• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক প্রকল্পশ্রীরিয়্যাল ধারাবাহিকে প্রকল্প ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। প্রথম ভাগ)

নাম: পরিমলবাবুর পরিবারকথা

পর্ব – ১: ক্রেডিট কার্ড 

মুখ্য চরিত্র: পরিমলবাবু (বয়স পঁয়ষট্টি, ক্লার্কের চাকরি করে রিটায়ার করেছেন) পরমা (পরিমলবাবুর স্ত্রী, বয়স পঞ্চান্ন, গৃহবধূ) প্রসূন (ছেলে, বয়স ত্রিশ, আইটি ফার্মে চাকরিরত) জুঁই (পুত্রবধূ, বয়েস পঁচিশ, স্কুল টিচার) প্রীতি: (মেয়ে, বয়স পঁচিশ, কলেজে পড়ে) প্রিয়ম (নাতি, বয়েস সাত বছর, ক্লাস টু)

অন্যান্য: রমেশবাবু (পরিমলবাবুর বন্ধু), ব্যাংকের ম্যানেজার, আনন্দ: (প্রীতির প্রেমিক, ক্রেডিট কার্ডের সেলসম্যান)

সেদিন বাড়ির সকলে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসেছে কি বসেনি, পরিমলবাবুর গলা শোনা গেল, “কই গো, তাড়াতাড়ি দাও কী খেতে দেবে! আমাকে আবার বেরোতে হবে তো!”
এই বাড়ির নিয়ম হলো ব্রেকফাস্ট সবাই একসঙ্গে করবে।  তাই ওঁর ছেলে প্রসূন, পুত্রবধূ জুঁই, নাতি প্রিয়ম, সকলেই বসে পড়েছিল টেবিলে।
জুঁই তাড়াতড়ি উঠতে যাচ্ছিল, প্রসূন আটকালো।  “অরে তুমি বোসো তো, বাবা ওরকম বলে। “
জুঁই বলল, “কিন্তু উনি কোথায় বেরোবেন আজ?”
-“কে জানে, হয়তো কিছু কেনাকাটা করতে…” নির্বিকার ভাবে টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল প্রসূন।  ততক্ষ ণে পরিমলবাবু এসে হাজির।  “কই গো, হলো তোমাদের?”
রান্নাঘর থেকে হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে বেরোলেন স্ত্রী পরমা।  “ও:, সকালবেলায় যত চোটপাট! তা কোন রাজকার্যে যাবে শুনি?”
একটু মিইয়ে গিয়ে পরিমলবাবু জবাব দিলেন, “কেন, কাল বললাম যে, একবার ব্যাংকে যাবো…”
“বাবা বাবা! ব্যাংকে যাবেন উনি, তার জন্য ঘোড়ায় জীন চাপিয়ে এসেছেন!”
নাতি প্রিয়ম খেতে খেতে হঠাৎ মুখ তুলে বলল, “ঠাম্মা, তুমি কিছু জানো না।  ঘোড়া কি জিন্স পরে?”
পরিমলবাবু খুকখুক করে হেসেই আবার পরমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন।  পরমা একবার পরিমলবাবুর দিকে তাকিয়ে, প্রিয়মকে বললেন, “না দাদুভাই, জিন্স নয়, জীন, এটা… “
..”লেবু দিয়ে খেতে হয়। ” পরিমলবাবু পাদপূর্ণ করে দেন। প্রসূন, জুঁই, বিব্রতমুখে তাকে, প্রসূন বলে, “আঃ বাবা, কী হচ্ছে!”
প্রিয়ম বলে, “ওহ, সেই জীন? বুঝেছি। “
জুঁই বলে, “বুঝেছিস! কী বুঝেছিস তুই?”
-“জানি তো! দাদু আমাকে বলেছে!”
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে পরমা তাকান পরিমলবাবুর দিকে, “দাদু বলেছে? হ্যাঁ  তা বলবেই তো! দাদুর তো ওই কাজ, ছেলেপুলেদের মাথা বিগড়োনো। তা দাদু ঠিক কী বলেছে শুনি?”
-“বলেছে, একটা ছেলে ছিল, তার নাম আলাদিন, আর তার প্রদীপে একটা জীন থাকতো, যে তার সব কাজ করে দিত!”
জুঁই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, প্রসূন আর পরিমলবাবু হা হা করে হেসে ওঠে, পরমা রেগে বলে “যত্তসব!”
মোবাইলে কথা বলতে বলতে প্রীতি এসে বসে, কথা বলতে থাকে, “হ্যাঁ রে, ওই বইটাই চাই, না না নতুন এডিসন অনেক দাম, তুই ওল্ড বুকস দেখ… আরে শিপিং এর পয়সা তো লাগবেই…আচ্ছা দেখে জানা চটপট!”
প্রসূন বলল, “কিরে, তোর পিএইচডি  থিসিস তো বললি প্রায় রেডি, আবার বই কিনছিস যে?”
-“আর বোলো না দাদা, গাইড এখন বলছে থার্ড চ্যাপ্টারটা আবার লিখতে। এই বইটা রেফার করতেই হবে নাকি।  এত দাম, এখানে পাওয়ায় যাচ্ছে না, তাই আমাজন ভরসা!”
পরিমলবাবু শুনছিলেন, বললেন, “কী দিনকাল পড়েছে! আমাদের সময়ে বই লাগলে সোজ চলে যেতাম কলেজ স্ট্রিট, বিপীনদার দোকানে।  উনিই রেফারেন্স দিতেন, উনিই আনিয়ে দিতেন ঠিক কোথাও থেকে।  আর এখন ফোন করে বই আসছে!”
পরমা বললেন, “হ্যাঁ, ঐজন্যেই তোমার ডিগ্রি গ্যাডুয়েশন এর বেশী আর এগোলো না।  থাকো ওই বিপীনদার ভরসায়!”
-“আহা, সে আমি নাহয় ফাঁকিবাজ ছিলাম, কিন্তু আমাদের সময় কেউ কি আর পিএইচডি করেনি!”
জুঁই বলল, “যাই বলুন বাবা, ইন্টারনেটের যুগে কাজকর্ম অনেক সহজ হয়ে গেছে।  অনলাইন কেনাকাটা তো বটেই!”
প্রীতি বলল, “অবশ্যই! ক্রেডিট কার্ড না থাকলে আমি যে কী করতাম!”
পরিমলবাবু বললেন, “ক্রেডিট কার্ড! ওই এক হয়েছে! ধার নেওয়াটা যে কিসের ক্রেডিট, আজও বুঝে উঠতে পারলাম না!”
পরমা বললেন, “তোমায় আর বুঝে উঠতে হবেনা, দয়া করে খেয়ে ওঠো, আর কোথায় ছুটছিলে, সেখানে ছোটো!!”
ব্যাংকে পৌঁছে পরিমলবাবু খুব অবাক হয়ে গেলেন।  সাধারণত: খুব ভীড় হয়, লম্বা লম্বা লাইন হয়, কিন্তু প্রায় খালি মনে হচ্ছে তো! কাউন্টারগুলোর সামনে দুই একজন দাঁড়িয়ে, অন্য সবাই চেয়ার আর সোফায় বসে।  বুঝতে না পেরে এদিকওদিক তাকিয়ে হঠাৎ দেখলেন তার বন্ধু রমেশবাবু একটা কাউন্টারে কাজ সেরে বেরোচ্ছেন।  ডাকলেন, “আরে রমেশ!”
রমেশবাবু প্রথমে থতমত খেয়ে তারপর চিনতে পেরে বললেন, “একিরে  পরিমল! তুই ব্যাংকে এসেছিস!”
-“হ্যাঁ রে, একটা চেক জমা দিতে হবে তাই এলাম।  কিন্তু ব্যাপারটা কী বল তো?”
-“ব্যাপার! কিসের?”
-“এই যে কোনো ভীড়ভাট্টা  নেই, কাউন্টারের সামনে লাইনে গোঁতাগুঁতি নেই…”
হা-হা করে হেসে উঠলেন রমেশবাবু।  “বুঝতেই পারছি, তুই বহুদিন এ তল্লাট মাড়াসনি।  তাই জানিসনা, এখন টোকেন সিস্টেম চলছে। ”
-“টোকেন সিস্টেম? সেটা কী রকম?”
হাত দিয়ে একটুদূরের একটা মেশিন দেখালেন রমেশবাবু। “ওই মেশিনের কাছে যা, বোতাম টিপলে টোকেন পাবি।  তাতে একটা নম্বর থাকবে।  তারপর সেই টোকেন হাতে নিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকে। যে কাউন্টারে সেই নম্বর থেকে ডাকবে, উঠে গিয়ে সেখানে তোর কাজ মিটিয়ে নিবি।  নির্ঝঞ্ঝাট!”
খুব অবাক হয়ে পরিমলবাবু গুটিগুটি এগোলেন মেশিনটার দিকে।  সেখানে সাহায্য করবার জন্য এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, শুধু চেক জমা দিতে হবে শুনে বললেন, “আপনাকে কাউন্টারেও যেতে হবে না, এই চালানটা ভর্তি করে দিন আমি স্ট্যাম্প মেরে বাক্সে ফেলে দিচ্ছি!”
বেরোবার সময় পরিমলবাবু ভেবেছিলেন অন্তত: ঘন্টা দুয়েক লাগবে, পাঁচ মিনিটও লাগলোনা তাঁর কাজ শেষ হয়ে গেল!
রমেশবাবু তখন অপেক্ষা করছিলেন, তাকে বললেন, “সত্যি রে, দিনকাল অনেক বদলে গেছে!”
রমেশবাবু বললেন, “তা আর বলতে! আমাদের সময়ে দোকানে দোকানে লেখা থাকতো “ধারে বিক্রয় নাই” আর এখন লেখা থাকে “উই একসেপ্ট অল কার্ডস! ” দুজনেই হেসে উঠলেন।  তারপর পরিমলবাবু বললেন, “তা তুইও ওই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করিস নাকি!”
-“নিশ্চয়ই! কত সুবিধা হয় জানিস! যাবতীয় বিল কার্ড এ পেমেন্ট করে দিই, মাসে শুধু একটা চেক কেটে দিই কার্ডের অ্যাকাউন্টে, ব্যস ! আর তাছাড়া, সারা জীবন হিসেবে করে গুনে গেঁথে খরচ করে এসেছি, এখন শেষ বয়সেও যদি একটু হাত-পা খেলিয়ে খরচ না করতে পারি…”
বেশ আগ্রহী হলেন পরিমলবাবু, “কী রকম শুনি?”
-“যেমন দ্যাখ, গতমাসে হঠাৎ একটা বিয়ের নেমন্তন্ন এসে গেল. কুটম বাড়ি, সোনাদানা না হলে সম্মান থাকেনা.. তা এই ক্রেডিট কার্ড ভরসা! কিনে নিলাম, পরে ধীরে ধীরে শোধ করে দেব! ”
সেদিন বাড়ি ফিরেই পরিমলবাবু সকলের সামনে ঘোষণা করলেন, তিনিও ক্রেডিট কার্ড করাবেন। এতই যখন সুবিধা…
সব থেকে খুশী হল প্রীতি। “ইয়ো বাবা! এই তো চাই! দাঁড়াও, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি এখুনি।”
-“তুই আবার কী ব্যাবস্থা করবি রে! এর জন্য তো ব্যাঙ্কে গিয়ে কাগজপত্র নিয়ে…”
-“ওঃ, তুমি কিচ্ছু জানো না। এখন বাড়িতে বসেই সব হয়ে যায়, কোথাও যেতে হয় না। দাঁড়াও, আনন্দকে একটা ফোন করে দিই…”
-“আনন্দ! মানে, সেই বখাটে ছেলেটা! ক্রিকেট খেলে বেড়ায় যে?”
-“বাবা, ক্রিকেট আগে খেলত। এখন মাল্টিন্যাশনাল ব্যাঙ্কে চাকরি করে, ক্রেডিট কার্ড সেলস-এ। তোমায় সব বুঝিয়ে দেবে ও। হ্যালো, আনন্দ? তুই কাল ফ্রী আছিস? আমাদের বাড়ি চলে আয়। বাবা ক্রেডিট কার্ড করাবে। হ্যাঁ, তুই তোর সময়মতো আয়। বাবার আর কী কাজ, সারাদিন তো বাড়িতেই থাকে, নো চাপ।”
ফোন রেখে হাসিমুখে বাবাকে বলে, “বাবা, অল ডান। কাল আনন্দ কোনো একটা সময়ে আসবে, সব বুঝিয়ে ব্যবস্থা করে দেবে। আমিও চলে আসব, যদি তোমার কিছু অসুবিধা হয়। কাল কোথাও বেরিওনা কিন্তু, ওক্কে?”
পরিমলবাবু অসহায়ভাবে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। পরমাও অবাক হয়ে বললেন, “দেখেছ, কী যে যুগ পড়েছে আজকাল, সবকিছু রকেটের গতিতে হচ্ছে। কিছু বোঝার আগেই…”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরিমলবাবু বললেন, “ আসলে কী জানো পরমা, এ যুগে আমরাই বোঝা হয়ে যাচ্ছি। বড্ড বেমানান লাগে এখন নিজেদের। এই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে তো পারছিই না, টাল সামলে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারব তো!!”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।