গল্পেরা জোনাকি তে প্রদীপ গুপ্ত

লোকটা

কালবৈশাখীটার জন্য আদৌ তৈরী ছিল না শমি।
সকাল থেকে গরমে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে রায়গঞ্জ শহরটা। ও যখন কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল তখনো যদি এতটুকুও বুঝতে পারতো তাহলে ওকে এরকম কাকভেজা ভিজতে হোত না। ওদের কলেজ থেকে বাসস্টপটা এরকম যে হেটে আসা ছাড়া কোন উপায় নেই। রাস্তার দুধারে এরকম একটা গাছও নেই যে যার নীচে একটু দাঁড়াতে পারতো শমি। এই প্রায় এক কিলোমিটার পথটা পুরো ঝড়ে বৃষ্টিতে একেবারে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে ওকে। ভিজে একদম একশা হয়ে গেছে শমি।
সবে শাড়ি পড়া শুরু করেছে সে। এতদিন স্কুলের সেই আঁটসাঁট বেধে শাড়ি পড়ার থেকে মুক্তি পেয়েছে ও। কাঁধের কাছে সেফটিপিনের শাসন নেই। নেই নাভির ওপরে তুলে পড়ার চোখ রাঙানি। বেশ একটু ঢিলেঢালা ভাবে শাড়ি পরার স্বাধীনতা পেয়েছে শমি কলেজে উঠে। এখন আর সেই নীলপেড়ে সাদা সুতিও নয়। নয়নলোভা নয়নসুক পড়ার অনুমতিও পাওয়া গেছে বাড়ির থেকে। কিন্তু এ বিপদের দিকটা তো এতদিন ভেবে দেখে নি শমি। ঝড়ে তো একদম পাল তুলে দিয়েছিল শাড়িটা। কি ভাবে যে সামলাবে। একেবারে হিমসিম খেয়ে গেছে ও। এরপর যখন আবার জলঝরা শুরু হোল মুসলধারায় তখন যেভাবে লেপ্টে গেল শরীরের সাথে সেও এক দৃশ্য।
ভাগ্যিস বাসস্ট্যান্ডে বেশী দাঁড়াতে হয়নি ওকে। স্টান্ডের চায়ের দোকানের লোকগুলো যে ভাবে চাটনির মতো চাটছিলো ওর শরীরটার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হচ্ছিলো যেন এখুনি বমি করে দেবে ও।
বাসে উঠে বসার জায়গা পেল না শমি।প্রায় আধাঘন্টার পথ, আর শাড়িটাও যে ভাবে লেপ্টে আছে! সমস্ত গোপনীয়তা গুলো যেভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে!
হঠাত করেই শমির নজর গেল লোকটার দিকে। ওর থেকে একটু দূরে বসে আছেন। সমস্ত মাথাটাই সাদা চুলে ভরে গেছে। একটুখানি কোলকুঁজোও মেরে গেছেন। ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখের পলক পড়ছে না লোকটার। কেমন যেন অসহ্য লাগছে শমির। আবার সেই গা গোলানো ভাবটা —
হঠাত করেই বসার জায়গা পেয়ে গেল শমি।একটু যেন হাফ ছাড়লো সে। কিন্তু একি! এযে সেই ভদ্রলোকের একেবারে মুখোমুখি। যাঃবাবা। আজকের দিনটা সত্যি এত বাজে,চিন্তাই করতে পারছে না শমি। বুড়োটাও একদম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।কিছু বলবে নাকি ও। কিন্তু কিই বা বলবে? বলবে এই যে দাদু আপনি আমার দিকে ও ভাবে কি দেখছেন য়্য? চোখদুটো গেলে দেব বুঝেছেন? বাড়িতে কোন মেয়ে বৌ নেই ছোটলোক কোথাকার !
অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো শমি। কিন্তু মনটাও যে কি কে জানে? মাঝে মধ্যেই বুড়োটার দিকে তাকাচ্ছে মনটা। যতবার ওদিকে নজর পড়ছে ততবারই —
নাহ। মনটাকে শক্ত করলো শমি এবারে সে ঠিক বলবেই। সহ্য করা যায় নাকি? বলতে যাবে এমন সময় লোকটা উঠে দাঁড়াল। প্রায় আশি বছর হবে।অসম্ভব উজ্জ্বল দুটো কোটরাগত চোখ।
ভদ্রলোক ওর দিকেই এগিয়ে এলেন।
কি চাইছেন ভদ্রলোক? গালাগাল দেবার জন্য নিজেকে তৈরী করল শমি। কিছুতেই ছাড়বে না। বুড়ো লোক গুলো একদম বদের বাসা হয়।কবে চিতায় উঠবে সেটা না ভেবে
” তোমাকে দেখতে না একদম আমার মায়ের মত দেখতে, একদম আমার মায়ের মুখটা যেন কেটে কেউ বসিয়ে রেখেছে তোমার মুখে। আমার মা ও যখন স্নান সেরে পূজো দিতে যেতেন”
ভদ্রলোকের দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরতে লাগলো।
” তুমি তো আমার নাতনির বয়সী হবে মা, তোমাকে তো আর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম,করতে পারবো না মা, তাই হাত জোড় করেই প্রনাম করলাম। তুমি তোমার এই বুড়ো ছেলেটাকে”
আবার ঝরঝর করে জল বেড়িয়ে এল লোকটার দু চোখ দিয়ে। সেটাকে সামলে কোন রকমে টলমল করতে করতে বাস থেকে নেমে গেলেন বুড়ো লোকটা।
শমির মনে তখন আবার শুরু হয়েছে কালবোশেখির ঝড়। ও যেন চিৎকার করে মানুষটাকে ডেকে বলতে চাইছে — এই যে শুনছেন, আমি রোজ বৃষ্টিতে ভিজে আপনার সামনে আসতে চাই, আপনি রোজ রোজ আমায় দু চোখ ভরে দেখুন। আমার মুখ, আমার চুল, আমিও যে আপনার আর এক ——
শমির চোখেও কি তখন ঝড়ের পরে বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে?

গল্পটার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার : বন্ধু ছোট বোন কবি শর্মিষ্ঠা ঘোষ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।