T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় কুহেলী দাশগুপ্ত

কোন সে আপন
-বাবু কোথায় গো? আজ আপিস নাই?
–ওর বাবার ফ্যাক্টরিতে আজ বিশ্বকর্মা পুজো হচ্ছে। সেইখানে গেছে। ওদের সব এখনও অনলাইন হয়। আজ কাজের চাপ কম। ল্যাপটপ নিয়ে গ্যাছে। যদি কোন কল আসে, অসুবিধে হবে না।
-আমার বাপের বাড়িতে ও কত বড় আয়োজনে বিশ্বকর্মা পূজা হয় গো।
ভাইদের সব সোনার দোকান, বোনের ব্লাউজের ফ্যাক্টরি। সবাই পূজা করে। আমায় কেউ ডাকে না গো। এর অর মুখে জানতি পারি।
–কেন গো?বাড়ির বড় মেয়ে তুমি। তোমায় ডাকেনা!
-গরীব মাইনষেরে ক্যাডা আর ডাকে! সেই এক সময় দিগন্তর বাপে যখন অ্যালুমনিয়াম ফ্যাক্টরিতে কাজ করত, তখন অ্যাত্ত অ্যাত্ত মিষ্টির প্যাকেট আইসত। সে ব্যাটা কুইড়া। কাম কাইজ ছাড়া খালি পলাই পলাই বেড়াইতো। অ্যাত্ত বছর কত্ত কষ্ট করছি! কেউ তো খোঁজ রাখে নাই! সেই যখন আমার শ্বওরের ভুল ওষুধে দিগন্তর চোখ খারাপ হইলো, কেউ কি এক পয়সা ও ঠ্যাকাইছে! অর বাপ কাছে নাই। কম বয়সে কত ব্যাডারা খারাপ নজর দ্যায়। হেই থেইক্যাই কামে নামছি। বাবায় তেরো বছর বয়সে বিয়া দিয়া দিছিলো। পড়া ল্যাখা বেশি করি নাই। মাইনষের বাড়ির কাম ছাড়া আর কি করুম! একটা মাইয়া হইছিল। দিগন্তর কাছে ফ্যালাইয়া রাইখ্যা কামে বাইর হইতাম। শ্বওর তহন ননদের কাছে থাইকতো। ঘরে তালা মাইরা পোলাপাইন গো রাখি কামে যাইতাম। একদিন কাম শ্যাষে আইয়া দ্যাখি, মাইয়াডা মইরা পইরা আছে। দিগন্ত তখন তিন বচ্ছরের। কিছু কইতে পারে না, কি হইছে। সবই অদ্দিষ্ট গো।
–দিগন্তর বাবা কখন ফিরলো? তোমার বাবা মা ও তোমার খোঁজ নেয়নি?
-বাবায় আইতো মাঝে মাঝে। খুব কাঁইদতো। কইতো, “তুই চল আমার লগে, তরে আবার বিয়া দিমু। তর পোলারে আমি মানুষ করুম”।
আমি রাজি হই নাই। মাইয়া মাইনষের কয়বার বিয়া বইতে লাগে! একে তো বন্ধুর পোলার লগে বিয়া দিছে খোঁজ খবর না লইয়া। হ্যাগো কতায় আবার বিয়া করুম! আমার জীবন আমারে বইতে হইবো। দিগন্ত র বাপে মাঝে মাঝে আইতো। আবার কখন না কইয়া পলাইতো ! কয়দিন আমার ঘাড়ে বইস্যা গিলতো। কি আর করুম! কুত্তা, বিলাই রে ও মাইনষে খাতি দ্যায়। হেই তো পোলার বাপ।
–এই করেই মরেছ। তোমায় কে দেখে তার নাই ঠিক। তুমি বসিয়ে খাওয়াও আর নিজে খেটে মর।
-আমাগো অদ্দিষ্টে আর কি ভালা হইব! অন্ধ পোলাডারে পড়াল্যাখা শিখাই মানুষ করতি চাইলাম। সে ও বিগড়াইলো। মাইনষের বাড়ির কাম সাইরা ভুপেন্দ স্মৃতি স্কুল, নরেন্দ্রপুর কতখানে না ছুটছি! পোলাডা পড়াল্যাখায় খারাপ আছিল না। মাস্টারেরা অরে খুব ভালাবাসতো। অন্ধ গো পড়ার খরচ আছে। স্কুল থেইক্যা ফিরি কইরা দিছিলো। তয় রিডার লাগে। তার খরচ আমি দিতাম। ব্রেইল সিস্টেম না কি কয় তার খরচ কিছু দিতে হইত। অ্যাত্ত করি কি হইল! গান শিখাইলাম , স্কুল থেইক্যা মোমবাতির কাম শিখাইলো। একখান মেশিন ও কিন্যা দিছিলাম। ব্যাবাক বেইচ্যা, থুইয়া আরেক আন্ধা রে বিয়া করছে। আমার কপালে আর সুখ আছে গো! অর বাপ যখন শুধরাইলো, ফিইরা আইলো। ঘরে বইয়া খালি খিচ খিচামি করে। একখান ভ্যান কিইন্যা দিছিলাম। অই মালপত্তর টাননের কাম যা পাইতো, বাজার আনতিই ট্যাকা ফুরায়। চিরটাকাল আমারেই টানন লাগছে। দিগন্ত টেরেনে গান গায় , ভিক্ষা করে বউ নিয়া। এমন কি চাইছিলাম আমি! অরে ও দু খান বক্স কিইন্যা দেওন লাগছে। না দিলে অশান্তি করে। কয়,” কিছু যখন দিতি পারস না, জন্ম দিছিলি ক্যানে?”কি আর করুম, এমন কতা ও হুনন লাগে।
–আর বোল না গো মাসি। শুনতে ভালো লাগে না।
-কি করুম!যা কতা, তোমাগো কাছেই কই। বাপের বাড়ি কোন মুখে যাই!
মাইনষের বাড়ি কাম করি। কাউরে কইতে পারিনা। হ্যারা সব পয়সাঅলা। বিয়া শাদীতে ডাইকলে শরম লাগে। ভালা কিছু তো দিতে পারি না। মা থাকতি ছোট ভাইরে খালি খবর নিতি পাঠাইতো। কইতাম, সইন্ধ্যার পর আইবি। বাড়ি থাকিনা। ফ্যাক্টরিতে কাম করি। মিছা কতা কইতাম। মা ও মইরা গ্যাছে। অখন আর কেউ খোঁজ করে না। বিয়ার পরথম ,পরথম দিগন্তর বাপের কত আদর বাপের বাড়ি গ্যালে! ভাই বইনেরা জামাইবাবুর লগে কত রগড় কইরতো! আটকুইড়া ব্যাডা! ব্যাবাক নষ্ট করছে। পরে ,পরে কেউ আর ভালা করি কতা কইতো না। আমার কত মানে লাগে! না খাই থাকুম, তবু কারো দ্বারে হাত পাতুম না। যেইবার দিগন্তর বাপের ক্যান্ছার ধরা পইড়ল, কামের বাড়ি থিইক্যা,তোমরা যা সাহায্য দিছ। হেই নিয়া মেডিক্যালে গেছি। যতখানি পারছি গতর দিয়া মানুষডারে বাঁচাইতে চ্যাষ্টা করছি। কপালে নাই তাই। হেই সময় কেউ তো খোঁজ নেয় নাই! বোনের পোলারে ডাকছিলাম, আমার লগে হাসপাতাল যাওনের লাইগ্যা। দুইদিন আইয়া কয়,”মাসি আর পারুম না। আমার পড়ার ক্ষেতি হইছে।” হেয় আবার আই ,আই,টি না কি কয় হিয়ানে পড়ে। ল্যাখা পড়ায় ভালা। আমার বুইনঝি ইস্কুলে মাস্টারি করে। তাগো ট্যাকা পয়সার অভাব নাই। কি আর করি!
পরের পোলারে কি আর জোর করতি পারি! নিজেরটাই কুনোদিন লগে যায় নাই। চক্ষে দ্যাখে না। তয় ব্যাবাক দুনিয়া ঘুইরা আইয়ে বউডারে লইয়া। দিগন্তর বাপ মরার পর হগ্গলে আইছে। তা ও আইছে, হেই আমার কপাল। দুই দিন ভাই, ভাইয়ের বউ, বুইন, ভাইপো ,ভাইঝিরা আছিল। তাগো কত কতা! আমার বাড়ি কত অসুবিধা! এইডা নাই, ওইডা নাই। কইতে তো পারি না ,বাবা দেইখ্যা শুইন্যা বিয়া দিছিলো। নিজে তো করি নাই।
–বিনি অবাক হয়ে শোনে মাসির কথা গুলো। সবিতা মাসি তাদের অনেক কালের পুরনো কাজের লোক। কাজের মাঝে সব সময় আপন মনে বকে যায় মাসি। এতটা বিশ্বাসী যে , বাড়ির চাবি দিয়ে যেতে ও কোন শঙ্কা জাগেনা মনে। কত ধনী পরিবারের মেয়েকে লোকের বাড়ি কাজ করে পেট চালাতে হচ্ছে! এমন আপন জন সব! খোঁজ রাখেনা। ভাই বোনদের অঢেল জায়গা জমি, সোনার কারবার। অথচ এ বেচারীকে পরের বাড়ি বাসন মেজে উপায় করতে হচ্ছে। বিনির মনটা উদাস হয়। ঈশ্বর যেন বড্ড একচোখা কিছু ক্ষেত্রে! সবিতা মাসি তো কবে থেকেই এভাবে দিন কাটাচ্ছে। বয়স হচ্ছে। আর কতদিন এভাবে খেটে খাবে!বিনি চাইলেও অন্ধ ছেলের মায়া কাটিয়ে মাসি ওদের সাথে থাকতে পারবে না। কিছু করার উপায় থাকেনা। ছেলের অপদার্থতা দেখে শ্বশুরমশাই বাড়িখানা মাসির নামে করে দিয়েছিল -এটাই মন্দের ভালো। বাড়িতে একটা ঘর ভাড়াটে বসিয়েছে। তাতে কিছু আয় হয়। বিনির সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল সেদিন, যেদিন মাসি এসে কেঁদে বলেছিল,
-দিগন্তরে এতো কষ্ট কইরা পড়া লেখা করাইলাম।হেয় অখন আমি মাইনষের বাড়ির কাম করি ,কইতে শরমায়। অর একখান কামের খবর আইছে। হাতের কাম শিখাইবো, লগে অডারি কাম ও দিব। কাউন্ছিলারের সই লাগবো। অরে কইছে দরখাস্ত করতে। মায়ে মাইনষের বাড়ি কাম করে হেইডা লেইখ্যা দিছিলো দরখাস্ত তে আমাগো পাশের বাড়ির পোলাডা। কাউন্ছিলার পইড়া নাকি জিগায়,”তর মা মাইনষের বাড়ি কাম করে? ইহানে ল্যাখা আছে”। দিগন্ত ছিডিখান ছিইড়া ফ্যালাইয়া বাড়ি আইয়া কি অশান্তি! এই কাম কাইজ কইরাই তো অরে বড় করলাম। পাশের বাড়ির পোলাডারে মারতি যাতি চায়। কত হাত পাও ধইরা আটকাইছি। আমার কতা কেউ ভাবে না গো। শুধু কইরা মরি।
সবিতা মাসির চোখ ছলছল। বিনি সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পায়না। এক মা হয়ে অন্য মায়ের কষ্ট সে অনুভবে ছুঁয়ে যায়। হৃদয় তোলপাড় করা কষ্ট গুলো চেপে ক্ষত বিক্ষত হতে হয়। এ কষ্ট উজার করে বলে ও মন শান্ত হয় না।