• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ২৬)

দার্শনিক হেলাল ভাই

আচ্ছা, বাক্সের ভেতর যে বড় একটা প্যাকেট পেলাম, এটার ভেতর কী আছে?
স্বামী বললঃ ওখানে দুই লাখ টাকা আছে। যখনই এক হালি ডিম হয়েছে, তখনই আমি তা বিক্রি করে দিয়েছি।
কৌতুক এক ৪।
রাশিয়ার যুবক: আমরা প্রথম মহাশূন্যে গিয়েছি।
আমেরিকার যুবক : আমরা প্রথম চাঁদে গিয়েছি।
বাংলাদেশের যুবক : আর আমরা প্রথম সূর্যে যাবো।
রাশিয়া আর আমেরিকার যুবক : সূর্য ভীর্ষণ উত্তপ্ত। সেখানে তোমরা যেতে পারবে না।
বাংলাদেশের যুবক : তোরা দুইটাই মারাত্মক বোকা। আমরা দিনে যাবো নাকি? রাতে যাবো।
এলাকারার মুরুব্বীদের পক্ষ থেকে কাউকে কিছু বলতে হবে। কে বলবেন, কে বলবেন করে আমার বাবাকে মঞ্চে তুলে দেয়া হল। এর কারণ আমি ছবি এঁকে পুরস্কার পেয়েছি। অন্যান্য মুরুব্বিরা বলতে লাগলেন, যে দু’জনের সৌজন্যে এই অনুষ্ঠান আপনার ছেলে তাদের একজন। যান, আপনারই কিছু বলা উচিত।
মফিজের বাবা কোনো কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি থাকলে হয়তো আমার বাবাকে মঞ্চে উঠতে হতো না।
আমার বাবা চুপচাপ ধরনের মানুষ। জনসম্মুখে কথা বলেন না কখনো। আদর্শ শ্রোতা হয়ে থাকেন। বাবা যে কী বলবেন আমি বুঝতে পারছিলাম না।
বাবা শুরু করলেন: আজ আমার মনে খুবই আনন্দ। আনন্দের ঢেউ একটার পর একটা এসে আছড়ে পড়ছে আমার হৃদয়ের কিনারে। এতটা আনন্দিত শেষবার আমি কবে হয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। মনে হচ্ছে, আমি আমার শৈশব, কৈশর, আর যৌবনের দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছি। এই যে আমার সামনে বসে আছে শিশু-কিশোর-কিশোরীরা। এদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, এরা আমার কৈশরের শিশু-কিশোর। হ্যাঁ, বর্তমানে এরকম শিশু-কিশোর দেখাই যায় না যেন। আমার শৈশব-কৈশরকে স্মরণে এনে দেবার জন্য আমি কৃতজ্ঞ যুবক হেলালের কাছে। আমাদের কৈশরে, যৌবনে আমরা পাড়ায় পাড়ায় নাটক করেছি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি, খেলাধুলার আয়োজন করেছি। তখন প্রায় প্রতিটা বাড়িতে হারমোনিয়াম, তবল ছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রায় সবাই কোনো না কোনো সৃজনশীল কাজে জড়িত থাকত। যাদের তেমন কোনো মেধা ছিল না তারাও জড়িয়ে থাকত অনেক কিছুতে। যেমন আমি। গান, আবৃত্তি, অভিনয়, ছবি আঁকা এর কোনোটাই আমি ভাল পারতাম না। কিন্তু পাড়ায় যখন কোনো নাটক মঞ্চস্থ হত, তখন আমিও গুরুত্বপূর্ণ একজন। আমার কাজ থাকতো মঞ্চের পেছনে বসে প্রতি দৃশ্যের শেষে বেল বাজানানো, দৃশ্য টানা, দৃশ্য উঠানো ইত্যাদি।
কি আনন্দ নিয়েই না সে কাজ করতাম! আমার বন্ধু পলল। ও থাকত নাটকের প্রমটার। মঞ্চের পাশে বসে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ডাইলগ পড়ত। ও না থাকলে নাটক মঞ্চস্থ সম্ভবই হত না। আমাদের সেইসব বন্ধুদের কেউ কেউ এখন জাতীয় পর্যায়ের অভিনেতা। এখানো আপনারা যারা উপস্থিত তারা বর্তমানে দেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী আঁখি মির্জার নাম জানেন, তার গানও শোনেন। তিনি থাকতেন আমাদের পাশের বাসায়। তার ঘরের জানালা আর আমার ঘরের জানালা প্রায় মুখোমুখি ছিল। প্রতি সকালে তিনি গলা সাধতেন। কি যে ভালো লাগত! আমি তাকে আঁখি আপা ডাকতাম। বৃষ্টি নামলেই তিনি একটা বিশেষ রাগে গলা সাধতেন। একদিন আমি বললাম-আঁখি আপা, বৃষ্টির সময় আপনি একটা বিশেষ রাগে গলা সাধেন। রাগটার নাম কী? তিনি বললেন-মেঘমালা। মেঘমালা! শব্দটা আমার এত ভালো লাগল! আমার ইচ্ছা ছিল, আমার কোনো মেয়ে হলে তার নাম রাখব মেঘমালা। কিন্তু আমার কোনো মেয়ে হল না। হলো একটা ছেলে। তবে এই যে সামনে যত মেয়ে বসে আছে, এরা সবাই আমার মেয়ে। এরা সবাই মেঘমালা রাগের মতো মুগ্ধকর। আমাদের সময়ও ছাত্র রাজনীতি ছিল। আমি নিজেও ছাত্র রাজনীতির সাথে কিছুটা জড়িত ছিলাম।
কিন্তু তখনকার ছাত্র রাজনীতি এখনকার মত ছিল না। তখন ছাত্রনেতারা মানুষের উপকারের জন্য কাজ করত। যেমন কাজ করতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য, তেমন কাজ করত নিজ এলাকার জন্য। কারও অসুখ-বিসুখে ঝাপিয়ে পড়ত। গরিবের দুঃখ মোচনের জন্য কাজ করত। মনে আছে, তখন আমাদের এলাকায় এক বস্তি ঘরে ছয় বছরের একটা শিশু অসুস্থ হল। শিশুটার বাবা নেই। মা মানুষের বাড়ি কাজ করে। সে কাজে যাবার সময় শিশুটাকে সাথে করে নিয়ে যেত। অসুস্থ হওয়ার কারণে মা তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারে না। আবার রেখেও যেতে পারে না। এদিকে কাজ না করলে মায়ের ও শিশুর খাবার জুটবে না। তখন এ এলাকায় আমাদের ছাত্র নেতাদের প্রধান ছিল মুহিবুর রহমান। আমরা ডাকতাম মুহিব ভাই। মুহিব ভাই শিশুটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। পরীক্ষা করে দেখা গেল, শিশুটা জটিল নিউমোনিয়া আর শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য বেশ টাকা লাগবে। আমরা সবাই কিছু কিছু করে টাকা দিলাম। তারপর মুহিব ভাইয়ের সাথে বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা সংগ্রহ করলাম।
শিশুটাকে হাসপাতালে ভর্তি করে আমরা সুস্থ করে তুললাম। এই যে মানব সেবার আনন্দ। এরকম আনন্দ বর্তমান ছাত্র নেতারা পায়ই না। তাদের নামে নানা অভিযোগ। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব আরও কত অভিযোগ! তারা মানব সেবা করবে কি, নিজেরাই দুই হাতে টাকা কামিয়ে কুল পায় না। ছাত্রনেতা, অথচ বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স কোনো কিছুর অভাব নেই তাদের। কোথা থেকে পায় এসব? বস্তুগতভাবে ভাবলে আমাদের দেশ অনেক উন্নত হয়েছে। উন্নত রাস্তাঘাট, ব্রীজ, ফ্লাইওভার, আছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যাবহার। কিন্তু এসব বস্তুগত উন্নয়নের সাথে সাথে মনোগত, আদর্শগত, সৃজনশীলতার উন্নয়ন ঘটেনি, বরং এসব ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যাপক অবনতি। পাড়ায় পাড়ায় সেইরকম নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নেই। নেই সাংস্কৃতিক চর্চা। ছোট ছোট ছেলেরাও আজ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মারামারি, খুনোখুনি করে। আজ উগ্রবাদের উত্থান আমাদেরকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। উগ্রবাদ আমাদের শান্তির পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। এর পেছনে দায়ি কী বা কারা? প্রথমত বলব, আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা। তারপর আছে সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, সাংস্কৃতির নামে অপসাংস্কৃতির গড্ডালিকায় ভেসে যাওয়া। যে ছেলেটা গান করে, সে কখনো উগ্রবাদী হতে পারে না। যে ছেলেটা ছবি আঁকে সে কখনো উগ্রবাদী হতে পারে না। যে ছেলেটা গল্প-কবিতা লেখে সে কখনো উগ্রবাদী হতে পারে না। যে ছেলেটা ভাল লেখাধুলা করে সে কখনো উগ্রবাদী হতে পারে না। যে ছেলেটা ভাল অভিনয় করে সে কখনো উগ্রবাদী হতে পারে না। যে ছেলেটা বিজ্ঞান গবেষণায় নিয়োজিত থাকে, সে কখনো উগ্রবাদী হতে পারে না। যে ছেলেটা বহুমুখি বই পড়ে, সে কখনো উগ্রবাদী হতে পারে না।
কিন্তু ছেলেপেলেকে এসব থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। এই যে যাদেরকে আমার সামনে দেখতে পাচ্ছি, এদের মধ্যেই আমি দেখছি জয়নুল, কামরুল, কাইয়ুম চৌধুরী, হাসেম খান, বশীর আহমেদ, মাহমুদুন্নবী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, রাজ্জাক, কবরী, ববিতা, কুদরাত-ই খুদা, আব্দুল্লাহ আল মুতী, জগদীশচন্দ্র বসু, জামাল নজরুল ইসলাম, সত্যজিত, বিভূতিভূষণ, হুমায়ুন আহমেদ, জীবনানন্দ, জহির রায়হান, সালাউদ্দিন, আলফাজ, সাব্বির, সাকিব আল হাসান, মুশফিক, ব্রজেন দাশ আরও অনেক অনেক কালজয়ী প্রতিভার মুখ। কিন্তু এদেরকে সুন্দর কর্মকান্ড থেকে সরিয়ে নিলে, এদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করলে, এদেরকে ভুল শিক্ষা দিলে আমরা তো সেইসব প্রতিভা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হব। উপরন্ত হব ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা চাই হেলালের মতো প্রেরণাদায়ী যুবক। আমরা যেটা পারিনি, সেটা হেলাল করে দেখিয়েছে। দেখিয়েছে যে, চেষ্টা করলেই ভাল কিছু বের হয়ে আসে। যাকগে, অনেক কথা বলে ফেললাম। আমি এভাবে কোনোদিন জনসম্মুখে কথা বলিনি। মানুষ দুঃখের সময় কথা বলতে পারে না। অতী দুঃখ-কষ্ট মানুষকে মূক করে ফেলে। কিন্তু আনন্দে মানুষের মুখ খুলে যায়। আজ মনে আমার আনন্দের ঢেউ। সেই ঢেউ কথার ঢেউ হয়ে প্রকাশ হল। সবার মঙ্গল কামনা করে শেষ করছি।
সবার মুখে হেলাল ভাইয়ের অকুন্ঠ প্রশংসা হেলাল ভাইকে ক্ষুব্দ করল।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।