দোবাঁকির নদীবাঁকে দুদিক থেকে দুটো তরী একেবারে কাছাকাছি এসে উপস্থিত হল। সেই সময়েই চোখাচোখি হল ইয়াকুব আর ইয়াসমিনার। অনেক বছর পর।
দুদিক থেকে দুটি জলধারা এক হয়েছে এখানে। নদী এখন কুল ছাপিয়ে উঠেছে। অবিরাম বৃষ্টির পর হেঁতাল আর সুন্দরী গাছগুলো কোনো রকমে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো গাছ তার ডালের পাতাগুলো জলে ডুবিয়ে জলের স্রোতে বুলিয়ে বুলিয়ে কিশোরী মেয়ের মত খেলছে। এমতাবস্থায় তাদের দেখা হল আবার।
ঘূর্ণিঝড়ে লোকগুলোর বাড়ি ঘর ভেঙে পড়েছে। লবণাক্ত জলে ওদের গ্রাম ডুবে গেছে। লোকগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তরিত করার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে।
ইয়াসমিনা ছোটবেলায় থাকত ইয়াকুবদের গ্রামেই। একসাথে স্কুলে যেত ওরা। ছিল একসাথে মাঠে খেলা বিকেলে আর গ্রামের পথে দৌড়। শুধু তাই নয়, ছিল আরও কিছু।
ইয়াসমিনার স্কুল পাশ করার পর ইয়াসমিনার পরিবার এই গ্রাম থেকে চলে গিয়েছিল। ওর বাবা এ গ্রামের বাস উঠিয়ে অন্যত্র চলে যায় জীবিকার জন্য। তারপর থেকে আর ওদের দুজনের দেখা হয় নি। বিদ্যাধরী নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে; ইয়াকুবের বৌ মরে গেছে দুই বছর হতে চলল। তার ছেলে ছোট। ইয়াসমিনার বর তাকে ছেড়ে চলে গেছে- তাও প্রায় বছর তিনেক। ইয়াসমিনা একাই থাকে এখন, ইয়াকুবের তবু মা আছে এখনও। ইয়াসমিনা ইয়াকুবদের নৌকার দিকে তাকাল। পাশেই ইয়াকুবের মা বসে আছে নাতিকে কোলে নিয়ে। বুড়িকে চিনতে পারল ইয়াসমিনা।
ঠিক এমনিভাবে দুই দিন আগে পাখিরালয় দ্বীপের কুঞ্জবনে দেখা হয়েছিল কোকিলের সাথে কোকিলার। অনেক কাল পরে। কোনো এক বসন্তের সাথী ছিল তারা। অনেক বসন্ত পার করে ঘূর্ণিঝড়ের দামাল ঝাপটে কিভাবে তারা আবার দৈবাৎ একেবারে কাছাকাছি এসে পড়েছিল। কোনোমতে পরস্পরকে সম্বল করে তারা সেদিনের মত রক্ষা পেয়েছিল বিরূপা প্রকৃতির রোষ থেকে।
ত্রাণ শিবিরে পৌঁছে গেল লোকগুলো। এলোমেলো জীবনের মধ্যে যথাসম্ভব প্রাণটা ধারণ করে রাখা। তার মধ্যেই অনেক কথা হল ইয়াকুবের সঙ্গে ইয়াসমিনার। তিনদিন ওরা ছিল ওখানে। একটা পুরনো স্কুলবাড়িতে। শুকনো চিঁড়ে আর মুড়ি প্রথমদিন। তারপর দিন থেকে ডাল আর ভাত জুটেছিল সবার। ইয়াকুবের ছেলের ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছিল নদীযাত্রায় হাওয়া লেগে।
তিনদিন পর ফেরার পালা। ইয়াসমিনা ইয়াকুবের সঙ্গেই উঠল নৌকায়। ইয়াসমিনার গ্রাম এখনও ফিরে যাবার মত অবস্থায় পৌঁছয় নি। যেসব এলাকা অপেক্ষাকৃত কম জলমগ্ন সেখানে লোকেদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ছেড়ে দিল নৌকাগুলো। লোকগুলো যেন স্বস্তি পেয়েছে খানিকটা। বলাবলি করছে ‘ ফিরে কি দেখব খোদাই জানে।’
ওদের সঙ্গে ইয়াকুবদের গ্রামেই এল ইয়াসমিনা। নিজের জন্মস্থানে। পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে গেল। সারাদিন খাওয়া হয়নি কিছু; বাচ্চাটা ইয়াকুবের কোলে ক্ষিদেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুড়িও কেমন যেন টেনে টেনে চলছে। আশেপাশের লোকেদের সঙ্গে ওরা চলতে চলতে পৌঁছল নিজেদের গ্রামে।
উঠোনে জিনিসপত্র ছড়ানো। চৌকি ভেঙে উল্টে পড়ে আছে। উনুনের ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে উঠোনে একটা। ঘর-দেওয়াল ভেঙে পড়েছে ইয়াকুবের।
বুড়ি আর বাচ্চাকে একজায়গায় বসিয়ে উনুনের পাশটা পরিষ্কার করতে লাগে ইয়াসমিনা। ইয়াকুব ঘর সারাই এর কাজে লেগে পড়ে।
ত্রাণ শিবির থেকে প্যাকেট ভরা চাল আর ডাল পাওয়া গিয়েছিল। খানিকটা কাঠ জড় করে ইয়াসমিনা রান্না চড়ায়। ইয়াকুব চালের ওপরে উঠে পড়ে চালটা খাড়া করার চেষ্টা করতে থাকে।
বুড়ি বাচ্চাকে বসিয়ে রেখে এগিয়ে আসে উনুনের দিকে। বাঁশটা এগিয়ে দেয় ওপরে ইয়াকুবের দিকে ইয়াসমিনা; দড়িটা ছুঁড়ে দেয় ওপরে। বাঁধতে হবে ঘর।
নিরাশ্রয় ঘর ভাঙা মানুষগুলো অসহায়ের মত ছোটাছুটি করছে আর ঘর গড়ে তোলার চেষ্টা আবার করছে আপ্রাণ। কোকিল আর কোকিলা চেয়ে দেখছে তাদের জীবন সংগ্রাম। কয়েকদিন আগে বিপর্যস্ত লোকগুলোকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। কোকিলের সাথে কোকিলা সেদিনও গাছের শাখায় বসে বসে দেখছিল সবকিছু। কোকিলের সাথে অমন হঠাৎ মিলিত হয়ে সেও নিরাপদ বোধ করছিল কিনা কি জানি।
কাছে সরে এল কোকিলা কোকিলের। ‘ একটা বাসা বেঁধে দেবে?’ অস্ফুট ব্যাকুল জিজ্ঞাসা।
কোকিল নিরুত্তর।