• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে গদ্যে অমিতাভ মৈত্র (গল্প – ৩ ।। পর্ব – ১)

সবুজ খাতা

১।

বছর পাঁচ বয়স হবে ছেলেটির। কালো গায়ের রং। মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়েছে গোড়া থেকে। সাদা পোশাক পরা পাঁচ ছ’জন মহিলা তার খোলা শরীরে অনুজ্জল হলুদ রঙের থকথকে কোন মিশ্রণ মাখিয়ে দিচ্ছে। হাড় জিরজিরে ছেলেটি শুয়ে আছে মাদুরে। মাথার নীচে ভাঁজ করা কাপড়। তার বড়ো বড়ো চোখের সাদা জায়গাগুলো আলোপড়া আয়নার মতো চকচকে। চাপা গলায় তারা কাঁদছেন হলুদ মাখানোর সময়। চোখ মুছছেন আঁচলে। ছেলেটির ঘুম পাচ্ছে হয়তো। নিরক্ত সাদা ক্ষয়রোগীর চোখ বুজে আসছে মাঝে মাঝে।
জোরালো কোনো নির্দেশের মতো, এই দৃশ্যটি আমি বহন করছি ছেলেবেলা থেকে। মনে হতো নিজের চোখে আমি নিশ্চয়ই কোথাও দেখছি এটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সময় ব্রিটিশ সৈন্যদলে ঢুকে আঠারো বছর বয়সেই বাবা/মা ভাইবোনের বড় সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী আমার বাবাকে (পরবর্তী জীবনেও যে ছিল আমাদের সংসারের প্রধান রুটি সংগ্রাহক) আমি এসব বলতাম না। আমার খারাপ লাগত প্রাণান্ত শ্রমের জীবনে বাবাকে নিরুপায় ভাবে আটকে যেতে দেখে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত দাদু ছিল। আমার অবাস্তব ভাবনা চিন্তা জানানোর জায়গা। আর ছিল আমার পিসি। দাদুকে বলেছিলাম এই দৃশ্যটা। বিকেলের মরা আলোয় ঘরে ইজিচেয়ারে শুয়ে খালি চোখে ইংরাজী খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দাদু খুব অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে। তারপর আমার মাথায় হাত রেখে সম্ভবত কোনও মন্ত্র বলছিল মনে মনে। শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কি ভয় পেয়েছি? তারপর একটু থেমে বলেছিল, “তোমার মাথায় আমি তারকব্রহ্ম নাম জপ করে দিলাম। অনেক কিছু দেখবে সারা জীবনে। কিন্তু কখনও আর দুর্বলচিত্ত হবে না। আমি দেখবো তোমাকে”। দুর্বল চিত্তর মানে পরে পিসির কাছে জেনে নিলাম।
দিন দশ বারো পর মহালয়ার বিকেলে, প্রাত্যহিক হাঁটার পর দাদু বাড়ি ফিরল ঘোর লাগা চোখে, কাঁপতে কাঁপতে। সেই ঘোরের মধ্যেই দশমীর ভোরে দাদু হাত ছাড়ল আমার। অষ্টমী পুজোর দিন ঢাকের আওয়াজ আসছে অনেক দূর থেকে। আর প্রথা বিরুদ্ধভাবে আমাদের বাড়িতে রান্না হচ্ছে তিন রকমের মাছ। মা রান্না করছে চোখ মুছতে মুছতে। ভীষণ ফ্যাকাসে মুখে বাবা আর পিসি এড়িয়ে চলছে দিদাকে। মুখোমুখি হতে চাইছে না। চার্চিলের মতো গম্ভীর মুখের ডাক্তার দাদু পনেরো কুড়ি মিনিট ধরে একটা বড়ো শিশির মতো সিরিঞ্জ থেকে ইনজেকশন দিচ্ছেন দাদুকে, ঘামে ভেজা ডাক্তার দাদুকে হাওয়া দিচ্ছে পিসি। ইনজেকসান দিয়ে অন্যমনস্কভাব মাথা নাড়তে নাড়তে দরজার বাইরে দাঁড়ানো বড়ো কাঠের ঘোড়ার বাক্সের মতো গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। মুগ্ধ হয়ে আমি ঘোড়াদুটির চোখে চামড়ার ঠুলি দেখছিলাম।
লুকোনো কান্না আর চাপা উদ্বেগ উচ্চতা পেল দুপুরে খাবার সময়। কে খেতে ডাকবে দিদাকে আর কে মাছ পরিবেশন করবে দিদার থালায়। থমথমে মুখে দিদা এলো। মাছ পরিবেশনের সময় সবাই মাটির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। সবার শরীর থরথর করছে অবরুদ্ধ কান্নায়। যেন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায়, অথবা যেন প্রার্থনাকারীর মতো দিদা প্রথমে চোখ বুজে থাকল। তারপর প্রথমেই মাছ তুলে নিল মুখে। সামান্য নাড়াচাড়া করল ভাত, তারপর উঠে চলে গেল পিঁড়ি থেকে। বাড়ির আর সবাই একসাথে কেন উঠে পড়েছিল আমি বুঝতে পারিনি। নবমীর রাত শেষে দুটো তুলসীপাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল দাদুর চোখ।
দাদু বলতো আমি যেন ভুলে না যাই একটা সবুজ খাতা আমার জন্য রাখা আছে কোথাও। কোথায় আছে, কীভাবে আছে সে-আমাকেই সেটা বুঝতে হবে। সবুজ নাও হতে পারে হয়তো। কোনো খাতাও হয়তো সে নয়। আমি ভালো চিন্তা করলে, খারাপ কাজ না করলে সেটা ঠিক খাতায় লেখা হয়ে যাবে। কে লেখে, কীভাবে লেখে এসব জানতে না চেয়ে আমার কাজ শুধু খাতায় পৃষ্ঠার সংখ্যা বাড়িয়ে যাওয়া। ভেতর থেকে যদি ভাল না হতে পারি, খাতা ছেড়ে চলে যাবে আমাকে। যে শুদ্ধ জীবনের কথা বলতো দাদু, বড় হয়ে সেই শুদ্ধতায় আমার পৌঁছনো হলো না আর। কিন্তু কখনও-কখনও মনে হতো খাতাটি আছে আর ইঙ্গিতে নিজের অস্তিত্ব কোনোভাবে জানিয়েও দিচ্ছে সে।

২।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে তখন আমার। কোনো এক অজ্ঞাত অপারেশনের জন্য সদ্য চাকরি পাওয়া বছর চব্বিশের ছোটকাকুর সাথে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাকে। আমার পরীক্ষার প্রথম দিন ভোরবেলায় লালগোলা প্যাসেঞ্জার স্টেশনে কলকাতা থেকে নেমে ছোট কাকু তার বন্ধুর সাথে রিক্সোভ্যানে মৃত দেহের মতো পড়ে থাকা মাকে বাড়ি নিয়ে এল। জানলাম মায়ের চেতনা নেই। বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়েছে, কেননা হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছে মাকে। রাতের ট্রেন বরাবর ছোটকাকুর দিকে ছুটে এসেছে প্রশ্ন-মৃতদেহ নিয়ে কেন সে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠেছে। এক বন্ধু সাইকেলে নিয়ে যাবে আমাকে দূরের পরীক্ষা কেন্দ্রে। যাবার আগে বাবা বলল, সম্ভবত মা জল চাইছে আর আমি যেন কয়েক চামচ জল মাকে খাইয়ে দিয়ে যাই। জল খেল না মা। ধূসর চোখে তাকাল আমার দিকে। চিনতে পারল না। চোখ বুজল আবার।
পরীক্ষা দিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরতে বোন জানাল, মা নাম জিজ্ঞেস করছে ওর। কাছে যেতে বলছে। ও ভয়ে যায়নি। ওকে বলেছে সেতার আর আঙ্গুলিত্রান এনে দিতে। মা বাজাবে। শব্দদুটো আগে শোনেনি বোন। ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল তাই। মার অসুখ একটা ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল আমাদের। ছাদে লুকিয়ে নিঃশব্দে মাঝে মাঝে কাঁদতে দেখেছি বাবাকে। সেই কান্না থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করতাম বিপদ ঠিক কত দূরে দাঁড়িয়ে, মা আর মোটামুটি কতদিন বেঁচে থাকছে।
মাকে যাবার আগে জল খাইয়ে যাবার কথা রোজ বলত না বাবা। একটা কোনো ভীতিজনক সম্ভাবনা ছড়িয়ে দিত বাবার সেই নির্দেশ। জোর করে সেই ভয় সরিয়ে ঝুঁকে পড়তাম পরীক্ষার খাতার ওপর আরো একাগ্রভাবে। কিন্তু অর্থনীতি পরীক্ষার দিন বাবা আবার তৃষ্ণার কথা বলেছিল মায়ের, আর জল খাওয়ানোর সময় আমি সবিস্ময়ে দেখেছিলাম নতুন একরকমের ছায়া নেমে আসছে মায়ের মুখে। বাবা নিজেই আজ তদারক করল মাকে জল খাওয়ানোর। পরীক্ষার হলে সেটা মনে পড়ল সহসা, কোনো সংকেতের মতো। ক্রমহাসমান উপযোগীতার উত্তর লেখা হয়ে গেছে। রিকার্ডোর খাজনা তত্বের উত্তর লেখার সময় দেখলাম আর কিছু মনে পড়ছে না আমার। মনোযোগ ফেরানোর চেষ্টা কোনভাবেই কাজে এলো না। পরের প্রশ্নগুলোর উত্তরও সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। ভয়ার্ত মুখে উঠে গেলাম স্যারের টেবিলে, যদি উনি মাটিতে রাখা আমার খাতাটা খুলে উত্তর লেখা পাতাটি একবার আমাকে দেখান। পাতাটির চেহারা দেখলেই হবে। আর কিছু লাগবে না। উনি সস্নেহে হাত রাখলেন আমার মাথায়। আমার সংকটের কারণ দুয়েক কথায় শুনে নিলেন। তারপর আমাকে বললেন চোখমুখে জল দিয়ে বাইরে আলো হাওয়ায় হেঁটে বেড়াতে। সময় নিয়ে ভাবতে হবে না। সবার শেষে উনি আমার খাতা নেবেন।
সবুজ রঙের সেই কখনো-না দেখা খাতায় শূন্যতার হাতে নিরক্ষরের ভাষায় কেউ লিখে রেখেছিল সেই দিনটির কথা। আমি বুঝেছিলাম।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।