হৈচৈ ছোটগল্পে শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

যবনিকা
ফেব্রুয়ারী মাস সবে শেষ হয়েছে। বসন্তের হাওয়ায় শীত যে তখনো বিদায় নেয় নি, মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেয়। যুবক সংঘের মাঠের সিংহভাগ জুড়ে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। লাল,নীল,হলুদ কাপড়ে মুড়ে দেওয়া দেওয়া হয়েছে প্যান্ডেল চত্বর। বাঁশের খুঁটির চারধারে টাঙানো মাইকের চোঙার ভেতর থেকে ক্লাব সদস্য খ্যাপা দার গলা…’সত্বর.. সত্বর টিকিট কাটুন.. যোগাযোগ করুন ক্লাব প্রাঙ্গণে..আজই শেষ রজনী..বিল্লমঙ্গল অপেরার সেই বহু প্রতিক্ষিত ” সম্রাট শাহজাহান “… আর মাত্র হাতে গোণা টিকিট.. এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না…।’
খ্যাপা দার এই গলা নতুন নয়। ছোটো থেকে মামাবাড়ি আমার আনন্দের সঙ্গে যতটা জড়িয়ে রয়েছে, ততটাই যেন জড়িয়ে আছে অনতিদূরে এই যুবক সংঘের মাঠ।সেই কোন্ ছেলেবেলায় ছোট মামার হাত ধরে ক্লাবে এসে বারান্দায় চুপটি করে বসে থাকতাম। খেলা দেখতাম মামাদের। খ্যাপা দা রিপ্লে করে চলতো সেই তখন থেকেই। ল্যাংপ্যাংয়ে চেহারার খ্যাপার তখন অল্প বয়স। কুকুরের মতো পেট। খয়াটে, তাল তোবরানো গালে হালকা দাড়ি। হাসলে পরে দাঁত কপাটি বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু কি তীক্ষ্ণ গলা! অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য বোধহয় লুকিয়ে রয়েছে ঐ ক্যানক্যানে কন্ঠস্বরে।
এবার অনেক দিন পর মামাবাড়ি আসা হলো। ছোটোবেলার মতো সেই ঘনঘন..পারলে মা কে ছাড়াই মামার হাত ধরে চলে আসাটা এখন আর হয় না, স্কুল পড়াশোনা নানান কারণেই। সর্বোপরি সে বয়সও আর নেই। তারওপর ফাইনাল পরীক্ষা বলে কথা..তায় মাধ্যমিক। আষ্টেপৃষ্টে শেকল বাঁধা রুটিনের হাত থেকে যেদিন রেহাই পেলাম, পরের দিন ছোটো মামা এসে হাজির।
কথায় কথায় উঠে এলো যুবক সংঘের মাঠের যাত্রাপালার প্রসঙ্গ।
‘ যাত্রা.. ও আবার কেউ দ্যাখে নাকি…তার চেয়ে ফুটবল টুর্নামেন্টের ব্যাবস্থা করতে পারলি না ছোটোমামা?’
শৈশবের মামাবাড়ি… আমি একটু মাথায় বাড়লে ছটফটে মন আর বেশি ক্ষন টিকতো না একই ঘরে, একই চৌহদ্দির মধ্যে। ততদিনে মামাদের ছাড়াই আমি চলতে শিখেছি বাইরে, যুবক সংঘের মাঠে। যে মাঠে খেলা দেখতে দেখতে হাততালি দিয়ে উঠতাম বারবার ছোটো মামার ডজ আর ড্রিবলিং দেখে..সেই মাঠখানা একদিন নিজেই হয়ে গেল আমার খেলার আঙিনা।বয়সের সাথী।
কেন জানি না, আজও আমার মন জুড়ে রয়ে গেছে অনেক দিনের অদেখা সুবিস্তৃত, প্রকান্ড মাঠখানা। শুধু কি ফুটবল, ক্রিকেট খেলা.. ভর দুপুরে মা, দিদিমা,মাসিদের চোখে ধূলো দিয়ে বড় মামার সাইকেল টা চুপিচুপি নিয়ে কতদিন ঘুরে বেরিয়েছি মাঠময়।খ্যাপা দা, পঞ্চা দা মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় ঘুড়ি ওড়াতো.. লাটাই খানা ধরে থাকতাম… মাঠের ওপাশে তাল,নারকেল গাছের সারিগুলোকে ছাড়িয়ে বহুদূর উড়ে বেড়াতো সেই ঘুড়ি.. একসময় মেঘের কাছাকাছি উড়ে যাওয়া শঙ্খচিলের মতো যেন একটা টিপ হয়ে আমাদের দিকেই তাকিয়ে হাসতো ঘুড়িটা…। একপাশে ব্রতচারীতে মত্ত কচিকাঁচার দল, দুপুরে মাঠে রোদ পোয়াতে আসা মেয়ে বৌদের হাসা হাসি, গল্পগাছা… খেলাধূলা..যেমন খুশি দৌড়ে বেড়ানোর আনন্দ…উড়ে চলা ঘুড়ির পানে নির্নিমেষ চোখ… মাঠ পেরিয়ে তাল, সুপারি,নারকেল গাছের সারিগুলোকে পেছনে ফেলে বেশ খানিক দূরে ম্যানেজারের পুকুর..ঐ ওধারে বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে ঠিকরে পড়া সূর্য রশ্নি কখন যেন একটু একটু করে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিত..ছায়া দীর্ঘায়িত হতো পুকুরের জলে, গাছ গাছালীর ফাঁকে ফাঁকে,মাঠের অনেকখানি অংশ জুড়ে… তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতাম সাইকেলটা নিয়ে। ঘুড়ি ওড়ানোর কথাটা কিভাবে যেন জেনে গিয়েছিল মা..মার খেয়েছিলাম খুব… দিদিমা না থাকলে আরো মার হয়তো ভাগ্যে জুটতো সেদিন…।
ঋতু বৈচিত্রের সাথে সাথে বদলে যেত মাঠের ছবিও।
ভরা বর্ষায় কাদাজলে ফুটবল খেলা,ছপাৎ ছপাৎ করে উল্টে পড়া বারবার, কাদা ভেঙে ভেঙে আবার বলের পেছনে ধাওয়া, মাঠের আনন্দ মিশে যেত প্রকৃতিকে জয় করার আনন্দে যেন..জিতলে পরে তো কথাই নেই…।
ম্যানেজারের পুকুর উপচে পড়তো থৈ থৈ জলে। একপাশে চুপ করে বসে ছোটমামার মাছধরা দেখা..। হঠা্ৎ বঁড়শিতে টান পড়তেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতাম। দিনের শেষে মাছগুলোকে মেরে ফেলতে বড় মায়া লাগতো।
‘ সিঙি গুলোকে বরং চৌবাচ্চাতে ছেড়ে দে না মামা..ওরা খেলা করুক..।’
ছিপ গোটাতে গোটাতে মামার মুখে একগাল হাসি।
‘ ঠিক বলেছিস। জিওল মাছ। প্রাণে বাঁচুক। যদ্দিন চায়।’
‘ কাল আবার আসবি তো মামা?’
‘ কাল তো তোরা চলেই যাবি। দিদি বললো, সকালের ট্রেন ধরবে।’
মাঠের ওপর দিয়ে আসতে আসতে মনটা খারাপ হয়ে যেত। আবার সেই বাড়ি। সেই পড়াশোনা। সেই স্কুল। কোথায় মাঠ, কোথায় ম্যানেজারের পুকুর, কোথায় ভরা বর্ষার থৈ থৈ কাদা জল, বল খেলা…আনন্দ… লুটোপুটি সব হারিয়ে যাবে ইঁট, কাঠ, পাথরের জঙ্গলের আড়ালে…মাঠ আর তাকে ঘিরে থাকা এই প্রকৃতি যে বড় টানে আমায়…গ্রীষ্মের নিদাঘ মধ্যাহ্নে যখন মাঠের ঘাসগুলো রুক্ষ্ণ,শুষ্ক হয়ে ফুটিফাটা মাটি করুন তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, তখন যেরকম ভেতর ভেতর খুব কষ্ট অনুভব করি ঠিক তেমনি করেই যেন মনটা কেঁদে উঠতো, চলে যাবার কথা স্মরণ করে…। হঠাৎই পায়ের কাছে কি একটা ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠায় নীচে তাকিয়ে অবাক হয়ে যেতাম।
মাঠের একটা ধার ছিল নীচু। সে জায়গায় জল জমে একটা ছোট্ট ডোবার মতো দেখতে হয়ে গিয়েছে।
চেচিয়ে উঠতাম,’এ মামা দ্যাখ কত মৌরলা..! কোথা দিয়ে এলো বল তো?’
‘পুকুর, পাশের ড্রেন দিয়ে জলের স্রোতে চলে এসেছে মনে হয়..দাঁড়া,দাঁড়া ধরতে হবে..।’
‘ ঐ দ্যাখ মামা আরো কতো..!’
বিঘতখানেক দূরে মাঠ লাগোয়া রাস্তার পাশের হাইড্রেন। নালা উপচে স্রোতের মতো জল ঢুকছে মাঠে। আর তারই টানে কাদাজলে ভেসে আসছে একের পর এক কুচো মাছের দল।
মামা কিছু বলার আগেই উবু হয়ে বসে কাদাজলে কিলবিল করতে থাকা কুচো মাছগুলোকে কপাকপ ধরে সোজা মামার গামলা খানায় চালান করে দিতাম।
এই বুঝি ফসকে গেল ফাঁক গলে…’এই যাস না..পালাস না’.. দুহাতের মুঠো শক্ত করে ধরে একবার এদিক, একবার ওদিক.. মাছেরা খেলছে, আমিও খেলায় মেতেছি… আমার সাথে সাথে মামাও…। আগামীকাল আবার বাড়ির পথে…একটু আগে মনে জমে ওঠা হতাশা কুচো মাছ ধরার আনন্দে যেন নিমেষেই উধাও। কতটুকই বা বয়স তখন আমার। পচা,নোংরা জল মেখে মাছ ধরার কথা হয়তো আর কেউ জানতে পারেনি, মামাও কাউকে বলে নি। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার পর জ্বর কাশিটা অনেক দিন ভুগিয়েছিল।
শীতের মজাও কি কিছু কম জড়ানো ঐ মাঠকে ঘিরে। বাঁশের মাচায় ত্রিপল খাটিয়ে রংচঙয়ে ফেস্টুন আর পোস্টারে সাজানো বিরাট বড় প্যান্ডেল.. সাতদিন আগে থেকে মাইকে খ্যাপা দার পাড়ামাতানো গলা…’ এবার যুবক সংঘের উদ্যোগে চারদিন ব্যাপী যে বায়স্কোপ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে, আজ তার দ্বিতীয় দিন। আজকের আকর্ষণ “সোনার কেল্লা।”
সময় সন্ধ্যা ছয় ঘটিকা। যুবক সংঘের মাঠ। অতি সত্বর টিকিট সংগ্রহ করুন। মূল্য মাত্র পাঁচ টাকা। “সোনার কেল্লা… সোনার কেল্লা “.. আর মাত্র করেকটি ঘন্টা…। ‘
শীতের সন্ধ্যায় শামিয়ানার নীচে, শিশির ভেজা ঘাসে বিছানো শতরঞ্জিতে বসে, গায়ে সোয়াটার জড়িয়ে, তৈরি করা সিনেমার পর্দায় একভাবে চোখ রেখে সোনার কেল্লার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে জাতিস্বর মুকুলের স্মৃতিচারণায় ডুবে আছি, নাকি আসলে নিজেই ভেসে বেড়াচ্ছি শৈশবে.. অ্যডভেঞ্চারিস্টের মতো..তা আজ আর বলতে পারবো না। আমার একপাশে মা, দিদিমা,মাসীরা..আর একধারে আমার ঠিক গা ঘেঁষেই গায়ে র্যাপার জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসে ছোটো মামা..আমার শিশুবেলার সহযোগী… হাত ধরে মাঠে নিয়ে আসা,এ মাঠেই শীতের দুপুরে সাইকেল শেখানো, ম্যানেজারের পুকুরে কোমরে গামছা বেঁধে আমায় সাঁতার শেখানো, ওর সাথে সাথে থেকে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা…বয়সে বড় হলে কি হবে..বন্ধুত্ব যে বয়স মানে না..সেটা ছোটো মামার থেকেই শিখেছি।
‘ কীরে কেমন লাগছে?’
ছোটোমামার চোখ তখন বড় পর্দায়। কথাটা অবশ্য আমাকেই উদ্দেশ্য করে।
‘ ভালো ছোটোমামা। খুব ভালো। ‘
পৌষের কড়া শীতে সকলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে বড় পর্দায় চোখ ডুবিয়ে সেই আমার প্রথম ‘সোনার কেল্লা ‘ ছবি দেখা। শৈশবের সে আবেগ কোথায় এসে হারিয়ে যেত মাঠের আবেগের সাথে…সে অনুভূতি কত গভীর, তখন বুঝতাম না। আজ বুঝি।
‘ যাত্রাপালা,ও আবার কেউ দেখে নাকি..।’
খুব অল্প বয়স থেকে ছোটোমামার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে আসছি বলেই হয়তো অনেক প্রিয়, অপ্রিয় কথা মুখ ফসকে বলেও ফেলি ওর কাছে। যেটা অন্য মামাদের বলতে সাহস পাই না। কতকটা সেই কারণেই কথাটা চটজলদি বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে।