• Uncategorized
  • 0

গদ্যের পোডিয়ামে তনিমা হাজরা

রথ, বনফুলের মালা আর রাধারাণী

রথের দিন এলে আমার মোটেই জগন্নাথ, বলরাম বা সুভদ্রার কথা মনে পড়ে না,
আমার কেবলই রাধারাণীর কথা মনে হয়।।
ভক্তিযোগ, পুরীধাম আমাকে বিন্দুমাত্র টানে না,
আমি বঙ্কিমচন্দ্র খুলে বসি।।
কাটাকুটি চলে বুকের ভেতরে,
গোধূলির সিন্দুরে মেঘ ক্রমশঃ কালো হয়ে বৃষ্টিধারায় নেমে আসে পাতায় পাতায়,
যেখানে রথের মেলায় এক মেয়ে
বিক্রি না হওয়া বনফুলের মালা হাতে আপাদমস্তক ভিজতে থাকে কর্দমাক্ত রাস্তায়।।
মায়ের পথ্যির যোগাড় করতে রথের মেলায় মালার সওদা।
কিন্তু বর্ষার আক্ষুটে মেঘ কি চায় তার কাছে?
বিক্রি না হওয়া মালা নাকি সারাজীবনের মাল্যদানের বন্ধনযোগ।।

অন্ধকারে কে যেন গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ে,
সে কী তার ভবিতব্য??

যার মুখ দেখা যায় না, শুধু স্বর শোনা যায়, সে সব ব্যথার গল্প বার করে নেয় দয়ালু নিড়ানি দিয়ে অন্তর ঝেড়েপুঁছে।।
আঁধারে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয়,
আঁধারে যে সাথ দেয় সেতো সহজ মানুষ নয়, তাকে কি তুমি জানো,
তাকে কি তুমি সব দিয়ে দাও
নিশ্চিন্ত নির্ভরতায়?
জানো কি কেন সে তোমার বনফুলের মালা কেনে, কেন সে চারিপয়সার স্থানে হাতে দেয় রৌপ্য মুদ্রা? পরণের জন্য বস্ত্র পাঠায় বণিকের হাতে।।
সে দাতা।। সে কি নিছকই দাতা।। একটি টাকার নোট রেখে যায় দুয়ারে নীরবে,
টাকার উপরে লেখা থাকে তার নাম “রুক্মিণীকুমার রায়”।।
কেন দান নেবে তুমি রাধারাণী, কি অধিকার, রাধারাণী দরিদ্র বটে, কিন্তু সে লোভী নহে।
টাকাটি কুলুঙ্গিতে তোলা থাকে।
থাক।। আর তোলা থাকে অপেক্ষায় রাধারাণীর কুমারী হৃদয়।।
সময় নির্বাক।। তাই তার সাথে তোলা থাকে সংশয়, না দেখা মুখের সেই কানে বেঁধা মিঠেস্বর, আর না জানা বংশপরিচয়।।
এবং অতঃপর,
রাধারাণী, জানি তুমি যত বড় হবে,
প্রতিটি রথের রাতে তোমার ভেতর এক প্রবল ঝঞ্জাবার্তা তোমাকে নিয়ত নাড়াবে,
ধর্মের লোভ নয়,
অর্থের লোভ নয়,
এক তীব্র প্রেমের লোভ তোমাকে পাগলের মতো তাড়া করে খাবে।
ঊনবিংশ শতকের বাঙালি মেয়ে,
তোমার বাঁচতে গেলে পুরুষের অভিভাবকত্ব লাগে,
প্রেমকে বিবাহে রূপ দিতে লাগে
সমজাতপাত হিসেবনিকেশ।
গল্পে তা নিশ্চিত মিলে যায় সবকিছু অভীষ্টমাফিক।।
গল্পে যা মেলে লেখকের সামান্য কালির আঁচড়ে, বাস্তবে তা মেলে কি সহজে?
গল্পের রাধারাণী ধনী হয়ে ওঠে,
লেখক অঢেল রূপ অকৃপণ হাতে ঢেলে দেন তার গায়,
রুক্মিণীকুমার রায় দেখা যায়,
রাজার সে ছেলে,
অবশেষে দুজনায় দুজনাকে পেলে,
সে কি তবে চাহিদা মাফিক সব ঠিকঠাক আছে বলে?
নাহলে কি হতো?
এখানেই দ্বৈরথ,
বাস্তবে আর কল্পনায়।
নারীটির সুশীলা হওয়া চাই, গায় রূপ চাই, পুরুষটির ধনৈশ্বর্য্য চাই, রূপ চাই নায়কোচিত। দুজনের জাত পাত তাও সব কিছু ঠিকঠাক মেলা চাই।।
বাস্তবে, এই আষাঢ় বৃষ্টিবিহীন খরায়
রথের রশিতে টান পড়ে,
ভক্তরা ভক্তিতে হয় গদগদ, দোকানী হাঁক পাড়ে চুড়ি, মালা, বাঁশি, পুতুল, মিষ্টি খাজায়
আর পাঁপড় ভাজায়।।
দারুণ আমুদে এক সান্ধ্য কৌতুক,
নির্ঝঞ্ঝাট লোকারণ্য মেলাপ্রাঙ্গণ,
বনফুলের সব মালা দুইচারি পয়সায় অনায়াসে বিকিয়ে যায়, সেই দিয়ে জীবনের পথ্যির জোগাড়টুকু হয়।।
একবিংশের রাধারাণী,
রূপসী অথবা রূপহীন, অসুশীলা, স্বাবলম্বী মেয়ে,
তার গল্প ঐসব আষাঢ়িয়া ঘূর্ণাবর্তহীন।।
দায়িত্বশীল পদক্ষেপে অভ্যস্ত হাঁটায়,
যদিবা বৃষ্টি আসে তার আশেপাশে,
তার তাতে কিবা এসে যায়,
থাকুক না অন্ধকার, থাকুক পিচ্ছিল পথ, জলে ও কাদায়, তবু সে দুর্নিবার পদাতিক।।
তুমিই তো সার্থক সারথি তোমার রথে,
বনফুল ক্রেতা তুমি নিজস্ব রথের মেলায়,
তুমিই তোমার রৌপ্য মুদ্রা,
সিক্ত লজ্জাবস্ত্র মুক্তি,
কাগজের অভাবিত টাকা,
একার দায়িত্ব নেবার মজবুত তুলাদন্ড মাপ,
হৃদয়ে তবুও থেকে যায়,
রুক্মিণীকুমার রায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।