অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ১০)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু
সারাদিনের ভিক্ষাপাত্র আমার
সারাবেলার আকুলতার তৃষা
আমার মধ্যে অন্য যে এক আমি
মাধুকরী ,তার খুঁজে পেল কি দিশা ?
সেই বেলা এগারোটা দশে সকাল দুপুরের সন্ধিক্ষণে, ঠিক যেভাবে উন্মনা ও সমবেত জোড়া জোড়া চোখগুলো বিস্মিত হয়েছিল , ভালোবাসার দিগন্ত যে ভালোলাগাকেও বিশাল ব্যাপ্তি দেয় ; তা , মা ও মেয়ের সঙ্গে একলা কাটানো জীবনে উন্মনা তো ভুলতে বসেছিল। এতগুলো স্নিগ্ধতার চোখ ওকে দুচোখ ভরে দেখছে ? অমলেন্দু স্যার যে মুহূর্তে উন্মনার অনুষ্ঠান সূচনা পর্বটি নিঁখুত সমঝদারিতে মাথা নেড়ে সাবাসি দিলেন , সেই মুহূর্তে খোলা মঞ্চের ডানদিকে , হাতে কাগজপত্র নিয়ে চেয়ার পেতে বসা কবি প্রলয় ও মেঘলাদি দুজনেই যেন প্রশ্রয়ের নিঃশব্দ হাসি দিয়ে জানালো — বন্ধু এগিয়ে যাও । কী দিয়ে শুরু করেছিলো উন্মনা ? শুরু করেছিলো সেই শব্দগুলো দিয়ে , যা বাংলা শব্দ ভান্ডারে থাকলেও বিশ্বকবির কল্পনা কাব্যগ্রন্থের অঞ্জলি কবিতার আগে কেউ তেমন ভাবে বলতে পারেনি।উন্মনা কি আবৃত্তিশিল্পী ? না । উন্মনা কি পেশাদার অভিনেত্রী ? না।
উন্মনা কি ক্ষণিকার কৃষ্ণকলি ? তাও না !
তবু, খুব সাধারণ মানুষও যখন কবিতা অথবা গানের উচ্চারণে,বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের তিস্তা নদীর মতো তরঙ্গে তরঙ্গে হেসে ওঠে , তখন সেটা শিল্প হয়ে ওঠে। মঞ্চের একেবারে সামনের আসনে বসে অমলেন্দুর মনে হল, রবীন্দ্রকবিতা কেমনভাবে নিবেদন করতে হয়, অন্তত আত্মনিবেদনের কবিতাগুলো , তা অনেক বাচিকশিল্পীই জানেন না। উন্মনা যখন এই কবিতার গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে যাচ্ছিল , সেই তন্মুহূর্তে , কবিতার শব্দগুলো যেন বাংলা ভাষাজননীর কপালে স়িঁদুরের টিপের মতো জ্বলজ্বল করছিল —
হে মোর অতিথি যত , তোমরা এসেছো এ জীবনে , কেহ প্রাতে,কেহ রাতে ,বসন্তে , শ্রাবণ বরিষণে…
কবিতা শেষের রেশ নিয়ে উন্মনার হৃদয় গেয়ে উঠলো —
আকাশে কার ব্যাকুলতা,বাতাস বহে কার বারতা,এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না ,তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে ,কেউ তা জানে না…
গোটা অনুষ্ঠানটার মূল সুর বেঁধে দিয়ে উন্মনা যখন জঙ্গলমহলের ব্যাপক গানওয়ালা পাগলা বিন্দাসকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে এলো ,তখন তার হাতের তারযন্ত্র , কোমরের ডুগডুগি ,পায়ের নুপূরেও যেন রবিঠাকুরের কবিতা গান লেগে আছে , উন্মনার কন্ঠস্বরের নম্রতা ছুঁয়ে আছে । মাইক্রোফোনের সামনে চোখ বুজে হয়তো বনদেবতাকেই প্রণাম করলো সেই গানওয়ালা । তারপর যেন মুহূর্তের মধ্যে মুঠোয় নিয়ে নিলো গোটা মঞ্চ– তরুণ-প্রৌঢ়-মাঝবয়সী কবিদল এবং স্কুলের বাইরে মাইকের আলতো আওয়াজে গানের টানে প্রাণের কাছে ছুটে আসা মুঠো মুঠো পথচলতি ভিড়,বাজার ফিরতি মানুষ , ড্রয়িং-ক্যারাটে-আবৃত্তি -নাচের ক্লাস থেকে ফেরা মা ও শৈশব , ঝরে যাবার ঠিক আগে শীতের লাল ধুলো মাখা পলাশের পাতা ও হলুদ বসন্ত পাখি– সবাইকে একসঙ্গে। সেই কোন ভোরে উঠে বাসে এতটা পথ পেরিয়ে আসা , মাটির আঁচলের বাউল বিন্দাসের তিনটি গানে কবিসম্মেলনের শুভারম্ভটি যাকে বলে জমে ক্ষীর হয়ে গেল–হা রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দে রে দে রে,যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে….
তারপর? আমি হারাইলাম দুকুল , একুল আর ওকুল,কবে ফুটিবে আমার বিয়ার ফুল…
গানটা শুরু করেই চূড়ান্ত নাটকীয়ভাবে থেমে বললো– এ গান আমি দুজনকে উদ্দেশ্য করে গাইছি। এক নম্বরে এই বুড়ো খোকা আমি , আর দু নম্বরে আমার গুরু ,আমার চির নমস্য কবি অমলেন্দু মন্ডল । আমার না হয় ঠিকানা নেই , কিন্তু ওনার একটা স্থায়ী ঠিকানা তো চাই , তাই এই গান।
আর সবশেষে সেই আশ্চর্য শচীনকর্তা ও কিশোর কুমারের যুগলবন্দী — বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা…
হাঁ ইতনা মধুর ইতনা মধুর তেরা মেরা প্যার , লেনা হোগা জনম হামে কঁহি কঁহি বার…
তুমুল হাততালির মধ্যে এটাই ঠিক হল যে, শেষ বিকেলে বিন্দাস আবার গান গাইতে মঞ্চে উঠবে। ওর গানের পরেই প্রথম পর্ব শেষ । উন্মনার শান্ত মুখশ্রী শীতের হালকা হাওয়ায় কেঁপে উঠে মুখের ওপর এসে পড়া একগুছি চুলকে আলতো সরিয়ে, যখন পরম শ্রদ্ধায় কবি ও সাংবাদিক অমলেন্দু মন্ডলকে মঞ্চে আসার জন্য আহ্বান জানালো , যখন মেঘলাদি তার প্রিয় বন্ধুকে এবং স্থানীয় কয়েকজন বিদ্বজ্জনকে একই সঙ্গে মঞ্চে নিয়ে এলো , তখন শীতের নরম মিঠে সহনীয় রোদ্দুর যেন কবিতা হয়ে ডানা মেলে দিলো। স্বভাবতই সংক্ষিপ্ততম ভাষণে মেঘলার উচ্ছ্বাসহীন অথচ অনুভূতিপ্রবণ বন্ধু-পরিচিতি অমলেন্দুকে সত্যি সত্যিই লজ্জায় লাল করে দিলো। মেঘলাদির পাশে দাঁড়িয়ে উন্মনার সেই মুহূর্তে মনে হল– বিড়ির ধোঁয়া বা গাম্ভীর্যের মুখোশটা পুরোপুরি মিথ্যে। এই পঞ্চাশের কাছাকাছি মানুষটা আসলে শিশুর মতো সরল। ভানহীন প্রজ্ঞা ও বিনম্র সরলতা মিলেমিশে মানুষটাকে মনে হল , শালজঙ্গল ঘেরা ছোট্ট একটা টিলা ; যেখানে হয়তো এখনও মানুষের পা তেমনভাবে পড়েনি। হাতের পুষ্পস্তবক টেবিলে নামিয়ে রেখে অমলেন্দু ধীরে ধীরে মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চারিদিকের গাছপালার দিকে তাকিয়ে যেন আপনমনেই বলে উঠলেন– শীত শেষের শূন্য শাখার লজ্জা ভুলে , কিছুদিনের মধ্যেই আসবে প্রথম বসন্ত। আসুন আমরা শীতঘুমের জড়ত্ব থেকে কবিতার বসন্তে যাত্রা শুরু করি। তারপর, মন্দ্রকণ্ঠে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন সুকুমার রায়ের চিরদিনের কবিতা–
যে আনন্দ ফুলের বাসে
যে আনন্দ পাখির গানে
যে আনন্দ অরুণ আলোয়
যে আনন্দ শিশুর প্রাণে…
দু একটা কথা বললেন কবিতার স্বাভাবিক উচ্চারণ ও চলন নিয়ে। তারপরে বললেন , কবিতার ক্ল্যাসিক নিবেদনের কথা । অমলেন্দুর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, রত্নাকর থেকে পরিবর্তিত বাল্মীকির প্রথম উচ্চারণ। একজন টিপিক্যাল তোলাবাজ বা কথায় কথায় রক্তারক্তি দেখতে চাওয়া অসামাজিক রত্নাকর, ঠিক যেভাবে বারো বছরের সাধনায় ক্রমশ বাল্মীকি হয়ে উঠে , লার্জার দ্যান লাইফ মন্ত্রোচ্চারণ করলেন, সেই কথা । যাঁর হাতে একদিন রামায়ণ লেখা হবে,তার সূচনাপর্ব– মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বম গম শাশ্বতী সমঃ…
মুহূর্তের মধ্যে সাদা বোর্ডের উপর কালো মার্কার পেন দিয়ে কথাগুলোকে ফুটিয়ে তুলছিল কবি শুভব্রতর দূর্দান্ত তারুণ্য।অমলেন্দুর পরবর্তী শিক্ষাক্রম ছিল জীবনে নীরবতার প্রয়োজনীয়তা ও মনঃসংযোগ । অমলেন্দু বললেন — যে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা চুপ করে থাকতে জানেনা, তার কথা বলার কোনো অধিকার নেই । অমলেন্দু লেখালেন , ঠিক কোন পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে মনঃসংযোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো যায়।যেখানে বাজারের চায়ের দোকান অথবা কফি হাউসের হৈ হট্টগোলের মধ্যেও কোনো পরিণতমনস্ক নারী অথবা পুরুষ একাগ্র চিত্তে তার লেখা ও ভাবনার মধ্যে ডুবে যেতে পারেন । দর্শকাসনে ছুঁচ পড়লেও যেন তার শব্দ শোনা যাবে , এমনভাবে সবাই শুনছিল । মেঘলার মনে হচ্ছিল , তার চোখের আওতার বাইরে থেকে এই মানুষটা জীবনবোধের কী অতলান্ত গভীরে পৌঁছে গেছে ! এর মধ্যেই কবি প্রলয় মঞ্চে উঠে গিয়ে অমলেন্দুকে এক কাপ কফি দিয়ে এলো। মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির আগে সমস্ত দর্শক ও শ্রোতামন্ডলীও যেন এই কফির চুমুকের সঙ্গে সেই অনর্গল ও আকর্ষণীয় কথাও উপভোগ করলো। উচ্চারণ প্রসঙ্গে , অমলেন্দু জেলার তরুণ কবিদের উদ্দেশ্যে সস্নেহে বললেন — বাংলা ভাষার আঞ্চলিক নিজস্বতাকে বজায় রেখেও কবিতা,গান বা নাটকের ক্ষেত্রে , ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে হবে। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে , প্রতিটি স্পর্শবর্ণের সঠিক উচ্চারণ পদ্ধতি বুঝিয়ে দিলেন বোর্ডে এবং মাইক্রোফোনে। প্রবল উৎসাহী তরুণ কবিদের লজ্জার জড়তা ভেঙে তাদের একে একে ডেকে আনলেন মাইক্রোফোনের সামনে। দন্ত-স ও তালব্য-শ , র ও ড়– এর উচ্চারণ পদ্ধতি যখন ধীরে ধীরে করায়ত্ত হচ্ছিল, তখন সেই অল্পবয়সীদের মধ্যে কী আনন্দ ! কী যে উত্তেজনা!
নানা ধরনের মজার মজার টাং টুইস্টারের মধ্যে দিয়ে এই পর্বের শেষে তিনি শেখালেন , কীভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলা অভ্যেস করতে হয়। তরুণ কবিদের বললেন, যে কোনো বিষয়ে তাকে পাঁচ মিনিট কথা বলবার জন্য চ্যালেঞ্জ করতে।
কেউ কিছু বলছেনা দেখে একটু বিরক্ত হয়ে অমলেন্দু উন্মনাকে বললেন–ম্যাডাম, ঘড়ির কাঁটা কিন্তু আড়াইটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।এরপর লাঞ্চ ব্রেক না হলে, আপনাদের মেঘলাদি আর প্রলয় আমাকে খালি পেটেই বাড়ি ফেরার বাস ধরিয়ে দেবে। প্লিজ আমাকে যে কোনো বিষয়ে বলতে বলুন।উন্মনার মধ্যে কোনো একটা শক্তি যেন ভর করলো। সটান উঠে দাঁড়িয়ে বললো — আপনার বিষয় — আজ এই মুহূর্ত থেকে আমি ধুমপান ছেড়ে দিলাম। শুনে অমলেন্দু প্রথমে অন্তত তিন চার সেকেন্ড হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ও়ঁর স্বাভাবিক অট্টাহাসিতে যেন সুবীর সেন গেয়ে উঠলেন– ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন, ছুটে আয়রে লগন বয়ে যায়রে মিলন বীণ,ওই তো তুলেছে তান,শোনো ওই আহ্বান…
তারপর অনর্গল এবং বিদ্যুতের মতো তীক্ষ্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিতে যে কোনো নেশামুক্তির আহ্বান জানালেন সমবেত সবাইকে ; যার শেষ বাক্যটা ছিলো — বন্ধু উন্মনা ম্যাডাম, আপনাদের সঙ্গে একপাতে দুপুরের খাওয়া শুরু করবার আগেই , আমি আমার পকেট থেকে বিড়ি , সিগারেট ,আর দেশলাই এর প্যাকেট চিরদিনের মতো , ছিন্নভিন্ন স্মৃতির মতো ফেলে যাবো। আজ আপনি জাস্ট অসাধারণভাবে জীবনের অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমাকে । আজকের পরে আবার কোনোদিনও যদি দেখা হয় , আমার পাঞ্জাবির দুটো পকেটই উল্টে দিয়ে বলবো–দেখুন, দেখুন, কোথাও তামাকের গন্ধ লেগে নেই। দেশলাই এর দহন লেগে নেই । তার বদলে রয়েছে, রাশি রাশি কবিতার পাতা ;
সমাপ্ত, অসমাপ্ত, ভালোবাসার প্রলাপ-লিখন, যা কবিতা হয়ে উঠতে চেয়ে প্রতীক্ষার সীমান্তে অপেক্ষা করছে।
ক্রমশ