• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিশ্বজিৎ লায়েক (পর্ব – ৮)

পূর্ব প্রকাশিতের পর…

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। মন ভাল নেই। লোকে তো বলছে পাপ করেছি তাই। দাদার হল না। ভাই এর হল না। আমার হল। কেউ কি অভিশাপ দিয়েছিল? কোন ব্রাহ্মণ ঠাকুর! কিম্বা সাধুসন্ত! মনে পড়ছে না। কী কী পাপ করেছি একবার হিসেব কষলে হয়।
১) বউ পিটিয়েছি? না।
২) বেশ্যাবাড়ি গেছি? না।
৩) ঋণধার করে লোকের টাকা মেরেছি?  ধারবাকি চাইতেই তো লজ্জা পাই।
৪) অফিসে ঘুষ? না।
৫) খুনখারাপি? ধ্যাত, মাছি মারা কেরানি হলেও জীবনে একটা মাছিও মারিনি।
আচ্ছা অতো ভেবে লাভ নেই। ভাইজির বিয়েটা ভালোই ভালোই কেটে যাক। কটা তো দিন। দাদার বারণ।
‘তুই বেরোবি না নিরু। অত ভালো কুটুম। ছেলে স্কুল মাস্টার। হাইস্কুল। বাজারের হিসেব মতো দামী পাত্রই বটে। মামনীর ভাগ্য ভাল, তাই। কোনো দাবী দাওয়া নাই। বিনে পণে বিয়ে করছে। কোনোমতে যদি জানতে পারে ভাইটা রগা। কী যে হবে- সুসাইড ছাড়া কোনো গতি থাকবে না।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে বাজারের থলি নিয়ে বেরিয়ে গেল প্রভাত বাবু মানে প্রভাত রঞ্জন পাঠক। গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলের প্রাক্তন মাস্টার।
দাদার কথাবার্তা শুনেই নিরু মানে নিরঞ্জন এর মন গেল পিছলে। আর ধরতে পারছে না। বিশেষ করে ওই দু’অক্ষরের শব্দটা বুকটাই এসে বিঁধছে। ‘রগা’ শব্দটা নিজে নিজেই বার পাঁচেক উচ্চারণ করল। কেমন যেন বমি বমি ভাব। আবার ঘুমিয়ে পড়লে কেমন হয়। দূর সকাল সকাল কেউ ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমায় নাকি! বউটাও আজকাল আলাদা শোয়। বউ কি ভাবে জিজ্ঞেস করলে হয়। না থাক কেলেঙ্কারি করে লাভ নেই।
-‘কাকু’। তানিয়া ডাকল।
-‘বল মামনি।’ নিরু তার আদরের ভাইজি তানিয়ার দিকে মুখ তুলে তাকায়।
-‘আমার না কেমন ভয় করছে। কোনো দিনই ত শাড়ি পরিনি। যদি ঠিকঠাক না হয়। কি ভাববে বল তো।’
নিরু হাসল। যাক ভাইজি এখনও আমাকে নিয়ে বিরূপ কিছু ভাবেনি। বলল, ‘ও নিয়ে চিন্তা করিস না। তোর কাকিমা সব ম্যানেজ করে দেবে। কুটুমরা কখন আসছেন রে?’
-‘দশটা এগারোটার মধ্যেই এসে যাবেন।’
-‘থাকবেন কতক্ষণ!’ খুব চিন্তিত দেখাল নিরঞ্জনকে।
-‘ ভাত খাওয়া দাওয়া করে যাবেন। তুমি তো কোনো খবরই রাখ না দেখছি। বাবা বাজার আনতে গেছে।’
-‘আচ্ছা মামনি একগ্লাস জল দে। খাই। ব্যাংক থেকে একটু ঘুরে আসি। তোর কি কিছু দরকার! লাগবে কিছু?’
-‘না, আপাতত কিচ্ছু লাগবে না। তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি এসো।’
তখন বোধ হয় চল্লিশ কিম্বা চুয়াল্লিশ। ঠিক বুঝতেই অয়ারিনি। যখন বুঝলাম তখন বাঁ হাতেএ আঙুলগুলো বেঁকে গেছে সামান্য। না, জগন্নাথ হয়নি। তার আগেই চিকিৎসা করিয়েছি। তারপর দিব্যি চাকরি করছি। কেউ কিছু বলেনি। দাদাও তো কোনোদিন কিছু বলেনি। বললে নিশ্চয় মনে থাকত। কিন্তু এই যে একটা চিহ্ন রেখে গেল। চিহ্ন খুব মারাত্মক গিফট। অথবা বেড়াল। সময়ে অসময়ে মন খিচির খিচির করে ওঠে। অর্থাৎ চিহ্ন একটা খচতোলা বেড়াল। বা, বুড়ো বয়সে অতো যুক্তি দিয়ে কথা বলার দরকার নেই। মদনের চায়ের দোকানে ঢুকল। বুকপকেট থেকে চশমাটা বার করল। খবরের কাগজটা একটু পড়া যাক ভেবে মদনকে চায়ের অর্ডার দিল। চিনি কম। এলাচ লাগবে।
-‘বসুন নিরুদা। অনেকদিন এদিকে আসেননি। আমাদেরকে ভুলে গেলেন নাকি! আর বলুন শরীর কেমন চলছে?’ কথা বলতে বলতেই মদন দুধে জল মেশাচ্ছে, চিনি দিচ্ছে। চা পাতা দিচ্ছে। কথাও বলছে। মদন এতো বকবক করে যে অনেকে মজা করে বকে ” বকবক চায়ের ঠেক’।
নিরঞ্জন এর উত্তরের আগেই মদন আবার বলে-‘ শুনলাম আপনার ভাইজির বিয়ের কথা চলছে।’
নিরঞ্জবম্ন ঘাড় নাড়ল।
না, লোকজন তো তার সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই মিশছে। কেউ তো কিছু মানে ওই শব্দটা বা ইংরেজি শব্দটাও বলছে না। আরে কোনোদিনই বলেনি। আজ বলতে যাবে কেন! তাহলে দাদা যে বলল!
মদন হাঁকল। ‘ নিরুদা, চা ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে। অত ভাবছেন কি? পরে কিন্তু ঠাণ্ডা চায়ে মেজাজ বিগড়ালে আমি ঝাড় সহ্য করব না।’
নিরঞ্জন ভাবনার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এলেন। চায়ে চুমুক দিলেন।
ব্যাংকে ঢুকেই সরোজের সঙ্গে দেখা।  হ্যান্ডসেক করল। না, বাঁ হাতের দিকে সে তাকায়নি। অনেকদিন পর দেখা। সরোজের বউ এখনও টকটকে। ব্লিচ করে। নাকি কি বলে যেন, ফেসিয়াল। ভ্রু প্লাক। এইসব আরকি! নিরঞ্জনেএ বউ এইসব কিছুই করে না। কেবল খায়, কাজ করে আর ঘুমায়। দিন দিন তাই মুটিয়ে যাচ্ছে। ধামসা পারা। কাজ মানে কেবল হেঁসেল টানা। দুঃখ হয়।
ভাইটা বিয়েই করল না। দিন রাত টোটো কোম্পানি। চাকরি আর কবিতা। কি ছাই পাশ লেখে কে জানে! পড়ে দেখেছে। কিছুই বোঝা যায় না। আবার বলে কবিতা বোঝার জিনিস নয়! একথা জন্মে শোনেনি নিরঞ্জন। না বুঝলে পড়বে কেন!
অ্য্যাই যা অনলাইন কেটে গেছে। আপডেট হবে না। পেনশনের লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে কেবলমাত্র একটা পাখা। ভেতরে তিন ফুট অন্তর অন্তর পাখা। কুলার মেশিনও বসেছে কয়েকটা। আসছে বছর এসিও বসে যাবে। কিন্তু গ্রাহকদেরও যে গরম লাগে সেটা এনারা বোঝেন কম।
আবার এক ঝামেলা, পেনশনারদের এটিএম দিলেই তো এই ঝক্যি পোহাতে হয় না। কি জানি কেন পেনশনাররা এই ব্রাঞ্চে এটিএম পান না, ভগবান জানেন।
সরোজ হাসল। বলল,’ ভগবান না জানলেও ম্যানেজার জানেন।’
সরোজ আর নিরঞ্জনের কথাবার্তা শুনছে কেউকেউ। এই কথাটা শুনেই কেউ কেউ হাসল।
নিরঞ্জন হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। বারোটা পাঁচ। বাড়ি যাওয়া হবে না। সিনেমা গেলে হয়। রিক্সা নিল। ব্ল্যাকে টিকিট কাটল। পঞ্চাশের টিকিট সত্তরে। বিকেল তক্ক সময় তো কাটাতে হবে। অ্যাই যা ফোন করছে কেউ।
-‘হ্যালো।’
-‘আমি মামনি। কাকু তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি আসবে বলে দেরি করছ।’
-‘না,  মানে ব্যাংকে আছি তো।  একটু দেরি হবে। তোরা খেয়ে নিবি।’
-‘কাকিমার সঙ্গে কথা বল।’
-‘বলো।’ মিইয়ে গেছে নিরঞ্জন।
-‘তোমার কি আক্কেল বলে কিছু নেই। আজকের দিনে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আমি এটা ওটা সামলে মরছি। ভাসুর বোয়াসিন বলে আর কিছু থাকল না। এক মাথা ঘোমটা নিয়ে যদি পড়ে যাই হোঁচট খেয়ে তবে দেখবে মজা! বুড়ো বয়সে যদি না ঘানি টানাই তবে আমার নাম মালতি নয়!’ ফোন কেটে গেল।
ভারি সমস্যায় পড়া গেল তো। সিনেমার টিকিটের আর খদ্দের পাওয়া যাবে না। একটা বার তের বয়সের ছেলে আসছে এদিকে। দেখি, সামনে আসুক।
-‘দাদু, বুড়ো বয়সে যে উথলে উঠছে…  এটা লাভ মুভি।’
-‘অ্যাঁ।’
-“দিদা কোথায়?’
-‘অ্যাই, খোকা তুই সিনেমা দেখবি!’ বলেই টিকিটটা দিতে গেল নিরঞ্জন। ‘না, না টাকা লাগবে না। মাহনি। যা।  ডান হাত থেকে টিকিটটা বাঁ হাতে নিল। নে, নে ধর।’
ছেলেটা ছোঁ মেরে টিকিটটা নিয়ে উধাও। ও কি জানতে পারল আমার হাতে কুষ্ট রোগ রেখে গেছে তার ছোবলের চিহ্ন। ও তো বাচ্চা। ও কি ওসব বোঝে।
গোয়াল ঘর দিয়ে ঢুকল নিরঞ্জন। সকালেই সাবধান বাণী শুনিয়েছে দাদা। বাঁ হাতটা পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে স্মার্টলি হাঁটছে। কী হয় কী হয় ভাবটা তখন আর নেই!
অ্যাই যা। ইনিই বোধ হয় ছেলের বাবা। ধ্যাৎ তা কেন হবে! অ্যা তো আমার কলিগ ছিল। রমানাথবাবু। এখানে।  হাতটা পকেট থেকে বার করল নিরঞ্জন।
-‘আরে রমানাথবাবু যে!’
-‘ব্যাটা, সকাল থেকে তোর পাত্তা নেই। তোর দাদাকে জিজ্ঞেস করি। উনি বললেন, শরীর খারাপ। ধূম জ্বর। আজ আর বেরোতে পারবে না। জেদ ধরলাম, অসুস্থ বন্ধুকে একবার দেখে যাব না তা কি হয়! তা হবু বউমা বলে কিনা, কাকু তো ব্যাংকে গিয়েছেন কি যে কি কাজে। জ্বর শরীরে ব্যাংক!  ক’দুন পরে গেলেই কি এমন ক্ষতি হত। আর তুই কিনা ব্যাটা, গোয়াল ঘরে লুকিয়ে… যদি না তোদের দেশি গাই দেখতে এদিকে আসতাম!’
এতদিন তো কোকড়ানো হাতেই রমানাথবাবু আর নিরঞ্জন একসাথে ফাইল সেরেছেন। না, ছোঁব না ছোঁব না করেননি কখনও। আজ কি আর করবে!
করলে, মামনির বিয়ে ক্যানসেল। বিয়ে ক্যানসেল মানে দাদার গলায় দড়ি। গলায় দড়ি মানে… উফঃ আর পারি না,  পাগল হয়ে যাব!
-‘অ্যাই এতো ভাবছিস কি! দে সিগারেট দে।’
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনে মৌজসে সিগারেট টানছে। প্রভাতরঞ্জন আসছে। ভাইকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সব গেল। কাল থেকেই আলাদা, পৃথক হাঁড়ি। কেউ আটকাতে পারবে না। বউ মরে কি শাস্তিই না দিয়ে গেল!  আমাকেও জলে ফেলে গেল আর মেয়েটাকেও। সামনে এসে দাঁড়াল।
নিরঞ্জন হকচকিয়ে সিগারেট কাউন্টার মাটিতে ফেলে দ্রুত পা দিয়ে মাড়াল।
-‘রমানাথবাবু!’ নীচুস্বরে ডাকল প্রভাতরঞ্জন।
-‘হ্যাঁ, গল্প করছিলাম। চলুন।
-‘ শেষ পর্যন্ত সারপ্রাইজ তাহলে দিলেন। তিনজনে হাঁটতে লাগল। বৈঠকখানার ঘরের দিকে। সবার প্রথমে প্রভাত রঞ্জন। মাঝখানে রমানাথবাবু। পিছন পিছন নিরঞ্জন। কাচুমাচু মুখ। অপরাধী অপরাধী লাগছে কি! ভাবল নিরঞ্জন। না, আয়না তো নেই। জানার উপায়ও নেই।
প্রভাতবাবু নিজে নিজেই বলছে। উত্তরও দিচ্ছে নিজে নিজে। ঘর শত্রু বিভীষণ। সাধে কি আর প্রবাদটা লেখা হয়েছে। যাঁরা লেখে তাঁরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে! সকালে পই পই করে বললাম। কে শোনে কার কথা। ছি ছি! ভাই নয় তো শত্রু। দেখলি তো মামনি! কাকু, কাকু করতিস ভারি। আজ পেলি তো উপযুক্ত শিক্ষা। সাবধান না হলে…
-‘প্রভাতবাবু কী সব বকছেন! কী হল কী আপিনার?’
-‘ আমাকে কেন! আপনার পিছনের লোকটাকে জিজ্ঞেস করুন, সব উত্তর পেয়ে যাবেন।’
-‘ আপনার ভাইকে! ‘
-‘ ভাই! শত্তুর, শত্তুর! মুখে নাম আনলেও পাপ…’
ঘাড় ঘোরাল রমানাথবাবু। অ্যাই,  নিরু কী হয়েছে রে! ‘
সটান বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিল নিরঞ্জন। আমি… নিরঞ্জনের হাতটা কাঁপছে। শীতের দিনে মধ্যদুপুরের রোদ তিনজনের মুখেই আলপনা আঁকছে।  এই শীতেও নিরুর কপালে ঘাম। দরদর করে ঘামছে নিরঞ্জন।
রমানাথবাবু নুরঞ্জনের বাঁ হাতের আঙুলে আলতো চুমু দিলেন। যেখানে অতীত রোগের লাঞ্ছনা সামান্য প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। নিরঞ্জনের চোখে তখন জল। দু’এক ফোটা মাটিতেও পড়ল।
প্রভাতরঞ্জন অনুভব করলেন এই শীতের রোদ কমলালেবুর মতোই সুস্বাদু।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।