সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ১১)

বাউল রাজা
তৃতীয় খন্ড (একাদশ পর্ব)
–” দেখা দাও না কাছে নেওনা
আর কত থাকি দূরে
কেমনে চিনিব তোমারে মুর্শিদ ধন হে
কেমনে চিনিব তোমারে —“
হঠাৎ করেই বাহুমূলে একটা হ্যাঁচকা টান পড়লো। ততোক্ষণে আমরা নদীর বুকে বাঁধা সেতু পেরিয়ে ওপারে এসে ডানদিকে ঘুরে নদীর তীর ধরে এগিয়ে এসেছি। হঠাৎ করেই বাউলদিদি হাত ধরে টান দিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে দিলো।
আমার পরিচিত নদী, আর সেই নদীর দুধার ধরে শ্মশান, বাঁদিকে মন্দির আর ডানদিকে মুণ্ডমালিনী তলা পর্যন্ত যে শ্মশানের বিস্তৃতি সেরকমটা আর নেই। অনেক পরিবর্তন ঘটেছে নদীর দু’পারে। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে কিছুক্ষণ হলো। আগেকার সময় হলে নদীর ধারের গাছগুলোর ডালে ডালে, পাতার রাজত্বে এতক্ষণে অন্ধকার বাসা বাঁধতো। কিন্তু এখন আগেকার মতো অন্ধকার জমাট বাঁধেনি। কিছুটা হলেও ফিকে।
— ” কি হলো রে মুকপুড়ি, গোঁসাই যে এপারের শ্মশানে সে কতা বলিস নি কেন বলি? ”
–” সত্যিই লো সই, বড্ড ভুল হয়ে গেচে। আসলে এতোদিন বাদে পদীপদাদারে দেকে এতোটাই… “
নদীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কৃষ্ণভামা ফের বাঁদিকের হাতের বাহুমূল ধরে টান দিলো।
–” মায়াজালে বন্দী হয়ে
আর কতকাল থাকিব
মনে লয় সব ছাড়িয়া
তোমারে খুঁজে লব
আশা রাখি আলো পাবো ডুবে যাই অন্ধকারে
কেমনে চিনিবো তোমারে মুর্শিদ ধন হে — “
–” কতদিন ধরে তোমাদের দেকা হয় নি গো ঠাকুর, গোঁসাইয়ের মন যে আর সবুর সইচে না গো, তর সইচে না। ”
— ” তন্ত্রমন্ত্র করে দেখি তার ভেতরে তুমি নাই
শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ি যত আরও দূরে সরে যাই
কোন সাগরে খেলতেছো লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে
কেমনে চিনিব তোমারে মুর্শিদ ধন হে
বাউল আব্দুল করিম বলে দয়া করো আমারে
নতশিরে করজোড়ে বলি তোমার দরবারে
ভক্তের অধীন হও চিরদিন, থাকো ভক্তের অন্তরে
কেমনে চিনিব তোমারে মুর্শিদ ধন হে —-“
এ গান কি কানাইদা সত্যি সত্যিই আমাকে উদ্দেশ্য করে গাইছেন? যদি সেটাই সত্যি হয় তাহলে তো আমি এতোদিন ধরে তার সাথে দেখা না করে ভারী অন্যায় করেছি।
পিটুলি তলায় বেদীর ওপরে বসে আছেন সেই দিব্য পুরুষ। পড়নে নানা বর্ণের কাপড় সেলাই করা রঙিন আলখাল্লা আর মাথায় পাগড়ি। চতুর্দিকে তাকে ভক্তজন ঘিরে আছেন। হঠাৎ করে যেন শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। দুহাতের চেটোয় ভর করে বাঁধানো বেদীর ওপর থেকে নীচে নেমে এসে দুহাত বাড়িয়ে, যেন বাহ্যজ্ঞান রহিত হয়ে তিনি ছুটে আসছেন আমার দিকে। শ্মশানের এবড়োখেবড়ো মাটি, গাছপালার উঠে থাকা শেকড়বাকড়, কাঁচা মাটি উবুড় করে দেওয়া কবরস্থানে হোঁচোট খেতে খেতে উদ্বাহু গোঁসাই দু’চোখে অশ্রুর বন্যার মাতনে ভেসে ছুটে আসছেন আমার দিকে।
দুবাহুর বাঁধনে আবদ্ধ আমরা। দুহাত দিয়ে পিঠে, কাঁধে, বাহুতে আর গোঁফদাড়ি দিয়ে মুখে, গলায়, গালে আদর করছেন আমায়। কতক্ষণ যে এভাবে কাটলো কে জানে?
— এতোদিন আঁধারে রাখলে কেনে গো গোঁসাই? আমি এমন কী অন্যায় করিচি বলো দেকি! তোমায় না দেকে দেকে আমার যে অন্দ হবার জোগাড় গো পদীপদাদা।
— সে জন্যই তো এলাম গো কানাইদা, তোমায় দেখবো বলেই তো বাউলদিদিকে দেখা মাত্রই আমি…
— দোষ নিওনি গো পদীপদাদা, আজ আর কেন যেন থাকতে পাল্লুম নে। কিষ্ণরে ডেকে তোমায় নে আসতে বললুম। পদীপের আলো বিনে অন্দকার যে বেশী করে চেপে বসে গো গোঁসাই।
লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। সত্যিই তো আমার অন্যায়ের যে লেখাজোকা নেই। কীকরে নিত্যদিন এতোকাছে এসেও এতোদিন ধরে এখানে না এসে থাকতে পারলাম আমি? বাউল চকিতে সে কথা পড়ে নিলো। আমি তখনও ওর আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে আছি।
ক্রমশ