সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রঞ্জন চক্রবর্তী (পর্ব – ১১)

উপন্যাসের বহুমাত্রিক রূপ

সমাজের ভিতর নিরন্তর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে নানারকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ বিভিন্নভাবে সাড়া দেয়। ঔপন্যাসিক সমাজের গভীরে দৃষ্টিপাত করে সত্যের সন্ধান করেন। ব্যষ্টি ও সমষ্টির টানাপোড়েনের ফলে যেমন ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় তেমনই চরিত্রের অন্তঃসংগ্রামের দ্বারা জীবনসত্য উদঘাটিত হয়।উপন্যাসের মধ্যে নিহিত লেখকের জীবনদর্শন দ্বারা অন্যান্য উপাদানগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়।মনে রাখতে হবে লেখকের জীবনানুভূতির মাধ্যমে জীবনজিজ্ঞাসা ধ্বনিত হয় এবং উপন্যাসের মধ্যে গূঢ় জীবনজিজ্ঞাসা না থাকলে তা মহৎ সৃষ্টি বলে বিবেচিত হয় না। কোনও উপন্যাস কালজয়ী হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত হল সমাজসচেতনতা, বাস্তবতাবোধ এবং জীবনজিজ্ঞাসা।Henry Fielding, Middleton Murry, Buffon, Abrams, Miriam Allott, David Lodge প্রভৃতি সমালোচকের আলোচনা থেকে বোঝা যায় উপস্থাপন রীতির বৈশিষ্ট্যের দ্বারা ঔপন্যাসিকের সামগ্রিক জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
উপন্যাস রচনার বহিরঙ্গ রীতিগুলির মধ্যে একটি সাধারণভাবে প্রচলিত পদ্ধতি হল প্রথম পুরুষে কাহিনীর বর্ণনা দেওয়া, অর্থাৎ নিজে কোন ভূমিকায় না থেকে ঘটনা ও চরিত্রের বর্ণনা করা। এক্ষেত্রে লেখক চরিত্রগুলির মুখেই তারা যেভাবে ঘটনার সামনে পড়ল, ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া, তাদের পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদি বলে চলেন।আর একটি পদ্ধতি হল উত্তম পুরুষে কাহিনী রচনা করা, যাকে বলা যায় আত্মকথনমূলক বা autobiogtaphical রীতি। এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হল আমির কথায় কাহিনীর পরিবেশন, যে আমি হতে পারেন ঔপন্যাসিক নিজে অথবা হতে পারে উপন্যাসের কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র। First person novel নামে পরিচিত এই রীতি বরাবরই বেশ জনপ্রিয় এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে অনেকেই এই রীতি অনুসরণ করেছেন। তবে এই পদ্ধতির ক্ষেত্রে কিন্তু কথকের মুখে বাহ্য জগৎ ও অপরাপর চরিত্রের যতটুকু পরিচয় দেওয়া সম্ভব হয় পাঠকও ততটুকুই জানতে পারেন, তাই উপন্যাসের সামগ্রিকতা যাতে অক্ষুন্ন থাকে সেদিকে বিশেযভাবে নজর দিতে হয়।এর পাশাপাশি চরিত্র কথনমূলক রীতিও আলাদাভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। এই রীতির বৈশিষ্ট্য হল উপন্যাসের কয়েকটি প্রধান চরিত্র পর্যায়ক্রমিকভাবে কাহিনীটি বলে যায়। বঙ্কিমচন্দ্র রজনীতে এই রীতি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই আঙ্গিক ব্যবহার করার সময় মনে রাখতে হবে প্রধান চরিত্রগুলোর মুখের জবানীতে তাদের নিজেদের মনের কথা পরিস্কার করে বলা গেলেও তারা কিন্তু ঠিক ততটুকুই বলতে পারে যতটা তাদের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব। এর অতিরিক্ত বলতে গেলে কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া এই আঙ্গিক ব্যবহার করলে কোন চরিত্র কাহিনীর কোন অংশের বর্ণনা দেবে সেটাও সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। এছাড়া পত্রের আকারে উপন্যাস লেখা বা দলিল-দস্তাবেজ ব্যবহার করে উপন্যাসের আঙ্গিক গড়ে তোলার রীতিও প্রচলিত আছে। বঙ্কিমচন্দ্র অবশ্য সরাসরি এই রাস্তায় হাঁটেননি। তবে ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘বিষবৃক্ষ’ প্রভৃতি উপন্যাসে কৌশলে পত্রের ব্যবহার করেছেন যার সাহায্যে মূল কাহিনী কাঙ্খিত পরিণতি পেয়েছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।