আন্তর্জাতিক || পাক্ষিক পত্রপুট || এ সংকেত হক

নজরুল – কলম পেশা রাজনীতিক

১৮৯৯ সালের জৈষ্ঠ্য মাসে এখনকার পশ্চিম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়াতে জন্ম নিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অনবদ্য সৃষ্টির জন্য গোটা বাঙালি জাতি তাঁকে সম্মান করে। মূলত কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর প্রতিভা ছিলো বহুমুখী। তিনি কথক, নাট্যকারও। নজরুলের সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে এই প্রবন্ধ লেখা হয় নি। একজন পুরোদস্তুর সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী বলতে যা বোঝায়, আমার কাছে নজরুল সেরম ব্যাক্তি।

নজরুল যখন জন্মেছিলেন তখন আমাদের দেশটা ব্রিটিশের গোলাম। সমাজের প্রতিটি কোণে তাদের নির্মম শাসন দেখতে দেখতে তিনি বড় হচ্ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার আন্দোলন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছিলো। সমাজ সচেতন নজরুলও এই আন্দোলনে শরীক হয়ে উঠলেন। আর এ-কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের কবিতা-গানকে। তাঁর লেখার মাধ্যমে দেশের মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন – এক হয়ে একটা ফ্রন্ট গঠন করার জন্য, লুঠেরা ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য। একের পর এক লেখায় উস্কে দিতে চেয়েছেন বাঁধভাঙা ব্রিটিশ বিরোধী আবেগ।

১৯২২ সালে শ্রাবণ মাসে তাঁর সম্পাদনায় কলেজ স্ট্রীট থেকে প্রকাশিত হয় ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। আশ্বিনের শেষে এই পত্রিকায় ‘ধূমকেতুর পথ’ কলমে তিনি লেখেন[১]:

“ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ন দায়িত্ব,…শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজ্য বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততারি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটলি বেঁধে সাগরপাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না।…আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।”

খোলাখুলি ব্রিটিশকে এমন চ্যালেঞ্জ সত্যি অবাক করার মত ছিলো। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা নিয়ে বলতে গিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফফর আহমেদ লিখেছেন[২]:

“…অতিমাত্রায় নিরুপদ্রবতা প্রচারের ফলে দেশ খানিকটা মিইয়ে গিয়েছিলো। এই মিয়ানো হতে নজরুল তার লেখার ভিতর দিয়ে দেশকে খানিকটা চাঙ্গা করে তুলতে চেয়েছিলো।….”

ব্রিটিশরাও তাঁকে ছেড়ে কথা বলে নি। ১৯২২ সালে এই পত্রিকার ১২তম সংখ্যায় নজরুল একটি কবিতা লিখেছিলেন – ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। পরের বছর নভেম্বর মাসে এর জন্য পুলিশ আজকের বাংলাদেশে কুমিল্লায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

বছর শেষ হতেই আদালতের রায়ে পরাধীন ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) আর ১৫৩(ক) ধারা অনুযায়ী তাঁর ১ বছরের সশ্রম জেল হয়। এ-সম্বন্ধে নজরুল নিজেই লিখেছেন[৩]:

“সাহিত্যিক ও কবিদের মধ্যে আমি প্রথম জেলে যাই…”

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নজরুল গীতিকার-সুরকার হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাঁর অনেক গান ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াই-এর নতুন কর্মসূচী হয়ে ওঠে। ‘হায় পলাশী’ গানে তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন:

“হায় পলাশী!

এঁকে দিলি তুই জননীর বুকে কলঙ্ক-কালিমা রাশি,

পলাশী, হায় পলাশী।।

আত্মঘাতী স্বজাতি মাখিয়া রুধির কুম্কুম্,

তোরই প্রান্তরে ফুটে ঝরে গেল পলাশ কুসুম।…”

আবার অন্যদিকে ‘ভাঙার গান’-এ লিখলেন:

“…মার হাঁক হৈদরী হাঁক,

কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক,

ডাক ওরে ডাক

মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!…”

বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী যুগে স্বদেশী গান লিখিয়েরাও তৎকালীন শাসক বিরোধী বিদ্বেষের সুরকে এত জোরের সঙ্গে ধরতেন না। এই আওয়াজটাকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে নজরুল ‘একা কুম্ভ’ ছিলেন। তাই, স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে আপোষহীন বিপ্লবীরা নি:সংকোচে তাঁর গানের আগুন ঝরা শব্দে অনুপ্রাণিত হলো। স্বভাবতই, ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানী তাঁকে একেবারেই পাত্তা দেয় নি। তারপর যখন সবাই কানাকানি করতে লাগলো যে রেকর্ডে নজরুলের গান নেই কেন, তখন কোম্পানির টনক নড়েছিলো। তারা বুঝেছিলো নজরুলকে এড়িয়ে চললে তাদেরই ব্যবসা মার খাবে। তখন থেকে কোম্পানির রেকর্ডে তিনি আমন্ত্রিত হলেন। তখনকার দিনে কেউ স্বাধীনতা-সংগ্রামকে খোলাখুলি সমর্থন করলেই ইংরেজ প্রভুরা ভাবতো ব্যাটা নির্ঘাত রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। সেই হিসেবে নজরুল ছিলো শাসকের কাছে সম্পূর্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তি।

পরাধীন দেশে মানুষের কাছে আরও তিনটে সংকট ছিলো – ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, নারী-পুরুষ বৈষম্য আর ধনী-গরিব বিরোধ। নজরুল বুঝেছিলেন দেশের ভালো করতে গেলে শুধু ইংরেজকে তাড়ালেই হবে না, সেই সঙ্গে এগুলোকেও কাটাতে হবে। তাই তাঁর লেখাতে পাওয়া যায় সাম্য, সত্য এবং ন্যায়-বিচারের প্রতি অবিচল দায়বদ্ধতা।

‘সাম্যবাদী(মানুষ)’ কবিতায় লেখেন:

“গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!

নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি!…”

এই কবিতায় ধর্মের বেড়াজাল ভেঙ্গে দেশের হিন্দু ও মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করার আবেদন ছিলো। আবার, লিঙ্গ-সাম্য নিয়ে ‘সাম্যবাদী(নারী)’ কবিতায় লিখলেন:

“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।…”

এত চাঁছা-ছোলা ভাষায় বাংলা সাহিত্যে এর আগে কেউ সাম্যের দাবী করেনি। অপরদিকে, তিনি প্রান্তিক মানুষের সামাজিক ন্যায় বিচারের অধিকারের দাবীকে তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। কুলি মজুরের কষ্ট দেখে লিখেছিলেন:

“দেখিনু সেদিন রেলে,

কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে!

চোখ ফেটে এল জল,

এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?…”

এ-সব পড়ে যদি মনে করা হয় নজরুলের রাজনৈতিক চেতনা শুধুমাত্র ব্রিটিশ বিরোধীতার গণ্ডীতে আবদ্ধ ছিলো, তাহলে খুব ভুল হবে। কেননা শুধু বিদেশী শাসন নয়, সমাজে সবরকমের অন্যায়-অত্যাচারের বিরূদ্ধে নজরুল জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

“…যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধবনিবে না,

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না –

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।…”

অর্থাৎ, এ বিদ্রোহ শুধু ইংরেজদের বিরূদ্ধে নয়, বিশ্বের প্রতিটা দেশে যে হাতে গোনা কয়েকজন বেশিরভাগ মানুষকে দাবিয়ে রেখেছে, তাদের প্রত্যেকের বিরূদ্ধে ঝরে পড়ছে। বরাবর তাঁর অবস্থান প্রতিষ্ঠান বিরোধী। তার কবিতার লাইন যেন সব রকম সামাজিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির স্লোগান হয়ে উঠেছে। ২য় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরূদ্ধে সোভিয়েত দেশ যখন লড়ছে, দুর্ভাগ্যবশত: তখন মানসিক ভাবে তিনি পঙ্গু। যদি সুস্থ থাকতেন নিশ্চয় গান-কবিতায় ভাসিয়ে দিতেন।

নজরুলের ব্যাক্তি জীবনের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে রূপোর চামচ মুখে দিয়ে তিনি জন্মাননি। কতরকম কষ্ট পেয়েছেন – বিদ্রুপ, অপবাদ, প্রিয়জনের মৃত্যু শোক, স্ত্রীর পক্ষাঘাত। এত কিছুর পরেও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখার সময় কখনও চুপ করে থাকেনি তাঁর কলম। টাকা-পয়সার অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়ে যায় নি। বরং, কষ্টগুলো জমাট বেঁধে তাঁকে আরও পোড় খাওয়া করে তুলেছে। লাভের আশায় বা লোভে পড়ে শাসকের কাছে কখনই তিনি বিকিয়ে যান নি। যাই-হোক না কেন তাঁর ‘চির উন্নত শির’। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তিনি আসলে কি করতে চেয়েছেন তা বলেছেন:

“…রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,

তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,

…যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,

যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।…”

এ-সব থেকে মনে করা যেতেই পারে নজরুলই আমাদের ভাষায় প্রথম রাজনৈতিক কবি। গত শতকের চল্লিশের দশকে সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দিনেশ দাস প্রভৃতি পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা সেই ধারার যোগ্য উত্তরাধিকারী। ওই দশকেই ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কর্মী হিসেবে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখরা গানের জগতে একটা নতুন পর্যায় চালু করেন – ‘গণসঙ্গীত’। ইতিহাসের তথ্য ঘেঁটে বলা যেতে পারে এরও সলতে পাকানোটা শুরু হয়েছিলো নজরুলের লেখা স্বদেশী গানের মধ্য দিয়ে।

আজকের ভারতবর্ষে আমরা দেখছি আবার সেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিপদ ফিরে এসেছে। একদিকে দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে অভাব-দেনা, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা পাষান স্তুপের মত জমা করে রাখছে গুটি কয়েক অসুর। সামাজিক ন্যায় তো প্রায় সোনার পাথর বাটি। দিকে দিকে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ, রোজ যেমন সূর্য ওঠে, বছরে ৬টা ঋতু আসে, তেমনভাবে এই সংকটগুলো সমাজ জীবনে নিয়মে পরিণত হচ্ছে। আর এই আক্রান্ত সময়ে দাঁড়িয়ে কৃষ্টিবান মানুষেরা অনেক বড় বড় বুলি কপচাচ্ছে; কিন্তু ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার নিদেনপক্ষে দেশের দুঃখী মানুষগুলোকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখানোর মুরোদটুকু তাদের নেই। কারণ তারা কর্মজীবনে যশ চায়, কর্তৃত্ব ফলাতে চায়। তাই শাসকের সাথে নির্লজ্জ ভাবে সালিশী করে ক্ষমতার বলয়ের ভিতরে থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রবল শক্তিশালী শত্রুর মোকাবিলা করতে তো যথেষ্ট সাহস লাগে। নজরুল প্রমান করে দিয়েছেন এ সাহস জোগাড় করা অসম্ভব ব্যাপার নয়। এর জন্য একদিকে যেমন দরকার দাঁতে দাঁত চেপে থাকা জেদ, আরেকদিকে জনগণের অজেয় শক্তির ওপর বিশ্বাস। এইটেয় সাচ্চা রাজনৈতিক কর্মীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। আশা করি, তাঁর অসাধারণ দৃষ্টান্ত আবার দাহ্য বারুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। আর সেই পাঠ শুনে কোনো তরুণ অথবা তরুণীর ইচ্ছে হতেই পারে নজরুলের মত কলম পেষা রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার।

তথ্যসূত্র:

[১] নজরুল রচনাবলী, ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা,১৯৮৩

[২] কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা – মুজফফর আহমেদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, অক্টোবর ১৯৬৯

[৩] ‘আমার সুন্দর’, দৈনিক নবযুগ, ১৭ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৯।

[ নিবন্ধে দেওয়া ছবি গুলো আন্তর্জাল থেকে নেওয়া ]

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।