গল্পবাজে আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস (প্রথম পর্ব)

বর্তনের আগের ঘটনা অবলম্বনে লেখা


সব ঠক

ঘাটের উপর পরিতোষের মিষ্টির দোকান। জয় মা তারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।পরিতোষ এখন দোকানে নেই।তার বাবা আশুতোষ রয়েছে। দোকানের চেয়ারে বসে কবেকার পুরনো চশমাটা চোখে পরে।এইসময় দক্ষিণের রাস্তা ধরে দোকানের সামনে একটা মোটরবাইক এসে দাঁড়ালো ও বাইকের উপর থেকে সুদর্শন এক ভদ্রলোক নামলো।পরনে তার কালো প‍্যান্ট,শাদা শার্ট,পায়ে পালিশ করা বুট জুতো,চোখে হালকা ফ্রেমের সোনালি চশমা আর ঘাড়ে বড় ফিতা অলা কাপড়ের ব‍্যাগ।যুদ্ধ নয় শান্তি চাই লেখা।নেমে জিজ্ঞেস করল,”কাকা,মিষ্টির দোকান কার?”
আশুতোষ বলল,”আমার ছেলের।ছেলে এখন নেই।বাড়িতে আছে।চান করতে ও খেতে গেছে।চান করে খেয়ে চলে আসবে। একটু আগেই ছিল।আমাকে বসিয়ে রেখে এক্ষুনি গেল।”
“ও,আসতে তাহলে ঘণ্টা দুয়েক দেরি হবে নাকি?যদি হয় অতক্ষণ বসা যাবেনা।”
“দেরি তো একটু হবেই।এক্ষুনি গেল না!কী ব‍্যাপার,আমাকে বলুন!মিষ্টি নিবেন তো? নাকি অন্য কোন দরকার আছে?”
“না না,অন্য কোন দরকার নেই।মিষ্টি নেব।”
“বলুন, কী মিষ্টি নিবেন?আমি দিচ্ছি।”
“আপনি বয়স্ক মানুষ।আপনি দিতে পারবেন?”
“হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ,পারব।এ এমন কোন কঠিন কাজ নয়।কী মিষ্টি লাগবে,বলুন!”
“আপনি তাহলে আমাকে একশো টাকার ছানাবড়া দিন।”
“বসুন, দিচ্ছি।”
ভদ্রলোক একটা চেয়ারে বসল,”আমার কাছে কিন্তু ভাঙানি টাকা নেই।এক্ষুনি ব‍্যাঙ্ক থেকে আসছি।পঞ্চাশ হাজার টাকা তুললাম। সব পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট দিল ব‍্যাঙ্ক।আগে পাঁচশো টাকা ভাঙানি আছে কি দেখুন!”
অমনি সে এক টানে ড্রয়ার খুলে দেখে নিয়ে বলল,”অসুবিধা নেই, আছে।”
“বেশ,দিন তাহলে।”
মিষ্টি নিয়ে ভদ্রলোক পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিল,”ব‍্যাঙ্কের টাকা, নিন।”
টাকাটা সে ধ‍রল,”আর কিছু লাগবে? দই?শিঙ্গাড়া?কোল্ড ড্রিংকস?”
“এখন তো লাগছেনা।যদি লাগে পরে এসে নিয়ে যাবো।এখন এটাই থাক।”
“বেশ, থাক।”বলে সে নোটটা ড্রয়ারে অমনি ভরে রাখল।নোট ঠিক আছে কিনা দেখল না।ভদ্রলোক মানুষের কাছে নোট ঠিক না থাকা হয়?তাছাড়া ব‍্যাঙ্কে থেকে টাকা তুলে আনল বলছে।ব‍্যাঙ্ক তো আর খারাপ নোট দেবেনা।এসব মানুষ ভালো মানুষ।দেখেই বোঝা যাচ্ছে।সুতরাং ভালো টাকাই থাকবে। তাহলে টাকা দেখে শুধু শুধু সময় নষ্ট করে কী লাভ?আর তাছাড়া টাকার সে চেনেই বা কী?
টাকাটা নেওয়ার পরে সে বলল,”দোকানে আগে আমিই বসতাম।বছর চারেক থেকে আমি আর বসি না।ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছি। এখন ছেলেই বসে।তবে একেবারে বসি না বললে ভুল বলা হবে।এই দুপুর টাইমে ঘণ্টা দুয়েক বসি।ছেলে বাড়ি গিয়ে চান করে খেয়ে আসা পর্যন্ত।”
“ভালো করেন।ঠিক আছে, আসছি।”
“আচ্ছা, আসুন!আর পরে যদি মিষ্টি লাগে তো এসে নিয়ে যাবেন।এখানে ভালো মিষ্টি পাবেন সবসময়।ভালো দইও পাবেন।”
“আচ্ছা আচ্ছা।”দোকান থেকে বেরিয়ে ভদ্রলোক এবার বাইকে চাপল ও যে রাস্তা ধরে এসেছিল সেই রাস্তা ধরে চলে গেল।
খানিক বাদে একই রাস্তা ধরে আরেক ভদ্রলোক এসে ঢুকলো ও সেও একশো টাকার মিষ্টি নিল‌।তবে সে ছানাবড়া নিল না। রাজভোগ নিল।নিয়ে পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে চারশো টাকা ফেরত নিল।টাকা ফেরত দেওয়ার আগে আশুতোষ এই ভদ্রলোকের নোটটা একবার দেখল।
ভদ্রলোক তখন বলল,”নোটের কী দেখছেন?আমাদের নোটের দেখার কিছু নেই।আমরা কারও কাছে খারাপ নোট নিই না, কাউকে খারাপ নোট দিই না।খারাপ নোট আমাদের কাছে কখনও থাকেনা। আমাদের কাছে সবসময় ব‍্যাঙ্কের টাটকা নোট পাবেন।আমরা ভদ্রলোক মানুষ দেখে বুঝতে পারছেন না?আমাদের সম্মানের দাম আছে।…আমাদের নোট আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি।আর আপনি দেখছেন?ঠিক আছে, দেখুন!”বলায় নোটটা আর দেখল না আশুতোষ।ভদ্রলোকও বেরিয়ে চলে গেল।
পরে ওদিক থেকে আরেক জন ভদ্রলোক এসে ঢুকল,”কাকা,দই নেব,ভালো দই আছে?”
“আছে তো।”
“দই টক হবেনা তো?টক হলে চলবেনা। পরে ফেরত আসবে।আগেই বলে নিচ্ছি কিন্তু।”
“না না, টক হবেনা।খুব ভালো দই হবে।”
“আপনার মুখের কথা বিশ্বাস করে নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু।”
“আপনি চোখ বন্ধ করে নিয়ে যেতে পারেন।”
“বলছেন যখন দু’কিলো দই দিন।নিয়ে গিয়ে খেয়ে দেখি।আর হ‍্যাঁ, কত টাকা কিলো?”
“ষাট টাকা।সব জায়গায় যে দাম আমাদের কাছেও একই দামে পাবেন।কারও কাছে বেশি নেবো না।”
“বেশ,দু’কিলো দিন।”
ফ্রিজের ভিতর থেকে বের করে আশুতোষ ভদ্রলোককে দু’কিলো দই দিল।দই নিয়ে আগের দুই ভদ্রলোকের মতো এই ভদ্রলোকও পাঁচশো টাকার নোট দিল। আশুতোষ বলল,”আপনার কাছে ভাঙানি টাকা নেই?সবাই যদি পাঁচশো টাকার নোট দেয় অত ভাঙানি তাহলে পাবো কোথায়? ভাঙানি আছে কি দেখুন!”
ভদ্রলোক বলল,”নেই বলেইতো নোট দিলাম।থাকলে কি আর নোট দিতাম?কেন,আপনার কাছে ভাঙানি নেই?”
“আছে।কিন্তু ভাঙানি টাকা সব শেষ হয়ে যাচ্ছে তো।”
“তাতে কী হয়েছে?আবার কেউ ভাঙানি দেবে।কেউ নোট দেবে কেউ ভাঙানি দেবে।ব‍্যবসা তো এভাবেই চলে।”
আশুতোষ নোটটা হাতে নিয়ে এবার হিসাব করতে লাগল,”আপনি কত ফেরত পাচ্ছেন তাহলে?”
“আপনার দইয়ের দাম একশো কুড়ি টাকা হচ্ছে।আমি তাহলে তিনশো আশি টাকা ফেরত পাচ্ছি।”
আশুতোষ তিনশো আশি টাকা ফেরত দিল।ভদ্রলোক টাকা নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলল,”আপনার ড্রয়ারে আরও ভাঙানি টাকা থাকল তাই না?”
আশুতোষ বলল,”সে থাকল।কিন্তু আপনার মতো আর একজন এলেই তো সব শেষ।”
দোকান থেকে বেরিয়ে একটু গিয়ে একটা বাঁক।ভদ্রলোক ওই বাঁকে দাঁড়িয়ে ফোন করল,”আর একটা হবে,কুইক চলে আয়।”
প্রথম ভদ্রলোক তারপর আবার চলে এল,”বাড়ি থেকে ফোন করে একটা কোল্ড ড্রিংকস ও আরও দু-তিন রকমের ভ‍্যারাইটিজ মিষ্টি নিয়ে যেতে বলল।আপনি একটা কোল্ড ড্রিংকস ও একশো টাকার মিষ্টি দিন।”
“ঠিক আছে, দিচ্ছি।”
ভদ্রলোক সেগুলো নিয়ে এবারও পাঁচশো টাকার নোট বের করল।
“ভাঙানি হবে?”আশুতোষ প্রশ্ন করল।
“সে কী!তখন তো অনেক ভাঙানি ছিল দেখলাম।”
“আপনার পরে আরও দু’জনকে ভাঙানি দিলাম তো।সবাই নোট দিলে কত ভাঙানি টাকা থাকবে,আপনিই বলুন!”
“সে তো ঠিকই।তাও একবার দেখুন!হয়ে যাবে বলে মন হচ্ছে।”
ড্রয়ার খুলে দেখে আশুতোষ বলল,”আপনারটা কোন রকম ভাবে হবে।কিন্তু—-“
“কোন কিন্তু নয়,আপনি আমাকে দিন।”
“আপনাকে তখন আমি যে ভাঙানি গুলো দিলাম সেগুলো কী করলেন?”
ভদ্রলোক হেসে বলল,”আর বলবেন না। ওটা দিয়ে অন্য জিনিস কিনে শেষ হয়ে গেল। পকেটে এখন মাত্র বিশ টাকা ভাঙানি পড়ে আছে।এই দেখুন!”শার্টের বুক পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে দেখাল।
“ঠিক আছে, নেই বলছেন যখন ভাঙানি দিচ্ছি।আমার হয়তো একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু আপনার তো উপকার হবে।মানুষের উপকার করাই তো মানুষের কর্তব্য।এই নিন।”
ভদ্রলোক তখন হাস‍্য মুখে আশুতোষকে ধন্যবাদ জানাল,”ধন্যবাদ আপনাকে।আপনি খুব ভালো মানুষ, উদার মনের মানুষ। উপরঅলা আপনার খুব ভালো করবেন।”
ভদ্রলোক আশুতোষের কাছে তখন একটা ভালো মানুষ হয়ে গেল।যাকে বলে ভালো মানুষ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।