সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিবদেব মিত্র (পর্ব – ২)

আছে – আছে – নাই রে
শ্রুতি কে? জিজ্ঞাসা করেছিল সে। আমি বলেছিলাম – কেউ না । আমি ঐ নামের সত্যিই কাউকে চিনিনা। সে বলল – ধুর্ ! তা আবার হয় নাকি? তাহলে কি তার নাম বদলে লিখছেন? আমি নিরুত্তর রইলাম, তার প্রশ্নের কাছে।
সত্যিই তো, শ্রুতি কে? প্রশ্নটা উস্কে বসে বুকের ভেতর। সময়ের জন্য কি দেব তার পরিচয়?! শ্রুতি মানে যাকে শুনে আমরা চিনি বা জানি ! কিংবা, বেদ অর্থাৎ জ্ঞান। শ্রুতি তো আমার কাছে তাই। যাকে শুনে শুনে আমি মুখস্থ করেছি অনেক অনেকদিন। জানতে শিখেছি নিজেকে নিজেই নতুন করে – সেই তো আমার শ্রুতি। আমার আদরের শ্রুতি। যার কাছেই আমার প্রথম ভালোবাসার খোঁজ। আমার আত্ম অনুসন্ধান।
এই পর্যন্ত ভেবে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীরাজ মাস্টার। অন্ধকারের স্থবির নীরবতা ভেঙে বিড়িতে আগুন ধরায় সে।
কি আশ্চর্য বৈপরীত্য! তাই না? যার জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছে দিন, যে কিনা এক এবং একমাত্র সাহারা তার, তাকেই লিখছে সে – ‘ যতই এবার মন পুড়ে যাক আর এসো না ফিরে/ বুকের কাঁদন সামলে রেখো, ঘৃণার প্রাচীর দিয়ে’। তারপর তো শ্রুতি স্মৃতি হয়ে গেছে কালক্রমে। না কি আরও গহন হয়েছে প্রেমের নিবিড়তা তা আমি জানিনা।
•
শ্রুতি তখন একটা শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমি তখন এটা ওটা পাশ দিয়ে, টুকটাক ছাত্র পড়াই। সাংবাদিকতা করি এটা ওটা কাগজে। খুব মনে পড়ে সেই দিনটা । দুপুর তখন গড়িয়ে এসেছে প্রায় । ওর ছুটি হয়েছে কলেজ । বেরিয়েই ফোন করল আমায় । কি ব্যাপার?! না, তাদের কলেজে একজন স্যার আছেন যার কি না অনেকটা মিল আমার সাথে।
হাতে ঘড়ি, একটা ফোর জি সেট, একটা ভালো শার্ট, পা ঢাকা জুতো, চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা, পকেটে মানিপার্স! অনেকগুলো বছর পর, নিজেকে যখন তেমন রূপে দেখি… আমার আজও শ্রুতিকে মনে পড়ে। আমার আমি আজও কোথায় যেন শ্রুতির চোখেই মাপি নিজেকে নিজে।
•
আনন্দজ্যোতি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের বি এডের ক্লাস। এ বছর আমাদের জেলায় আমের ফলন কম হয়েছে বেশ। আমের প্রসঙ্গে কথা হতে হতে উঠে আসে আম্রপালী আমের কথা। এক অনিন্দ্য সুন্দরী লাস্যময়ী যুবতীর যৌবনের লাবণ্যে লালায়িত হয়ে প্রায় ২৫০০ বছর আগে রাষ্ট্র যাকে বানিয়েছিল নগরবধূ বা পতিতা – উঠে আসে সেই প্রসঙ্গ।
স্বাদের দিক থেকে অনেকের কাছেই ‘আম্রপালী’ আম খুবই প্রিয় । আকারে ছোট কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে যেন সকল আমকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ‘আম্রপালী’।
আম্রপালী যে জন্মেছিল ভারতেই আজ থেকে ২,৫০০ বছর আগে । সে ছিল সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী এবং নর্তকী । তার রূপে পাগল ছিল কতই না রূপলোভী যৌবন! আর এই রূপই তার জন্য কাল হয়ে ওঠে কালক্রমে । যার কারণে তিনি ছিলেন ইতিহাসের এমন একজন নারী, যাকে রাষ্ট্রীয় আদেশে পতিতা বানানো হয়েছিল আজ থেকে অনেক শতাব্দী আগেই !
আম্রপালী বাস করতেন বৈশালী শহরে । বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের গণতান্ত্রিক একটি শহর, যেটি বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের অর্ন্তগত । মাহানামন নামে এক ব্যক্তি শিশুকালে আম্রপালীকে আম গাছের নিচে খুঁজে পান । তার আসল বাবা-মা কে ইতিহাস ঘেঁটেও তা জানা যায়নি । যেহেতু তাকে আম গাছের নিচে পাওয়া যায় তাই তার নাম রাখা হয় আম্রপালী । সংস্কৃতে আম্র মানে আম এবং পালী অর্থাৎ পল্লব হল পাতা । অর্থাৎ, আমগাছের নবীন পাতা ।
কিন্তু শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিতেই আম্রপালীকে নিয়ে হইচই পড়ে যায় । তার রূপে দেশ-বিদেশের রাজা-রাজপুত্র থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ জন্য পাগলপ্রায় হয়ে ওঠেন। নানা জায়গায় থেকে তাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া আর বিবাদের খবরও আসতে থাকে । সবাই তাকে একনজর দেখতে চান, বিয়ে করতে চান । এ নিয়ে আম্রপালীর মা-বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন । তারা তখন বৈশালীতে সকল গণমান্য ব্যক্তিকে এর একটি সমাধান করার জন্য বলেন । কারণ, সবাই আম্রপালীকে বিয়ে করতে চান । তখন বৈশালীর সকল ক্ষমতাবান ও ধনবান ব্যক্তি মিলে বৈঠকে বসে নানা আলোচনার পর যে সিদ্ধান্ত নেন তা হল, আম্রপালীকে কেউ বিয়ে করতে পারবেন না । কারণ তার রূপ লালিত্য । তাই সে একা কারো হতে পারে না । আম্রপালী হবে সবার । সে হবে একজন নগরবধূ, মানে সোজা বাংলায় পতিতা ।
এটা ছিল একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত । ইতিহাসে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কাউকে পতিতা বানানো হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত খুবই বিরল ! পতিতাবৃত্তিতে দিনে দিনে আম্রপালী বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন । তার রূপের কথাও দেশ-বিদেশে আরও বেশী করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ।
প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার । শোনা যায়, তার স্ত্রীর সংখ্যা নাকি ছিল প্রায় পাঁচ শতাধিক! নর্তকীদের নাচের এক অনুষ্ঠানে তিনি এক নর্তকীর নাচ দেখে বলেছিলেন, এ নর্তকী বিশ্বসেরা ।
তখন তার একজন সভাসদ বলেন- মহারাজ, এই নর্তকী আম্রপালীর নখের যোগ্য নয় ! বিম্বিসারের এই কথাটি নজর এড়ায়নি । তিনি তার সেই সভাসদের থেকে আম্রপালী সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তাকে কাছে পাবার বাসনা করেন । কিন্তু তার সভাসদ বলেন, সেটা সম্ভব নয় । কারণ, তাহলে আমাদের যুদ্ধ করে বৈশালী রাজ্য জয় করতে হবে । আর তাছাড়া আম্রপালীর দেখা পাওয়াও এত সহজ নয় । দেশ-বিদেশের বহু রাজা, রাজপুত্ররা আম্রপালীর প্রাসাদের সামনে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন । কিন্তু মন না চাইলে তিনি কাউকে দেখা দেন না ।
এত কথা শুনে বিম্বিসারের আগ্রহ গেল আরও বেড়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যে গিয়ে আম্রপালীকে দেখে আসবেন । কি এমন আছে সেই নারীর মধ্যে, যার জন্য পুরো পৃথিবী পাগল!
তারপর বহু চড়াই উৎরাই শেষে বিম্বিসারের আম্রপালীর সাথে দেখা করার সুযোগ আসে । আম্রপালীর প্রাসাদ এক আম্রকুঞ্জে । কিন্তু দেখা করতে গিয়ে রাজা চমকে ওঠেন- এত তো কোন নারী নয় ; যেন সাক্ষাৎ পরী ! এ কোনভাবেই মানুষ হতে পারেন না । এত রূপ মানুষের কিভাবে হতে পারে ! কিন্তু অবাক রাজার জন্য আরও অবাক কিছু অপেক্ষা করছিল । কারণ, আম্রপালী প্রথম দেখাতেই তাকে মগধ রাজ্যের রাজা বলে চিনে ফেলেন এবং জানান- তিনি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন বহু আগে থেকেই ।
এই কথা শুনে রাজার বিস্ময়ের সীমা থাকে না ।রাজা সাথে সাথে তাকে তার রাজ্যের রাজরাণী বানানোর প্রস্তাব দেন । কিন্তু আম্রপালী জানান, তার রাজ্যের মানুষ এটা কখনোই মেনে নেবেন না । উল্টো বহু মানুষের জীবন যাবে । রক্তপাত হবে । তাই রাজাকে দ্রুত এখান থেকে চলে যেতে বলেন । কিন্তু বিম্বিসার বৈশালী আক্রমন করে আম্রপালীকে পেতে চান । ওদিকে আম্রপালী তার নিজের রাজ্যের কোন ক্ষতি চান না । তাই তিনি রাজাকে তার নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠান এবং বৈশালীতে কোন আক্রমণ হলে তিনি তা মেনে নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন ।
এদিকে বিম্বিসারের সন্তান অজাতশত্রুও আম্রপালীর প্রেমে মগ্ন ছিলেন । তিনি বিম্বিসারকে আটক করে নিজে সিংহাসন দখল করে বসেন এবং আম্রপালীকে পাওয়ার জন্য বৈশালী রাজ্য আক্রমণ করে বসেন । কিন্তু দখল করতে সক্ষম হননি এবং খুব বাজে ভাবে আহত হন । পরবর্তীতে আম্রপালীর সেবায় সুস্থ হয়ে গোপনে তার নিজের রাজ্যে ফেরত যান । সেদিনও আম্রপালী অজাতশত্রুর বিয়ের প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন ।
এত নাটকীয়তার পর শেষের দিকে এসে কি হল ?গৌতম বুদ্ধর সময়কাল তখন । গৌতম বুদ্ধ তার কয়েকশ সঙ্গী নিয়ে বৈশালী রাজ্যে এলেন । বৈশালী রাজ্যে এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে দেখে আম্রপালীর মনে ধরে গেল । অনেকে ভাবলেন, দেশ-বিদেশের রাজারা যার পায়ের কাছে এসে বসে থাকে আর এত সামান্য একজন মানুষ ! আম্রপালী সেই সন্ন্যাসীকে চার মাস তার কাছে রাখার জন্য অনুরোধ করলেন । সবাই ভাবলেন, বুদ্ধ কখনই রাজি হবেন না । কারণ, একজন সন্ন্যাসী এমন একজন পতিতার কাছে থাকবেন ; এটা হতেই পারে না । কিন্তু গৌতম বুদ্ধ তাকে রাখতে রাজি হলেন এবং এটাও বললেন, আমি শ্রমণের (তরুণ সে সন্ন্যাসীর নাম ছিল) চোখে কোন কামনা-বাসনা দেখছি না । সে চার মাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে- এটা আমি নিশ্চিত !
চার মাস শেষ হল । গৌতম বুদ্ধ তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে যাবেন । তরুণ শ্রমণের কোন খবর নেই । তবে কি আম্রপালীর রূপের কাছেই হেরে গেলেন শ্রমণ ? সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে আসেন । তার পিছনে পিছনে আসেন একজন নারী । সেই নারীই ছিলেন আম্রপালী । আম্রপালী তখন বুদ্ধকে বলেন, তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে কোনও চেষ্টা বাকি রাখেননি তিনি । কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালী । তাই আজ সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের চরণে আশ্রয় চান তিনি ।
পরে সব কিছু দান করে বাকী জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন ইতিহাস বিখ্যাত সেই রমণী আম্রপালী ! ছাত্রছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতন সময় ভুলে শুনতে থাকে শ্রীরাজ মাস্টারের মুখে একটা আম ঘিরে থাকা এক রূপবতীর জীবন ও মোক্ষবোধের উত্তরণের কাহিনী।
ক্রমশ
কা হি নী র চ রি ত্রে রা কা ল্প নি ক । কা হি নী র বি নি র্মা নে সং ক লি ত । কো নো ব্য ক্তি , প্র তি ষ্ঠা ন , জা তি বা ভা বা দ র্শে আ ঘা ত এ কা হি নী র উ দ্দে শ্য ন হে ।