই পড়ত। কোন একটা বই এ পড়ল পৈতার এই পাঁচ খি আমাদের প্রাচীন কালে ছিলই না। উপরের বা উত্তমাঙ্গের বস্ত্র খণ্ডটি হল উত্তরীয় সেটিই আসলে উপবীত বা পৈতা। এমন কি তা সুতোর তৈরি না হলেও হবে, কৃষ্ণসার মৃগচর্ম মানে অজিন হলেও চলবে। পড়া কি শুধু জ্ঞানের জন্য! বাস্তবে প্রয়োগ না হলে চলে! কলেজ ক্যান্টিনে পৈতা খুলে সেই সুতোতে দিব্যি এক জুনিয়র বন্ধুর ব্যাগ সেলাই ও হয়ে গেল। সুঁচ কোথা থেকে জোগাড় হয়েছিল এখন আর মনে নেই। লাল্টু এমনিই প্রাঞ্জল। এমনি আবেগময়।
লাল্টুদের ফাঁকা ভাড়া ঘরে মান্তু একবার এসেছিল। লাল্টু চায়নি। কিন্তু মান্তু আসবেই। জেদ ধরল। এমন জেদ যে লাল্টু আর না করতে পারেনি। সেদিন ওর মা এক্তেশ্বরে গিয়েছিলেন। শিবের পুজো দিতে।
শোবার ঘরে ঢুকে মান্তু বইপত্র নাড়ছে। এটা ওটা দেখছে। হঠাৎ বলল, ‘কিরে লাল্টুবাবু, একটু কফি খাওয়াবি না! মাথাটা ঝিমঝিম করছে।’
লাল্টু বলল, ‘তুই নিজে বানিয়ে নে। দেখ রান্নাঘরে সব কিছুই হাতের কাছে পেয়ে যাবি।’
-‘আরে আমি তো সারা জীবন ধরেই এই লাল্টু সোনার জন্য চা, কফি, ডাল, ভাত, রুটি, মাছ, মাংস রেঁধে বেড়ে খাওয়াব।’ বলেই গাল টিপে দেয় মান্তু।
লাল্টু আর না করতে পারেনি, বানিয়ে দিয়েছিল। কফির স্বাদ কেমন হয়েছিল সে জানে না। নিজে সে খেয়ে দেখেনি। খেয়ে দেখার সুযোগই পায়নি।
মান্তু শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর। তারপর হাত দুটো উপরে তুলে শরীর ভাঙল। উফ্ শব্দ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
-‘তুই খাবি না!’
-না, আমি একটু আগেই খেয়েছি। চল তোকে রাস্তায় মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিই। আমার মেলা পড়া বাকি আছে।’
-‘মাসিমা কখন আসবে রে?’
-‘দেরি আছে। মন্দিরে অনেক ভিড় থাকে তো। দুপুর পেরিয়ে যাবে।’
-‘তাহলে আমি একটু গড়িয়ে নিই। তুই একটু মাথাটা টিপে দে। কাল থেকে ঝিমঝিম করছে।’
-‘পাগলামি ছাড় মান্তু! আমার পরীক্ষা আছে। পড়তে হবে। আর মা ফিরে এইসব দেখলে কেলেঙ্কারি বাঁধবে।’
-‘ন্যাকামি করিস না লাল্টু। ছেলেদের ন্যাকামি আমার একদম সহ্য হয় না।’
-‘আরে ন্যাকামি করব কেন! তোর কি মনে হয় আমি ন্যাকামি করার ছেলে!’ কথাটা একটু জোরেই শোনাল। যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসে লাল্টুর কানে ঢং করে আবার বাজল।
-‘আয় না সোনা প্লিজ’ বলেই লাল্টুর মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরল। লাল্টুর তীক্ষ্ণ নাক মান্তুর ক্লিভেজে গেঁথে বসল। লাল্টু নিজের মধ্যে আর নেই। কানে ঝিঝি পোকার ডাক। কিসের যেন একটা টান শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসছে নিচে। পিটুইটারির খেলা। গলায় অনেকটা জোর নিয়ে বলল, ‘প্লিজ মান্তু আজ না, অন্য কোনো দিন!’
দুহাতে জড়িয়ে মান্তু বলে, ‘আমার আজই চাই। এই এক্ষুণি!’ বলেই নিজেই নিজের কুর্তিতে জোরসে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। জামার মতো হাঙহাঙ খোলা কুর্তি। মুঠোয় ভরে দুই স্তন মান্তু বলে, ‘শালা এটার জন্য এক ডজন ছেলে রাতদিন ঘুরঘুর করে বুঝলি! আর আমি, শালা তোকে তোর ঘরে যেচে দিতে এসেছি।’
লাল্টুর দুই কাঁধে দুই হাত রেখে মান্তু বলে, আর তুই কি বলিস! আজ নয় অন্যদিন!’
লাল্টু এই দৃশ্যের সামনে জড়ভরতের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথা কাজ করে না। চোখের সামনে লকলক করছে নিপলের গোলাপী লোভ। কোনো মতে মান্তুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়াল লাল্টু। তারপর আর কিছু মনে নেই। গ্রীষ্মের দাবদাহে ঠাণ্ডা জলের স্রোতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
অ্যাই যা, এতক্ষণ অর্ণবও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ট্রেন ফাঁকা হয়ে গেছে। আর একটু দেরি হলেই ট্রেন কারশেডে চলে যেত। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল এগারোটা কুড়ি। পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখে অনুর মিসড কল। অর্ণব কল ব্যাক করতে যাবে এমন সময়, ‘হাই অর্ণব এইদিকে তাকাও।’ সামনে তাকিয়ে দেখে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের চেয়ার বসে আছে অনু। অর্ণবের চোখ ছলছল করে ওঠে। চার মাস আগেও সে জানত না এত আলো নিয়ে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করবে। সত্যিই জীবন একটা আশ্চর্য ম্যাজিক।