ক্যাফে এক মাসের গল্পে নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

অহিংসা পরমো ধম্ম
(লেখাটি সম্পূর্ণ কল্পনা প্রসুত। ঐতিহাসিক নয়।)
প্রার্থনা শেষে ঋজু ভাবে বসলেন ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমার।মন একটু উচাটন। ভগবান বুদ্ধের স্মরণ করতে গিয়ে অদ্ভুত ভাবে তার মায়ের কথা মনে এলো। মা তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। নিজের দীর্ণ অতীত জানেন নিগ্রোধ কুমার, কিন্তু বিচলিত হন না। কারণ তিনি সঙ্ঘের শরণ নিয়েছেন। তাঁর পিতা রাজ-সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। পিতামহের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। বীভৎস ভাবে পিতার মৃত্যু হয়। নিগ্রোধ কুমার তাঁর পালিতা মাতার মুখ থেকে শুনেছেন সে কথা। তাঁর গর্ভবতী মা পিতার রক্তস্নাত দেহ দেখে মূক হয়ে গিয়েছিলেন। অজাত সন্তানের জীবনের জন্যে কোন ভাবে পালিয়ে আসেন। একটি নিগ্রোধ বৃক্ষের নীচে সন্তানের জন্ম দেন। নিগ্রোধ কুমার নাম সেই জন্যেই দেওয়া। নামকরণ হবার আগেই তিনি মারা যান।একদল বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষুণী নিগ্রোধ কুমার কে উদ্ধার করে গ্রামের এক পরিবারে দিয়ে আসেন। অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেন না ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমার। তিনি কেবল সত্য খুঁজে চলেন। আত্মানুসন্ধান করেন দুঃখ নিবৃতির। সমস্ত অসহ্য থেকে ক্ষমাশীল হবার প্রচেষ্টা করেন। তবুও একমনে শরণ করলেই মাতৃমূর্তি এসে দাঁড়ায়। কি বলতে চান মা। তাঁকে দেখবার জন্যে মন তৃষ্ণার্ত হয়। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সব হারিয়ে যায়। নিগ্রোধ কুমার চোখ খুলে তাকিয়ে দেখেন ঘরে সকালের আলো। নিগ্রোধ কুমারের সেবক ভিক্ষু কনাদ এসে দাঁড়াল। খুব শান্ত স্বরে সে বলল, “মহারাজ এসেছেন, আপনি বাইরে আসবেন! না তাঁকে ভেতরে ডাকব।” নিগ্রোধ কুমার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বাইরে গিয়ে রাজা কে আপ্যায়ন করলেন। একটি শিলা নির্মিত উচ্চস্থানে রাজা কে বসতে বললেন। বদ্ধ হস্তে রাজা আনত হলেন। নিগ্রোধ কুমার রাজার গুরু। দুজনেই নানান বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন। রাজার শরীরে বহু অস্ত্রাঘাতের দাগ। বার বার চোখ চলে যাচ্ছে সেই দাগ গুলির ওপরে। নিগ্রোধ কুমারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভিক্ষু কনাদ। কনাদের দিকে রাজা তাকালেন। কনাদের বিরাট চেহারা, শান্ত চোখ দেখে রাজার ভালো লাগে। পুত্র কে দক্ষিন দ্বীপ রাজ্যে বুদ্ধের কথা প্রচার করতে পাঠাবেন। নিগ্রোধ কুমারের বয়স রাজপুত্রের চেয়ে মাত্র দুই মাসের অধিক। রাজা একাধারে তাঁর কাছে নিজের আধ্যাত্মিক জীবন সমর্পণ করেছেন, অন্যদিকে রাজপুত্রের মত তাঁকে স্নেহ করেন। ভিক্ষু কনাদ , ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমার, আর মহারাজা একসাথে বুদ্ধের শরণে প্রার্থনা করলেন।রাজা শিলালেখ করতে দেবেন ভগবান বুদ্ধের বানী। সেই গুলি নিগ্রোধ কুমার কে দেখতে বললেন। স্থপতি আর লিপিকার দুজন ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমারের পায়ের কাছে আনত হলেন। স্বস্তি বচন দিয়ে ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমার তাদের কিছু নির্দেশ দিলেন। রাজা ধীরে ধীরে প্রত্যাগমন করতে গেলেন। আর অশ্ব সঞ্চালন করতে পারেন না। তাঁর রথ আছে। একসময় প্রবল সাহসী যোদ্ধা ছিলেন।শরীরে বয়স ছোবল বসিয়েছে।বাহু শিথিল হয়েছে।কে বলবে এই রাজা তাঁর পিতার হত্যাকারী। সেই ভয়ানক উত্তরাধিকার যুদ্ধের একমাত্র বিজয়ী।
নিগ্রোধ কুমারের আজ কেবল মন চঞ্চল হচ্ছে।তাঁর মা তাঁকে কি বলতে চান! সামনে বিরাট পদব্রজে যাত্রা আছে। দক্ষিনের দ্বীপরাজ্যে যেতে হবে। তিনি নিজে সেখানে আদৌ পৌছাতে পারবেন কিনা জানেন না। কিন্তু প্রতিনিধিরা যাতে যেতে পারেন সে চেষ্টা করতেই হবে। ভিক্ষু কনাদ চুপ করে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।“আমি কিছুদিন একটু একান্ত চাই কনাদ।” নিগ্রোধ কুমার তার দিকে তাকিয়ে বলেন। কনাদ মাথা নাড়লেন, “কোথায় যেতে চান বলুন”। “আমি একা যাব, কেউ যাবে না।” নিগ্রোধ কুমার উত্তর দেন।কনাদ মাথা নেড়ে মেনে নেন।
সন্ধ্যা হবার আগেই নিগ্রোধ কুমার একা যাত্রা করলেন।
কনাদের ইচ্ছা ছিল না একেবারে একা নিগ্রোধ কুমার কোথাও যাত্রা করুন। কিন্তু কনাদ বুঝলেন তার মতামত দেওয়া উচিৎ হবে না। রাজধানীর বাইরে ছোট উপবনে এখন কেউ যায় না। সকলের চোখের আড়ালে সেখানে যেতে চাইছেন তিনি।আত্ম- জিজ্ঞাসার শেষে কি আছে সেটা এখন না জানলে আর বোধহয় সময় পাওয়া যাবে না। ভগবান বুদ্ধ নিজের মনের সত্য জানতে বলেছেন। নিগ্রোধ কুমারের যাত্রা পথে অজস্র নুড়ি পাথর। তিনি নদীর শুষ্ক জলধারার পাশেই কোথাও বসবেন। মনে আশা নিশ্চয় আজ তিনি নির্দেশ পাবেন। শুকনো বুনো ফুলের অজস্র গুঁড়ো গুঁড়ো রেনু বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাথরের গায়ে শ্যাওলা শুকিয়ে আছে। একটি ঘাস পূর্ণ জমি পেলেন নিগ্রোধ কুমার। এখানে বহুক্ষন বসে থাকতে অসুবিধা হবে না।শান্ত হয়ে কিছুক্ষন প্রকৃতির দিকে তাকালেন। আকাশে এখনো আলো আছে। মন নিবিষ্ট করে পদ্মাসনে বসলেন।জনহীন এই শুষ্ক ঘন বনাঞ্চলে তিনি যে একান্ত চেয়েছিলেন তাই পাওয়া যাবে মনে হয়। তবে দূরে তাঁকে লক্ষ্য রেখে একজন পুরুষ অর্জুন গাছের ওপরে উঠে গেল। সে শ্যেন দৃষ্টিতে তার ওপর নজর রাখছে।ভিক্ষু জানলেন না।