সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শ্রীরাজ মিত্র (পর্ব – ১৬)

ছায়াপথ, গুঁড়ো ছাই
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা ‘কবিকঙ্কণ’ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী’র স্মৃতিবিজড়িত স্থান আড়রাগড়। আড়রাগড় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আনন্দপুর থানার অন্তর্গত শোলাডিহার জয়পুরের একটি ছোট্ট গ্রাম। এই গ্রামেই রয়েছে মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘অভয়ামঙ্গল’ ও ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা ‘কবিকঙ্কণ’ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী’র স্মৃতিবিজড়িত জয়চন্ডী মায়ের মন্দির। বর্তমানে এই জয়পুর গ্রামে কবিকঙ্কণের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখানে একটি বট গাছের তলায় চণ্ডীমঙ্গল কাব্য সংক্রান্ত লেখা একটি বোর্ড রয়েছে। দেখভালের অভাবে এখন সেই বোর্ডের লেখাও আজ বেশ অস্পষ্ট। জনশ্রুতি রয়েছে, এই বট গাছের তলায় বিশ্রামকালেই চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনার জন্য দেবী চন্ডীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন মুকুন্দরাম। এই স্বপ্নাদিষ্ট বটবৃক্ষের পাশেই রয়েছে জয়চণ্ডীর মন্দির। আনন্দপুর থেকে ফেরার পথে আজ জয়পুর হয়ে ফিরছি আমরা। হঠাৎ মাস্টার বলল – ভাবা যায়, তা বলে সস্তার মদের নাম ঝুমুর!!
ক্রান্তি বলল- কেন মাস্টার? তোমাদের সেক্সপিয়র তো সেই কবেই বলে গেছেন, নামে কি এসে যায়? হোয়াটস ইন আ নেম ? মাস্টার বলতে থাকে- আসলে ঝুমুরের দেশ জঙ্গলমহল। জঙ্গলমহলের প্রাণের স্পন্দন ঝুমুর। সুবিস্তীর্ণ আদি জনপদের সুরের স্রোতস্বিনী জনপ্রিয় সঙ্গীত ঝুমুর। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ, কেন্দুঝাড়, সুন্দরগড় সহ ঝাড়খণ্ডের বিস্তৃত ক্ষেত্র ঝুমুরের পরিমণ্ডল। রাজস্থান, ছত্তিশগড় হয়ে আসাম, বাংলাদেশের সীমা পেরিয়ে ত্রিপুরাতেও আজ ঝুমুর চর্চার রমরমা । ঝুমুর এত বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে প্রচলিত যে একে ভারতীয় সঙ্গীতের অন্যতম ধ্রুপদের আখ্যা দেওয়াই যায়। দেওয়া যাবে না, কারণ এই সঙ্গীত আদি জনজাতিদের। উচ্চবর্ণকুলে এই সঙ্গীতের বিচরণ ক্ষেত্র নেই। তাই সহজেই তকমা পেয়ে যায় লোকসঙ্গীতের। ইতিহাস সেই ভাবেই লিখিত হয়!
কৃষি সভ্যতার সূচনাপর্বে কৃষক বা চাষিকে বলা হত কবি। কৃষকেরা একপ্রকার গান গাইতেন, যাকে বলা হত কবিগান। যা আজও ঝুমুরের দেশে প্রচলিত। একে ঝুমুরের আদি পর্বের একটি রূপ বলা যেতে পারে। আজকের মত পাতা, ডাইড় বা সমবেত গান (ভাদরিয়া ঝুমুর গান ও নৃত্য) প্রচলন ও জনপ্রিয়তা আদিকালেও ছিল। এই ঝুমুর মাটির। এই ঝুমুর বর্ণময় ভাব ও রসের বৈচিত্রযুক্ত। এই গীত দুঃখ, আনন্দের সঙ্গী। ধান কাটতে কাটতে বা বন বাদাড়ে যেতে যেতে উদাত্ত কন্ঠে আদি জনজাতির মানুষরা গেয়ে উঠে এই গীত। এমনকি বিনোদনেরও সঙ্গী এই ঝুমুর।
ঝুমুর সম্রাট সলাবত মাহাত ১৯৯৬ সালে ও আব্বাসউদ্দীন ১৯৯৭ সালে লালন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আমাদের প্রিয় ঝুমুর শিল্পী কিরীটি মাহাত। মন খারাপ হলেই, যার গানের মাটির টানে কতজনারই না মন, খুঁজে পায় শান্তি। ঝাড়খণ্ড রাজ্য থেকে একাধিক ঝুমুর শিল্পী পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এই রাজ্যের ? নাহ। এই রাজ্যে যে মদের নাম ঝুমুর! সম্প্রতি সরকার একটি সংস্থার উৎপাদিত বাংলা মদের নাম ঝুমুরের নামে অনুমোদন দিয়েছে।
অত্যাশ্চর্য হইনি। কারণ হয়তো এটাই ভবিতব্য!! এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাস্টার।
●
“মানুষটাকে দেখিনি, তবু জানতে পারি স্বপ্নে
কাঙাল ছিল অনেকখানি, কিছুটা রক্তাক্ত
বহ্নি ছিল পোষ মানানো, ঝড়ের মুঠি আলগা
বাজারগামী রাস্তা জুড়ে একলা বসে থাকত।
মানুষটাকে দেখিনি, শুধু শূন্যে রাখি আন্দাজ –
স্বভাব ছিল রুপোলি তার, বাতাসে চুল পাকত
কেমন যেন বিরহী লোক। অলীক, নাকি উন্মাদ?
তলিয়ে যাবে জেনেও, জলে বাড়ির ছবি আঁকত।
মানুষটাকে দেখিনি, আজও গল্পে পড়ি বারবার –
ঘুম পাড়াত অগ্নি তাকে, শব্দ পিছু ডাকত
ভ্রমণ বড় অসাবধানী, কোথায় নিয়ে ফেলবে…
সমুদ্রে সে নিরুদ্দেশী। অরণ্যে শনাক্ত।
মানুষটাকে দেখিনি, শুনি দরজা খুলে রাখত।
দেখিনি, তাই ধর্ম মানি। দেখিনি, তাই ঈশ্বর।
আমার মতো নাস্তিকেও হৃদয় থেকে শাক্ত।”
‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ -র কবির জন্মদিনে কবি শ্রীজাত লিখেছেন কবিতাটা। এই সময়ের কবিদের মধ্যে শ্রীজাতের প্রতি যে এক অন্য রকম দুর্বলতা আছে ক্রান্তির , তা আমরা সকলেই জানি। আজ ফেসবুক থেকে কবিতাটা আওড়াচ্ছিল ও।
হঠাৎই আমায় জিজ্ঞাসা করে বসল- আচ্ছা দাদা, স্যাপিওসেক্সুয়াল ব্যাপারটা কি গো? কি ভাবে বলি? বললাম, কি আর? মানুষ যখন কারও প্রেমে পড়ে তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই সে চেহারা, বাহ্যিক সৌন্দর্য ইত্যাদি দেখে প্রেমে পড়ে। কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছে যারা চেহারা কিংবা শারীরিক সৌন্দর্য নয়, শুধু বুদ্ধিমত্তা দেখেই প্রেমে পড়ে তারা।বিজ্ঞানের ভাষায় তাদের বলে ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’।
স্যাপিওসেক্সুয়ালদের প্রেম ও যৌনতার অনুভূতি আবর্তিত হয় মস্তিষ্ককে ঘিরে। শারীরিক সৌন্দর্য বা সামাজিক অবস্থানের চেয়ে তাদের কাছে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায় অপরদিকের মানুষটির বুদ্ধিমত্তা, মানসিক সৌন্দর্য। অপরদিকের মানুষটির গভীর চিন্তাশক্তি, কৌতূহলী মনোভাব, প্রচলিত ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার মানসিকতা তাদের প্রচণ্ড আকৃষ্ট করে। মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক আলোচনা থেকে তারা রসদ সংগ্রহ করে, এবং মনে করে কারো যৌন আকর্ষণ শরীরে নয়, বরং তার মেধায় লুকিয়ে থাকে।
স্যাপিওসেক্সুয়ালেরা কখনোই হুট করে প্রেমে পড়ে না। যেহেতু শারীরিক সৌন্দর্য তাদের টানে না, তাই প্রেমে পড়তে তাদের সময় লাগে। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগে বন্ধুত্ব হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও বৌদ্ধিক সংযোগ হলে তবেই আসে প্রেমের প্রশ্ন।
মেধা বা বুদ্ধির আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি হলেও শারীরিক আকর্ষণ যে একেবারেই নেই, তা নয়। কিন্তু স্যাপিওদের কাছে শারীরিক আকর্ষণটা খুবই সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কের জন্য কখনোই চেহারাটা বড়ো হয়ে দাঁড়ায় না তাদের কাছে।
স্যাপিওরা কাউকে পছন্দ করে মানে সত্যিই পছন্দ। এর একটা কারণ হয়তো এই যে স্যাপিওদের সহজে কাউকে পছন্দ হয় না। অনেকটা সময় লাগে। উলটোদিকের মানুষটার সঙ্গে মেধা ও বৌদ্ধিকভাবে সংযোগ স্থাপনের পরই আসে তাকে ভালোলাগার প্রশ্ন। ফলে যখন কাউকে তাদের ভালো লাগে, তখন সেটা বেশ সিরিয়াসই হয়।
স্যাপিওসেক্সুয়ালদের সব সম্পর্কই শুরু হয় বন্ধুত্ব দিয়ে, সেখানে প্রেমের ছিটেফোঁটাও থাকে না। তাই যখন মনে প্লেটোনিক স্তর পেরিয়ে প্রেমের সূত্রপাত হয়, তখন সঙ্গীটিও সেই একইরকম ভাবছেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ফলে বন্ধুকে মনের কথা বলবে কি বলবে না, তা নিয়ে মনে সংশয় তৈরি হয়।
যারা অতিরিক্ত চিৎকার, মেজাজ দেখানো, কিংবা বোকামি করে তারা স্যাপিওদের দু’চক্ষের বিষ। যারা নিজেদের অনুভূতিকে যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারে, যারা চট করে মেজাজ হারায় না, জটিল পরিস্থিতিকেও শান্তভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেন, সেরকম মানুষকেই পছন্দ করেন স্যাপিওরা।
খুব বেশি মানুষের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠতা হয় না সচরাচর। প্রেমের সংখ্যাও স্বাভাবিকভাবেই খুবই কম। সাধারণত নিজের ছোট বৃত্তেই থাকতে পছন্দ করে এরা। তাই আশপাশের অনেকেই এদের অহঙ্কারী বলে ভুল করে থাকে। যদিও তাতে বিচলিত না হয়ে নিজের পছন্দ আর ধ্যানধারণায় স্থির থাকতে পারে স্যাপিওরা।
যে ভাব-গতি ও লক্ষণ তোমার মধ্যেও কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্রান্তি… ! এই বলে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। ক্রান্তি বলল- তুমি না সত্যিই… পারোও দাদা…
ক্রমশ..
(কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের জাত্যাভিমানে আঘাত বা আরোপ- এ লেখনীর বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য নয়। যে কোনো প্রকার সাযুজ্য আকস্মিক কিংবা দৃশ্যপট নির্মাণে সংবন্ধিত।)