• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ২৮)

আমার মেয়েবেলা

আমার প্রথম বিচ্ছেদ

আমি ভাইয়ের থেকে বছর দেড়েকের বড়ো ছিলাম।
মা আমাদের দুজনকে একা সামলাতে না পারার অজুহাতে আমাকে যখন রঘুনাথগঞ্জে আমার ঠাকুমার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল তখন আমার বয়স সারে তিন বা চার বছর। এটা আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ একটা ঘটনা হলেও আমার জীবনের মোড় পাল্টে দিয়েছিল বলা যেতে পারে। আমি মানসিক ভাবে এতটাই ধর্ষিত হয়েছিলাম যে মনের ভেতরটা যে কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল যা আমি আমি কোন দিন কাউকে বোঝাতে পারিনি ,,,বলা যায় বলতে চাই ও নি।
খুব অভিমান হয়েছিল আমার,,,আমি কেন? আমাকেই কেন আলাদা করা হল? কেন চলে যেতে হল আমার চেনা পরিবেশ ছেড়ে।
আমি কেন আমার বাবা,,,আমার মা আমার ভাই ,,,আমার পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারব না? আমি কি ওদের আপন জন নই? যাদের কাছে মানুষ হলাম এত আদর পেলাম,,,ভালবাসা পেলাম,,,,মাত্র সারে তিন/চার বছর বয়েসে আমাকে রেখে এল এমন একটা জায়গায়,,,যাদের কাছে,,যেখানে আমি তখনও তাদের সঙ্গে পরিচিতই হই নি। ঐ বয়সে কবারই বা গিয়েছিলাম রঘুনাথ গঞ্জে!
মানুষ হয়েছি ফরাক্কায় বাবা মা’র কাছে। ঠাকুমা দাদু কাকা জ্যেঠা জ্যেঠিমা পিসিদের সঙ্গে অত ভাবও হয় নি তখন। অত সেভাবে চিনতামই না। শুধু মাত্র ভাইকে দেখাশোনার জন্য মা আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই দুঃখ কোনদিন ভুলতে পারিনি। সমাজে ছেলে মেয়ের পার্থক্যটা যে রয়েই যায় সে আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝে ছিলাম।

বাবা খুব ভালোবাসত আমায়। রেখে আসার সময় বাজারপাড়ার( রঘুনাথগঞ্জে) একটা স্টুডিও তে গিয়ে আমার একটা ছবি তুলেছিল।কী জানি হয়তো ছেড়ে থাকার কষ্টে। সারা রাস্তা বোঝাতে বোঝাতে এসেছিল ওখানে সবাই খুব ভালো বাসবে। ভাল ভাবে থাকবি,,, দুষ্টুমি করবি না,,, খাওয়া নিয়ে একদম বায়না করবি না,,, রাজা ( অ্যালসিসিয়ান) আছে। রাজার সঙ্গে খেলা করবি। সেদিন থেকে আমার জীবনে শুরু হয়েছিল এডজাস্টমেন্ট।
আমি বলেছিলাম আমার তো ভাই আছে আমি রাজার সঙ্গে খেলব কেন? আমার রাজাকে ভয় করে।
রাজা তখন আমাকে অতটা চিনত না। দেখলেই চেঁচাত। তারপর যদি কেউ আমাকে কোলে নিল তাহলে তো কথাই নেই। পারলে আমার পা ছিঁড়ে নেবে। উফ্ কী যে ভয় করত আমার! তখন আমার সঙ্গে ভাব হয় নি তাই আমার ওকে একদম ভালোও লাগত না। বাপরে কী বিরাট বাঘের মতো দেখতে ছিল।
তো যাইহোক বাবা আমাকে একটা অচেনা ( আমার কাছে তখন তাইই ছিল) জায়গায় রেখে দিয়ে চলে গেল। সত্যি সত্যিই রেখে চলে গেল! যেটা আমার এখনও বিশ্বাস হয় না।
সেদিন একবার ও কেউ আমার কথা ভাবল না? ঐ টুকু মেয়ে আমি বাবা মা ছেড়ে কীভাবে থাকব! এমন কি বাবাও বুঝলো না?,,,এটা আমি কোন দিন মেনে নিতে পারিনি,,,সবাই যা করুক,,, কিন্তু বাবা !!
###

খুব কাঁদছিলাম বাবাকে জড়িয়ে ধরে,,, কিছু তেই বাবাকে ছাড়ছিলাম না। বাবার জামাটা প্রাণপণ চেপে ধরেছিলাম। বাবার লাল হয়ে যাওয়া নাক ,, গাল চুমু খেতে খেতে বলেছিলাম আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব। আমি আর দুষ্টুমি করব না। আমি তোমার সঙ্গে যাব। এখানে থাকব না।
সেই সময় আমার নিজেকে কেমন অনাথ মনে হয়েছিল। চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে অনাথ শব্দ টা হয়তো শোনে নি। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার যে নিজেকে কী অসহায় লেগেছিল,,, যা আমি কোনদিন ভুলতে পারি নি,,,,আজ ও চোখ বন্ধ করলে আমি সেই মোটাসোটা ধবধবে ফর্সা কোঁকড়া চুলের মেয়েটাকে দেখতে পাই,,,,
সেই মেয়েটা ,,,সেই ছটফটে দুষ্টু মেয়েটা,, যে সারাদিন ছুটোছুটি করত,, এক যায়গায় যাকে আটকে রাখা যেত না,,,কেটে গেলে যে জামা দিয়ে মুছে ধুলো দিয়ে রক্ত আটকাত,,, কিংবা থুতু দিয়ে আঙ্গুল চেপে ধরত রক্তাক্ত জায়গায়,,,সেই মেয়ে যে কাউকে ভয় পেত না,, কিছুই ভয় পেত না,,এমনকি ভুতের ও না।
সেই মেয়ে বার বার আধো গলায় ,, বুকে এক সমুদ্র অসহায়তা আটকে ভয়ে ভয়ে
বলে চলেছে,,,বলেই চলেছে,,,
‘ভাই এর জন্য আমাকে রেখে যাচ্ছ? আমি তো ভাই কে ভালো বাসি,,ভাই কে আর মারব না,,, বাবা আমি তোমাদের কাছে থাকব,,,,,
সেই মুহূর্তে কিভাবে যেন ‘তোমাদের’ কথাটা শিখে ফেললাম। আর ‘আমাদের’ থেকে বরাবরের মতো নিজেকে ছেঁটে ফেললাম।
আমার মণি কাকু(ছোট কাকু) আমি খুব কাঁদছি দেখে আমাদের বাগানে নিয়ে গেল। বাগানে গাছ ফুল পাখি কাঠবিড়ালি বেড়াল এসব দেখতে ব্যস্ত আমি টের ই পেলাম না ,,বাবা,,, আমার সব থেকে বড় আপনার,,,আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল,,,, আমি বুঝতে ই পারিনি সত্যিই আজ ও আমি বিশ্বাস করতে পারিনা যে বাবা আমাকে সত্যি সত্যিই ঠাকুমার বাড়ি রেখে চলে যেতে পারে। আমি খুব কেঁদেছিলাম,,, ওদের কাছে থাকার বায়না করেছিলাম ,,,ওদের আদর ওদের ভালো বাসা পেতে চেয়েছিলাম,,,, নতুন অতিথি আসলে যে কোন শিশুর মনই বিচলিত হয়। ভালোবাসা র ভাগিদার কে মেনে নিতে বড়ো মানুষের ই অসুবিধে হয় তো একটি শিশু র মনে কী হতে পারে! জন্মের পর এত আদর ভালোবাসা পাওয়ার পর হঠাৎ যদি সব হুস্ হয়ে যায় তখন কী অবস্থা হয় সে আমি জানি। আমার ঐ শিশু মন এমন ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল যে,, সেই ক্ষত আর কোনদিন সারে নি। রয়েই গিয়েছিল। যা আমার এবং আমার বাবা মার পক্ষে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। পরবর্তীতে আমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল এই অজুহাতে যে আমি ওদের(বাবা মা ভাই) পর ভাবতে শুরু করেছিলাম। আসলে এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার ই ছিল। কারণ আমি ভেবেই নিয়ে ছিলাম যে ওখানেই আমাকে থাকতে হবে। আমি বাবা মা ভাইয়ের সঙ্গে কোনদিনও থাকতে পারব না।তাই এরাই আমার আপনজন।
বছর দুয়েকের মধ্যে আমি বাবা মায়ের কাছে ফিরে গেলেও কী যেন একটা ফাঁক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ওখানে থাকতে ভাল লাগত না আমার। মায়ের সঙ্গে আমার একটা বিরাট দুরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা রয়েই গিয়েছিল,,,,
আসলে আমি সেদিনের ঘটনাটা কোন দিন ভুলতে ই পারি নি। চেষ্টা করে ছিলাম কিন্তু তবুও যে কেন ভুলতে পারি নি সেটা অবশ্য একজন মনোবিদ ই বলতে পারবে। খুব ভালো বাসতাম ওদের । এখন ও একটা দিন যায় না যে ওদের জন্য চোখের জল ফেলি না। কিন্তু তবুও যেন একটা খোঁছ থেকেই গিয়েছিল। আসলে ওখানে ওদের সঙ্গে(ঠাকুমার বাড়িতে) মানিয়ে সব ভুলে সবে যখন থাকার মতো আমার মনটা তৈরি হল ঠিক তখনই আমাকে উচ্ছেদ করে নিয়ে আসা হল অচেনা ফরাক্কায়। আবার আমাকে তৈরি করতে হল অচেনা জায়গায় অচেনা পরিবেশে এবং অবশ্যই এক আকাশ অভিমানী মন নিয়ে আমার এডজাস্টমেন্ট শুরু হল আমার বাবা মা ভাইয়ের সঙ্গে,,,
#####
বাবা চলে যাওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতে আমার জ্বর এসে গিয়েছিল,,,,আমি রাতারাতি অনেক টা বড়ো হয়ে গিয়েছিলাম,,, সেই দিন থেকে শুরু হয়েছিল সকলের সঙ্গে কীভাবে এডজাস্টমেন্ট করে চলতে হয়,,,,যা আজ ও চলছে,,,,
সেই দিন থেকে সমাজের আসল বাস্তব চেহেরাটা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানো হয়েছিল,,, কিভাবে যেন আমাদের থেকে তোমাদের শিখেছিলাম ,,,,বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছিল বাবা মার,,,সবার,,,, কেউ বাবা মাকে সেই মারাত্মক ভুল টা ধরিয়ে দেয় নি। আজ এত বছর পর বলতে বাধা নেই মানসিক ভাবে প্রথম বিচ্ছেদটা সেইদিন ই আমার সবার সঙ্গে ই হয়ে গিয়েছিল। সেই দিন থেকে আমি মারাত্মক একাকিত্বের স্বীকার হয়েছিলাম। একা চলতে হবে,,,একা বাঁচতে হবে,,,আমারটা আমাকেই করে নিতে হবে,,,আদায় করে নিতে হবে,,, কেউ আমার নয়,,,আমি কারো নয়,,,,
চোখের জল মুছে রাতে যা দিয়ে ছিল একটুও বায়না না করে খেয়ে, ঠাকুমা কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,,,,
সেই ছোট্ট মামনি পর হয়ে গেল,,,, এমন ভাবে যে আর কোনদিন বাবা মার সংসার টাকে আপন করতেই পারল না।

ক্রমশঃ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।