• Uncategorized
  • 0

হৈচৈ ছোটগল্পে শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

যবনিকা

ফেব্রুয়ারী মাস সবে শেষ হয়েছে। বসন্তের হাওয়ায় শীত যে তখনো বিদায় নেয় নি, মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেয়। যুবক সংঘের মাঠের সিংহভাগ জুড়ে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। লাল,নীল,হলুদ কাপড়ে মুড়ে দেওয়া দেওয়া হয়েছে প্যান্ডেল চত্বর। বাঁশের খুঁটির চারধারে টাঙানো মাইকের চোঙার ভেতর থেকে ক্লাব সদস্য খ্যাপা দার গলা…’সত্বর.. সত্বর টিকিট কাটুন.. যোগাযোগ করুন ক্লাব প্রাঙ্গণে..আজই শেষ রজনী..বিল্লমঙ্গল অপেরার সেই বহু প্রতিক্ষিত ” সম্রাট শাহজাহান “… আর মাত্র হাতে গোণা টিকিট.. এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না…।’
খ্যাপা দার এই গলা নতুন নয়। ছোটো থেকে মামাবাড়ি আমার আনন্দের সঙ্গে যতটা জড়িয়ে রয়েছে, ততটাই যেন জড়িয়ে আছে অনতিদূরে এই যুবক সংঘের মাঠ।সেই কোন্ ছেলেবেলায় ছোট মামার হাত ধরে ক্লাবে এসে বারান্দায় চুপটি করে বসে থাকতাম। খেলা দেখতাম মামাদের। খ্যাপা দা রিপ্লে করে চলতো সেই তখন থেকেই। ল্যাংপ্যাংয়ে চেহারার খ্যাপার তখন অল্প বয়স। কুকুরের মতো পেট। খয়াটে, তাল তোবরানো গালে হালকা দাড়ি। হাসলে পরে দাঁত কপাটি বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু কি তীক্ষ্ণ গলা! অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য বোধহয় লুকিয়ে রয়েছে ঐ ক্যানক্যানে কন্ঠস্বরে।
এবার অনেক দিন পর মামাবাড়ি আসা হলো। ছোটোবেলার মতো সেই ঘনঘন..পারলে মা কে ছাড়াই মামার হাত ধরে চলে আসাটা এখন আর হয় না, স্কুল পড়াশোনা নানান কারণেই। সর্বোপরি সে বয়সও আর নেই। তারওপর ফাইনাল পরীক্ষা বলে কথা..তায় মাধ্যমিক। আষ্টেপৃষ্টে শেকল বাঁধা রুটিনের হাত থেকে যেদিন রেহাই পেলাম, পরের দিন ছোটো মামা এসে হাজির।
কথায় কথায় উঠে এলো যুবক সংঘের মাঠের যাত্রাপালার প্রসঙ্গ।
‘ যাত্রা.. ও আবার কেউ দ্যাখে নাকি…তার চেয়ে ফুটবল টুর্নামেন্টের ব্যাবস্থা করতে পারলি না ছোটোমামা?’
শৈশবের মামাবাড়ি… আমি একটু মাথায় বাড়লে ছটফটে মন আর বেশি ক্ষন টিকতো না একই ঘরে, একই চৌহদ্দির মধ্যে। ততদিনে মামাদের ছাড়াই আমি চলতে শিখেছি বাইরে, যুবক সংঘের মাঠে। যে মাঠে খেলা দেখতে দেখতে হাততালি দিয়ে উঠতাম বারবার ছোটো মামার ডজ আর ড্রিবলিং দেখে..সেই মাঠখানা একদিন নিজেই হয়ে গেল আমার খেলার আঙিনা।বয়সের সাথী।
কেন জানি না, আজও আমার মন জুড়ে রয়ে গেছে অনেক দিনের অদেখা সুবিস্তৃত, প্রকান্ড মাঠখানা। শুধু কি ফুটবল, ক্রিকেট খেলা.. ভর দুপুরে মা, দিদিমা,মাসিদের চোখে ধূলো দিয়ে বড় মামার সাইকেল টা চুপিচুপি নিয়ে কতদিন ঘুরে বেরিয়েছি মাঠময়।খ্যাপা দা, পঞ্চা দা মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় ঘুড়ি ওড়াতো.. লাটাই খানা ধরে থাকতাম… মাঠের ওপাশে তাল,নারকেল গাছের সারিগুলোকে ছাড়িয়ে বহুদূর উড়ে বেড়াতো সেই ঘুড়ি.. একসময় মেঘের কাছাকাছি উড়ে যাওয়া শঙ্খচিলের মতো যেন একটা টিপ হয়ে আমাদের দিকেই তাকিয়ে হাসতো ঘুড়িটা…। একপাশে ব্রতচারীতে মত্ত কচিকাঁচার দল, দুপুরে মাঠে রোদ পোয়াতে আসা মেয়ে বৌদের হাসা হাসি, গল্পগাছা… খেলাধূলা..যেমন খুশি দৌড়ে বেড়ানোর আনন্দ…উড়ে চলা ঘুড়ির পানে নির্নিমেষ চোখ… মাঠ পেরিয়ে তাল, সুপারি,নারকেল গাছের সারিগুলোকে পেছনে ফেলে বেশ খানিক দূরে ম্যানেজারের পুকুর..ঐ ওধারে বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে ঠিকরে পড়া সূর্য রশ্নি কখন যেন একটু একটু করে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিত..ছায়া দীর্ঘায়িত হতো পুকুরের জলে, গাছ গাছালীর ফাঁকে ফাঁকে,মাঠের অনেকখানি অংশ জুড়ে… তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতাম সাইকেলটা নিয়ে। ঘুড়ি ওড়ানোর কথাটা কিভাবে যেন জেনে গিয়েছিল মা..মার খেয়েছিলাম খুব… দিদিমা না থাকলে আরো মার হয়তো ভাগ্যে জুটতো সেদিন…।
ঋতু বৈচিত্রের সাথে সাথে বদলে যেত মাঠের ছবিও।
ভরা বর্ষায় কাদাজলে ফুটবল খেলা,ছপাৎ ছপাৎ করে উল্টে পড়া বারবার, কাদা ভেঙে ভেঙে আবার বলের পেছনে ধাওয়া, মাঠের আনন্দ মিশে যেত প্রকৃতিকে জয় করার আনন্দে যেন..জিতলে পরে তো কথাই নেই…।
ম্যানেজারের পুকুর উপচে পড়তো থৈ থৈ জলে। একপাশে চুপ করে বসে ছোটমামার মাছধরা দেখা..। হঠা্ৎ বঁড়শিতে টান পড়তেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতাম। দিনের শেষে মাছগুলোকে মেরে ফেলতে বড় মায়া লাগতো।
‘ সিঙি গুলোকে বরং চৌবাচ্চাতে ছেড়ে দে না মামা..ওরা খেলা করুক..।’
ছিপ গোটাতে গোটাতে মামার মুখে একগাল হাসি।
‘ ঠিক বলেছিস। জিওল মাছ। প্রাণে বাঁচুক। যদ্দিন চায়।’
‘ কাল আবার আসবি তো মামা?’
‘ কাল তো তোরা চলেই যাবি। দিদি বললো, সকালের ট্রেন ধরবে।’
মাঠের ওপর দিয়ে আসতে আসতে মনটা খারাপ হয়ে যেত। আবার সেই বাড়ি। সেই পড়াশোনা। সেই স্কুল। কোথায় মাঠ, কোথায় ম্যানেজারের পুকুর, কোথায় ভরা বর্ষার থৈ থৈ কাদা জল, বল খেলা…আনন্দ… লুটোপুটি সব হারিয়ে যাবে ইঁট, কাঠ, পাথরের জঙ্গলের আড়ালে…মাঠ আর তাকে ঘিরে থাকা এই প্রকৃতি যে বড় টানে আমায়…গ্রীষ্মের নিদাঘ মধ্যাহ্নে যখন মাঠের ঘাসগুলো রুক্ষ্ণ,শুষ্ক হয়ে ফুটিফাটা মাটি করুন তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, তখন যেরকম ভেতর ভেতর খুব কষ্ট অনুভব করি ঠিক তেমনি করেই যেন মনটা কেঁদে উঠতো, চলে যাবার কথা স্মরণ করে…। হঠাৎই পায়ের কাছে কি একটা ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠায় নীচে তাকিয়ে অবাক হয়ে যেতাম।
মাঠের একটা ধার ছিল নীচু। সে জায়গায় জল জমে একটা ছোট্ট ডোবার মতো দেখতে হয়ে গিয়েছে।
চেচিয়ে উঠতাম,’এ মামা দ্যাখ কত মৌরলা..! কোথা দিয়ে এলো বল তো?’
‘পুকুর, পাশের ড্রেন দিয়ে জলের স্রোতে চলে এসেছে মনে হয়..দাঁড়া,দাঁড়া ধরতে হবে..।’
‘ ঐ দ্যাখ মামা আরো কতো..!’
বিঘতখানেক দূরে মাঠ লাগোয়া রাস্তার পাশের হাইড্রেন। নালা উপচে স্রোতের মতো জল ঢুকছে মাঠে। আর তারই টানে কাদাজলে ভেসে আসছে একের পর এক কুচো মাছের দল।
মামা কিছু বলার আগেই উবু হয়ে বসে কাদাজলে কিলবিল করতে থাকা কুচো মাছগুলোকে কপাকপ ধরে সোজা মামার গামলা খানায় চালান করে দিতাম।
এই বুঝি ফসকে গেল ফাঁক গলে…’এই যাস না..পালাস না’.. দুহাতের মুঠো শক্ত করে ধরে একবার এদিক, একবার ওদিক.. মাছেরা খেলছে, আমিও খেলায় মেতেছি… আমার সাথে সাথে মামাও…। আগামীকাল আবার বাড়ির পথে…একটু আগে মনে জমে ওঠা হতাশা কুচো মাছ ধরার আনন্দে যেন নিমেষেই উধাও। কতটুকই বা বয়স তখন আমার। পচা,নোংরা জল মেখে মাছ ধরার কথা হয়তো আর কেউ জানতে পারেনি, মামাও কাউকে বলে নি। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার পর জ্বর কাশিটা অনেক দিন ভুগিয়েছিল।
শীতের মজাও কি কিছু কম জড়ানো ঐ মাঠকে ঘিরে। বাঁশের মাচায় ত্রিপল খাটিয়ে রংচঙয়ে ফেস্টুন আর পোস্টারে সাজানো বিরাট বড় প্যান্ডেল.. সাতদিন আগে থেকে মাইকে খ্যাপা দার পাড়ামাতানো গলা…’ এবার যুবক সংঘের উদ্যোগে চারদিন ব্যাপী যে বায়স্কোপ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে, আজ তার দ্বিতীয় দিন। আজকের আকর্ষণ “সোনার কেল্লা।”
সময় সন্ধ্যা ছয় ঘটিকা। যুবক সংঘের মাঠ। অতি সত্বর টিকিট সংগ্রহ করুন। মূল্য মাত্র পাঁচ টাকা। “সোনার কেল্লা… সোনার কেল্লা “.. আর মাত্র করেকটি ঘন্টা…। ‘
শীতের সন্ধ্যায় শামিয়ানার নীচে, শিশির ভেজা ঘাসে বিছানো শতরঞ্জিতে বসে, গায়ে সোয়াটার জড়িয়ে, তৈরি করা সিনেমার পর্দায় একভাবে চোখ রেখে সোনার কেল্লার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে জাতিস্বর মুকুলের স্মৃতিচারণায় ডুবে আছি, নাকি আসলে নিজেই ভেসে বেড়াচ্ছি শৈশবে.. অ্যডভেঞ্চারিস্টের মতো..তা আজ আর বলতে পারবো না। আমার একপাশে মা, দিদিমা,মাসীরা..আর একধারে আমার ঠিক গা ঘেঁষেই গায়ে র‍্যাপার জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসে ছোটো মামা..আমার শিশুবেলার সহযোগী… হাত ধরে মাঠে নিয়ে আসা,এ মাঠেই শীতের দুপুরে সাইকেল শেখানো, ম্যানেজারের পুকুরে কোমরে গামছা বেঁধে আমায় সাঁতার শেখানো, ওর সাথে সাথে থেকে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা…বয়সে বড় হলে কি হবে..বন্ধুত্ব যে বয়স মানে না..সেটা ছোটো মামার থেকেই শিখেছি।
‘ কীরে কেমন লাগছে?’
ছোটোমামার চোখ তখন বড় পর্দায়। কথাটা অবশ্য আমাকেই উদ্দেশ্য করে।
‘ ভালো ছোটোমামা। খুব ভালো। ‘
পৌষের কড়া শীতে সকলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে বড় পর্দায় চোখ ডুবিয়ে সেই আমার প্রথম ‘সোনার কেল্লা ‘ ছবি দেখা। শৈশবের সে আবেগ কোথায় এসে হারিয়ে যেত মাঠের আবেগের সাথে…সে অনুভূতি কত গভীর, তখন বুঝতাম না। আজ বুঝি।
‘ যাত্রাপালা,ও আবার কেউ দেখে নাকি..।’

খুব অল্প বয়স থেকে ছোটোমামার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে আসছি বলেই হয়তো অনেক প্রিয়, অপ্রিয় কথা মুখ ফসকে বলেও ফেলি ওর কাছে। যেটা অন্য মামাদের বলতে সাহস পাই না। কতকটা সেই কারণেই কথাটা চটজলদি বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে।

এবার সত্যিই বহুদিন পর ছোটো মামা এলো। এতদিনে হাতধরে চলার সে বয়স পেরিয়ে এসেছি আমি বহুকাল। আমার কৈশোর বয়স অনেক ভালো লাগা, মন্দ লাগার কথা এখন আমাকে দিয়ে বলিয়ে নেয়। যা শৈশবের অবুঝ মনের যুক্তিহীন ভাবনা নয়। যা একান্তই নিজস্ব যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। নিজস্ব জগতের চিন্তা দিয়ে গড়ে তোলা।
‘ আমার কথার উত্তরে ছোটো মামা বললো,’ দেখলে দেখতে পারিস। পাঁচদিনে হট কেকের মতো টিকিট বিক্রি হয়েছে। যেই সেই নয়, কলকাতার রঙ্গমঞ্চের যাত্রা পার্টি। পত্র পত্রিকায় কত বিগ্গাপন বেরোয়। “বিল্লমঙ্গল অপেরা।” আনতে কতো হ্যাপা হয়েছে…নেহাৎ ক্লাবের তারু দার যাত্রামহলে কিছু যোগাযোগ আছে, সেই সুপারিশে…। আসবি দেখে তোদের জন্য লাস্ট দিনের শো এর খান তিনেক টিকিট রেখে দিয়েছি।’
‘ কী নাম রে বিলু যাত্রা পালার?’
বাবা জিজ্ঞেস করলেন ছোটো মামাকে।
‘ সম্রাট শাহজাহান। অসীমের ভালোই লাগবে। আপনাদেরও ভালো লাগবে। মূল চরিত্র যে করবে, কয়েকটা রজনী দেখার পর লোকটার অভিনয়ের ফ্যান হয়ে গিয়েছি আমি। আরো সেই কারণেই টিকিট গুলো জোগাড় করে রেখেছি।’
প্রিয় বিষয়গুলোর মধ্যে ইতিহাস আমার প্রথম পছন্দের। এতক্ষন কেন যে ছোট মামা নামটা বলেনি! পরক্ষনেই মনে হলো, যুবক সংঘের মাঠের এ শাহজাহানকে আবার কেমন দেখতে লাগবে কে জানে। এমন এক আকর্ষণীয় চরিত্র..যদি আমার মনের সাথে না মেলে? সম্রাট সবাই হতে পারে না। তবু দেখার ইচ্ছাটাকে নিবৃত্ত করতে পারলাম না।
বাবা উৎসাহভরে স্মৃতিচারণের সুরে বললেন,’ কলকাতার থিয়েটার হলে অহিন্দ্র চৌধুরী অভিনীত শাহজাহান…বুঝলি বিলু, দেখেছিলাম বটে একটা নাটক! চোখ বন্ধ করলে এখনো যেন ভেসে ওঠে। চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম যে বাড়ি ফেরার পথে কলকাতার একটা কিউরিও শপ থেকে আলো ঝলমলে শ্বেত পাথরের তাজমহল কিনে এনে ঘরের শোকেসে যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। রাত্তির হলে পাথরের গায়ে,নির্মাণ শিল্পের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে আলো পড়ে কি অদ্ভুত সুন্দর যে দেখতে লাগতো শোপিসটাকে! মনে হতো সত্যিই যেন আমি পিয়েত্রা দুরার কারুকার্য শোভিত, দেওয়াল গাত্রে কোরানের বাণী খোদিত প্রিয়তমার সে অণুপম স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি,প্রাণভরে অনুভব করছি রোমান্টিসিজমকে, সে ট্র্যাজিক জীবনের যন্ত্রণাকে…! একদিকে জীবন, একদিকে রঙ্গমঞ্চের অভিনয় আর একদিকে চরিত্রের সাথে একাত্মতা…এও এক ইনফ্যাচুয়েশান…এমনি এমনি বোধহয় তৈরি হয় না…। যাক গে, বলছিস যখন এত করে একবার দেখেই আসি…।’
মনের কোণে লুকিয়ে থাকা বহুকালের ভালোলাগার একটা চোরা স্রোত যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল বাবার চোখেমুখে।
বাবার সে মনের কথার ব্যাখ্যা বাবার মতো এত সুন্দর করে আর কেই বা দিতে পারবে। তাঁরই মতো আমার মনের ছবিটুকুও বাস্তবে কতটা মেলে, সেই কৌতুহল বশতই পরের দিনই হাঁটা দিলাম মামার বাড়ির পথে।
মাঠের সিংহভাগ জুড়ে বাঁশের ম্যারাপ করা বিরাট বড় প্যান্ডেলের সামনে রঙীন পর্দা টাঙানো পেল্লায় স্টেজ, যা এখনো পর্যন্ত দর্শকের সামনে উন্মুক্ত নয়।
ছোট মামা কানে কানে বললো,’ ভেতরে কাজ চলছে। সময়মতো ঠিক যবনিকা সরবে।’
বাইরে গেটে ঢোকবার মুখেই বিরাট এক ফেস্টুন রাস্তা থেকেই চোখে পড়েছে। ‘বিল্লমঙ্গল ‘ অপেরার কলাকুশলীদের রংচঙয়ে ছবিওলা পোস্টার।
ছোট মামা চিনিয়ে দিয়েছিল,
‘ঐ দ্যাখ, ঐ হলো আজকের পালার নায়ক। অভয়চরণ কাঞ্জীলাল। তারু দার সুবাদে আমার সঙ্গেও একপ্রস্ত আলাপ হয়ে গিয়েছে। কি গমগমে গলা! এর আগের দু দুটো রজনী মাত করে দিয়েছে। ‘
মঞ্চের একেবারে সামনে হত্যে দিয়ে বসে আছি আমি, বাবা, মা, মাসি..আমার ঠিক পাশেই গা ঘেঁষে বসে ছোট মামা, সেই আগেকার মতো একটা পরিবার যেন। মামা আজ ভারি ব্যস্ত। ক্লাব সদস্য বলে কথা! বসতে বসতে যেই না মাইকে ডাক পড়ছে অমনি ভ্যানিস। আমাদের সবার জন্য জায়গা বেছে দিয়ে মাঝখানে সেই যে চলে গেল এই এসে বসলো আবার। জিজ্ঞেস করলে গর্বের হাসি হেসে বলে,’আজ আর আমায় পাবি কীকরে? কত দায়িত্ব দেখেছিস! ব্যবস্থাপনা কেমন হয়েছে একবার বল? এই যে এই প্যান্ডেল, তারপর মঞ্চ… আমরা কজন মিলে দাঁড়িয়ে থেকে এসব করিয়েছি ডেকরেটারদের দিয়ে। ‘
বসে থাকতে থাকতে পেছন থেকে দু একজন ডাকলো আমায়, ‘ কিরে,অসীম কেমন আছিস? চিনতে পারছিস?’
‘ আরে তোরা কেমন আছিস? এখনো ফুটবল, ক্রিকেট খেলিস এ মাঠে? আর সেই বৃষ্টিতে ভিজে বলের পিছনে দৌড়ানো..?’
‘ ম্যানেজারের পুকুরে গ্রীষ্মের স্নান..সেটাও বল..।’
বিজন, আর সুজন দুজনেই ওরা আমার একসময়ের খেলার সাথী। কতদিন পরে ওদের দেখলাম। ওরাও আমায় দেখলো। প্রাণোচ্ছল শিশুবেলার স্মৃতি যেন ফিরে ফিরে আসছিল আমাদের কথাবার্তায়।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে চারিদিকে। ত্রিপলের আড়ালে দৃশ্যমাণ পূর্ণিমার চাঁদের আলো মাঠে এসে পড়েছে। জড়িয়ে রয়েছে তাল,নারকেল, সুপারি গাছের পাতায় পাতায়।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পুকুরটাকে। চিকচিক করছে জলছবির মতো। বাইরের হ্যালোজেনের আলো মাঠের এদিকটায় পড়ে নি বলে এপাশটা এত প্রশান্ত। এত স্মৃতিমেদূর। এত মায়াভরা।
ওপাশের পৃথিবী..সেও যে বহুকালের চেনা। বাঁশের খুঁটির আগায় হ্যালোজেনের আলোর মতো ভাস্বর, খ্যাপাদার মাইকের গলার আওয়াজের মতো নস্টালজিক…। হাতকয়েক দূরে ক্লাবঘর। যুবক সংঘ। নতুন রং করা হয়েছে। লোকজনের মেলা। চারিদিকে ভীড়। ব্যাস্ততা। কেউ ব্যাস্ত দর্শকাসনে নিজের জায়গা গোছাতে, কেউ বা ক্লাবের হয়ে মাতব্বরিতে। তারই মাঝে কিছুক্ষন আগে ক্লাবের সামনের বারান্দাটায় গিয়ে একটু বসেছিলাম। তখন আমি ছোট মামার হাতধরা। এমনি ভাবেই চুপটি করে বারান্দাটায় বসে খেলা দেখতাম। মনটা কেমন যেন করে উঠলো…ঠিক যেমনটা করে উঠলো সিংহভাগ জুড়ে ঘাসপালা উঠে যাওয়া, ফুটিফাটা মাঠটাকে দেখে। জিজ্ঞেস করাতে ছোট মামা বলেছিল,’ যাদের জমি, তারাই যদি যত্ন না নেয় কে কী করবে..ক্লাব থেকে তো কম বলা হয়নি। এখন শুনছি মাঠের ওদিকের অংশটায় কিসের একটা অফিস তৈরি হবে। মাটি কাটার কাজও শুরু হয়ে গেছে, ঐ দ্যাখ। লোকাল কিছু ছেলেপিলে রাতারাতি প্রোমোটারও বনে গেছে এর দৌলতে। ‘
দেখলাম শুধু তাকিয়ে। দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তে।
পর্দা সরে গেল হঠাৎই। আলো আঁধারীর মাঝে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর আবহ যেন চোখের সামনে উন্মুক্ত আমার। ব্যাকগ্রাউন্ড জুড়ে ভেসে আসছে এক প্রকান্ড প্রাসাদ গৃহ..অভ্যন্তরস্ত সভাঘর দেওয়ানি আম…সুসজ্জিত ঝলমলে সিংহাসন মাঝে গোলাপের বৃন্ত হাতে রাজবেশে যিনি বসে আছেন, ঐ শাহজাহান নাকি অভয়চরণ কাঞ্জীলাল, হারিয়ে ফেললাম একেবারে… আম জনতার দরবারে বিচার কার্য পরিচালনায় রত বাদশাহ স্বয়ং..রূপ-মাধুর্য না রাজোচিত কন্ঠের ব্যাপ্তি কোনটাকে আগে রাখবো ভেবে পাচ্ছি না, শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রয়েছি মঞ্চের দিকে, প্রায় চারশো বছর আগের এক শাসনব্যাবস্থার যুগে, যার পরতে পরতে শুধু আভিজাত্য, ঐশ্বর্যের অহংকার, যার ব্যাপ্তি শুধুমাত্র প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুলনীয়…কি অপূর্ব মঞ্চসজ্জা আর কি অসাধারণ অভিনয় করছে লোকটা! ইতিহাস যেন জীবনের এক একটা অধ্যায় হয়ে কথা বলছে ওঁর প্রতিটি অভিব্যক্তি আর কন্ঠস্বরে! কখনো সে হয়ে উঠেছে রাজোকীয় দম্ভ,শৌর্য বীর্যের প্রতীক আবার কখনো সে প্রিয়তমা পত্নীহারা হয়ে আগ্রা দূর্গে নিজের পুত্রের হাতে বন্দী চরম মানসিক যন্ত্রণাকাতর এক নামেমাত্র সম্রাট। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলোর ছায়া পড়েছে যমুনার জলে। স্মৃতিভারে আক্রান্ত সম্রাট চেয়ে চেয়ে দেখছেন তাঁর প্রিয়তমার মর্মর সৌধ ভুবনমোহিনী তাজমহলের প্রতিবিম্বিত রূপ। জ্যোৎস্না রাতের মৃদু শীতল হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে জীবনের সে ব্যার্থ হা-হুতাশ। করুণ ক্রন্দন আর অভিসম্পাতে মোথিত হয়ে উঠছে আগ্রা দূর্গের প্রাঙ্গনের প্রতিটি আনাচে কানাচে। যার জয়গানে একদা দিল্লীর দরবার মুখরিত হয়ে উঠতো,আজ সেই বার্ধক্যে উপনীত, নাম সর্বস্ব সম্রাটের পাশে কেউ নেই। ইতিহাসের কী করুণ ট্রাজেডি! অভিনয়,শুধু একজন লোকের অভিনয় একাই যেন চোখে জল এনে দিল..।
দিদিমার ঘরের জানলাটা খোলা ছিল। জানলার পাশেই শুয়েছিলাম আমি। শুয়ে শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদটার দিকে তাকিয়েছিলাম।
‘ কিরে ঘুমাবি না?’ দিদিমা বললেন।
অন্য সময় হলে হয়তো দিদিমাকে বলতাম,’চুলে বিলি কেটে দাও।’ আজ যেন ঘোরাফেরা করছে মন, অন্য এক জগতে… কল্পনায় ফিরে ফিরে আসছে যুবক সংঘের সেই মাঠ, সেই মঞ্চ, সেই অভয় চরণ কাঞ্জীলাল…। ছোট মামা বলেছে,’ ওঁর অভিনয় তোর এত ভালো লেগেছে… দাঁড়া, কালকে সকালে একবার এসে তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। আজ রাত্তিরটা ওরা ক্লাব ঘরেই থাকবে। খুব ভোরে ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়িস..।’
বাবা বলছিলেন,’ সত্যি রে বিলু,অভিনয়ে মাত করে দিল লোকটা! ‘
সেই আবেগেই কিনা জানি না, ঘুম আসছিল না চোখে কিছুতেই। কখন ভোর হবে..যদি তার আগেই অভয় চরণ কাঞ্জীলাল বেরিয়ে পড়েন, তাহলে তো আর পরিচয় করাই হবে না। কোনেদিনই হবে না।
ক্লাব ঘর থেকে ছোট মামা বেরিয়ে আসার সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ পাও নি ওনাকে?’
‘ না রে. ‘
বুকটা ধরাস করে উঠলো। যাঃ,সব আশা শেষ তাহলে!
‘ভেতরে তো নেই। চল ক্লাবের পেছন দিকটায় একবার গিয়ে দেখি..একজন বললো,”ওদিকে নাকি থাকতে পারে।”
তার মানে এখনো আছেন উনি। জাননি কোথাও। আশা জাগলো নতুন করে।
ক্লাবের পেছনটাতে বুনো ঝোপঝাড় মিলে বেশ কিছুটা জায়গা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
খানিকটা গিয়ে হঠাৎই কি মনে করে দাঁড়িয়ে পরলো ছোট মামা।
বেশ কিছুটা দূরে গাছপালা, লতাপাতার আড়ালে কার একটা মুন্ডু যেন নড়ছে ফিরছে।
‘ তুই এখানটাতে দাঁড়া। আমি আরএকটু সামনে গিয়ে দেখি। লোকটা হাগতে বসেছে কিনা কে জানে।’
‘ কে.. কে হাগতে বসেছে? ‘
‘ কে আবার অভয় চরণ কাঞ্জীলাল। একটু বুঝতে দে ব্যাপারটা।’
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি। ভেতরটা যেন পানসে হতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা ঠিক কী,আমিও বুঝতে পারছি না।
খানিকটা এগিয়ে, এদিক ওদিক কি একটু তাকিয়ে ছোট মামা আমাকে ঈশারা করলো,’এদিকে আয়। ঐ, ঐ দ্যাখ…।’
দেখি কিছু দূরে ঝোপের আড়ালে খালি গায়ে, হাঁটু অবধি লুঙ্গি গুটিয়ে, কাঁচা-পাকা তেলকাষ্ঠা চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা,গাল তোবড়ানো,খয়াটে চেহারার কে একটা লোক বসে আচ্ছা করে দুহাতে খইনি ডলছে আর প্রকৃতি অবলোকন করছে। রকম সকম দেখে মনে হচ্ছে হয়তো একটু পরেই প্রাতকৃতটাও সেরে নেবে এই বন বাদারেই কোথাও একটা।
ভিরমি খাওয়ার জোগাড় আমার। দাঁড়িয়ে রয়েছি একপাশে স্থানুর মতো। এ কে? কে এই লোকটা? ছদ্মবেশের আড়ালে মানুষ এইভাবে হারিয়ে যায়..!
আর এক পাও এগোতে ইচ্ছে হলো না, পরিচয় তো দূরের কথা।
কাক ডাকা ভোরে আমার চোখের সামনে থেকে অন্য একটা যবনিকা কে যেন নিমেষেই টেনে সরিয়ে ফেলে দিল।
সেদিনই দুপুরবেলা মামারবাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় যুবক সংঘের মাঠে গতকালের অনুষ্ঠানের চিহ্ন স্বরূপ শুধু কয়েকখানা বাঁশের খুঁটি পোঁতা ত্রিপল বিহীন ন্যাড়া প্যান্ডেলটার দিকে তাকিয়ে মনটা বড্ড খারাপ হয়ে উঠলো। জানি না কেন। ছেঁড়াখোরা কিছু পোস্টার পড়ে আছে মাঠের এদিক সেদিক। এতদিনের হুল্লোর,মাতামাতি সব নিমেষেই কেমন…! ক্লাব ঘরটা বন্ধ। কেউ কোথাও নেই। যাত্রা পার্টি চলে গেছে কোন্ সকাল বেলায়। হয়তো আর এক জায়গায় পালা জমাবে। রংচংয়ে নতুন পালা। কিছু দূরে খাঁ খাঁ মাঠে একা একা দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে খ্যাপা দা। হাতের লাটাই থেকে চড়চড় করে সুতো ছাড়ছে। আর ঘুড়ি ততই ছুটে চলেছে… ম্যানেজারের পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে টিপের মতো দেখা যাচ্ছে ঘুড়িটাকে…খ্যাপাদার চোখে মুখে কি যেন এক অজানা রোমাঞ্চ….! কতদিন…কতদিন পর আবার দেখলাম খ্যাপাদাকে এভাবে ঘুড়ি ওড়াতে!
ছেড়ে চলে যাচ্ছে আমার ছোটোবেলা…একটু একটু করে…গাছ গাছালীর আড়ালে, বাড়ি ঘর চিলেকোঠার আড়ালে…রাস্তার পাশে লাইটপোস্টে বাঁধা ফেস্টুনে রঙচঙে মুখে এখনো তাকিয়ে রয়েছে অভয় চরণ কাঞ্জীলাল….যেন আমারই দিকে চেয়ে..!
যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকান বাবা।
‘ কি রে থেমে যাচ্ছিস…চল, ট্রেন পাবো না যে। ‘
‘ হ্যঁ এই যাচ্ছি। ‘
মুখ ফিরিয়ে নিলাম আরো একবার। না, যাত্রাপালার দিক থেকে নয়। ফেস্টুনের ঐ লোকটার দিক থেকে..।
জীবনের দৃশ্যপটে ভেসে চলে যায় কত কি..।
আমার সে স্বপ্নের শাহজাহান নাহয় বুকের ভেতরেই রাখা থাক…মাঠের অবশিষ্ট ঘাসগুলোর আগায় জড়িয়ে থাকা শিশির বিন্দু হয়ে। তাকে বাইরের পৃথিবীতে টেনে এনে কদর্য করতে চাই না কোনোমতে।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।