চলে যেতে হয়..ঠিক যেমন মৌচাক ছেড়ে দিয়ে একদিন চলে যায় অসংখ্য মধুলোভী পতঙ্গের দল, রোদ ফেলে উবে যায় গ্রীষ্মের আঁচ, অভিমানে টনটন মাঠের বুকে নিশ্চুপ পড়ে থাকে আধখোলা মণ্ডপের কাপড়..মা চলে যান শৈলবাসিনী হয়ে। ঢাকের আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে যায় মাটির গর্ভগৃহে। বাতাসের শীত শীত ভাবটি আচমকাই পাতার উপর বোবা কান্নার পরত হয়ে জমে যায় দ্বাদশীর ভোরে। সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে দূরে কোথাও উমার সলিলসমাধির শব্দ শুনতে থাকে মর্ত্যবাসীর মনমরা কান।
মাড়িয়ে চলে যেতে হয় বলে ঘাসের রং সবুজ, দায়সারা মেঘেরা সাদা, ভেজা চোখজোড়া লাল। মানুষের হৃদয়টির রংও বোধহয় এভাবেই পাল্টে পাল্টে যায়। ছড়িয়ে থাকে শুধু কিছু অনুভূমিক মুহূর্তেরা। বিদায়ের সময় মায়ের মুখের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকতে পারি না আমি। কোনোকালেই না। নিষ্পলক তাকালেই মনে হয় যেন তলিয়ে যাচ্ছি মনখারাপের এক অতল গহ্বরে। টাটকা শিউলির মত ঢলঢলে মাতৃমুখে কালো জরুলের মত চেপে বসা বিষাদ উজ্জ্বল নিয়নের আলোয় আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জলের নীচে একটু একটু করে গলে যায় মৃন্ময়ী মা। বুকের বাঁ দিকটা প্রবল ব্যাথায় কুঁকড়ে আসে..
খোলা আকাশ বড় অদ্ভুত সুন্দর একটা ক্যানভাস। তাতে ইচ্ছে মত ফোটানো যায় আগমনী ও বিজয়া গান। মেঘে মেঘে পা দিয়ে দ্রুত চলে যায় তিথিদের ভিড়। রোশনাই, শোরগোল সবকিছুর ভিতরে কোথা থেকে এসে জোটে আবার একটি বছরের অপেক্ষা। আলতা সিঁদুরে রাজেন্দ্রানী হয়ে উমা তখন শিবানী। সন্ধ্যা সবিতা হেলে পড়ে অসহ্য অভিমানে। কাঠামো তোলার ফাঁকে ছেলেটা হিসেব করে নেয় পরের বছর বোধনের নির্ঘন্ট। ঢাকী গুনে গেঁথে নেয় পাওনা টাকাকড়ি। বাড়ি ফিরলে তবে বউটার গায়ে জড়িয়ে দেবে হলুদ ছাপা শাড়ি, ফুলতোলা বাহারি ব্লাউজ। পাকশালায় পূর্ণপাত্র অন্ন-ব্যঞ্জনের তৃপ্ত সৌরভ। উমা যে অন্নপূর্ণা।
এমনি করেই কেটে যায় উৎসবের রাত। শিশিরে শিশিরে ভিজতে থাকে একা দ্বাদশীর চাঁদ। একরাশ প্রসাধনীকে অবহেলায় সরিয়ে রেখে খোলা বাতায়নে চুল এলিয়ে তারা গুণতে বসে এক মেয়ে.. নেপথ্যে কোথাও উদাস হাওয়া ঘুরপাক খেয়ে বলে চলে–“ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ /ঠাকুর যাবে বিসর্জন…”।।